সুদুর অতীত থেকে একে একে বিবর্তনের ধাপ পেরিয়ে নামুষ আজকের এই পরিবেশে এসে পৌঁছেছে৷ তার এই অবিরল যাত্রা কিন্তু একক নিঃসঙ্গ যাত্রা নয়৷ সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তার সমাজকেও৷ অতীতের সেই অবিকশিত অনুন্নত অবস্থাতেও মানুষ বাস করত বিভিন্ন গোষ্ঠীতে দলবদ্ধ হয়ে৷ এর কারণ, মানুষ পারে না একা বাস করতে পারে না তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খোরাক সংগ্রহ করতে৷ সমষ্টি ব্যতিরেকে ব্যষ্টির অস্তিত্ব রক্ষা করা অসম্ভব কারণ মানুষ এক সামাজিক জীব৷ মানুষের কথা ভাবতে গেলে স্বভাবতই তার সমাজও এসে পড়ে, তাই মানুষের অস্তিত্বের দু’টি দিক---একটা সে নিজে তার ব্যষ্টির অস্তিত্ব আর দ্বিতীয়টি হ’ল সে সমাজের সদস্য---তার সমষ্টিগত অস্তিত্ব৷ এই দুই অস্তিত্ব থেকে মানুষের মূল্য নির্ধারণ করতে হয়৷ একটি হ’ল তার সামাজিক মূল্য আর অপরটি হ’ল তার মানবিক মূল্য৷
মানুষের সামাজিক মূল্য নির্ধারিত হয় তার সামাজিক দায়িত্ব থেকে৷ সমাজের সদস্য হিসেবে তাকে বিশেষ কতকগুলি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়৷ যে ড় দায়িত্ব পালন করে মানুষ স্বভাবতই তাকে মেনে নেয়---শ্রদ্ধা করে৷ কারণ এই দায়িত্ব পালনের মধ্যেই সকলের কল্যাণের প্রসঃ জড়িয়ে থাকে৷ ইতিহাসের পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই পৃথিবীতে যেদিন ক্ষত্রিয় যুগ ছিল, সেদিন অন্যান্য শ্রেণী থেকে রাজ-রাজারা পেত সব থেকে বেশী সম্মান৷ রাজদরবারে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা জনসাধারণ কুর্নিশ করত বাদশাকে সম্মান প্রদর্শন ক’রত বিনা দ্বিধায়৷ কারণ সেই ক্ষত্রিয়েরা তাদের বীরত্বে, সাহসে, শৌর্যের মহিমায় মানুষের মনে এক আসন করে নিয়েছিল৷ ঠিক তেমনি বিপ্রযুগে আমরা দেখতে পাই প্রয়ুগে আমরা দেখতে পাহ দ্ধিজীবীদের পায়ের তলে লুটিয়ে পড়েছে ক্ষত্রিয় ও অন্যান্য শ্রেণীর মানুষ৷ কারণ বিপ্রদের দ্ধির প্রাখর্যে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল সবাই৷ এই বিপ্রেরা আবিষ্কার করেছিল মানুষের কল্যাণের বিভিন্ন সামগ্রী তাদের ৌেদ্ধিক গবেষণায় সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছিল লেই সাই তাদের মেনে নিয়েছিল ঋষি লে৷ ভক্তিশ্রদ্ধায় নত হয়ে আসত সবার মস্তক সেই মহান ঋষিদের চরণে৷ এই হ’ল স্বাভাবিক নিয়ম---মানুষ সর্বদা সামাজিক মূল্যকেই সম্মান করে’ এসেছে সর্বদেশে সর্বকালে, কিন্তু মানবিক মূল্যকে কেউ কখনও শ্রদ্ধা করেনি৷ দেয়নি কেউই মানুষের মনুষ্যত্বকে সম্মান৷
মানবিক মৌল সিদ্ধান্ত বা Human cardinal principle হ’লa silver lining between the psycho-spiritual and spiritual strata of human existence আধ্যাত্মিক স্তর ও মানসাধ্যাত্মিক স্তর---এই দু’য়ের যে মিলনক্ষেত্র তাকেই লি মৌল মানবিক স্তর৷ মানুষের অস্তিত্ব ত্রিমুখী, ত্রিধারা সমন্বিত---দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক৷ এই ত্রিমুখী অস্তিত্বের মধ্যে দৈহিক ক্ষেত্রের সীমা অনেকে পেরিয়ে উঠতে পারে না৷ স্থূল ভোগই তাদের একমাত্র ধ্যেয় হয়ে পড়ে৷ তাদের ল দানব বা পশু শ্রেণীভুক্ত৷ নিজেদের জৈব বৃত্তিরা তাড়নায় তারা সর্বদা প্রেষিত হয়৷ জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতি, সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি, সূক্ষ্ম অনুশীলন তাদের নাগালের বাইরে৷ তারা জানে শুধু তাদের দেহকে, দৈহিক প্রয়োজসমূহকে৷
আবার অনেকে রয়েছেন যাঁরা শুধু দেহ নয়, মন নিয়েও তাঁদের কার্রার৷ তাঁরা অনুভব করেন যে মনের প্রাধান্যই পশুদের থেকে তাঁদের পৃথক করেছে৷ মানসিক পরিতৃপ্তির এষণায় তাঁদের জীবনধারা নিয়ন্ত্রিত৷ সূক্ষ্ম অনুশীলনের প্রচেষ্টায় তাঁরাই সৃষ্টি করেন কাব্য, কবিতা, শিল্প, সঙ্গীত, ভাস্কর্য৷ দয়া, মমতা, প্রেম, মৈত্রী, করুণা নিয়ে তাঁদের জীবনাভিব্যক্তি৷ তাঁরা উপলব্ধি করেন যে মনের গতিধারা অনন্তের সাথে মিলনের জন্যেই প্রবাহিত, তাই তাঁদের সমস্ত শক্তিকে তাঁরা নিয়োজিত করেছেন পরমসুন্দরের ধ্যানে৷ বৈবহারিক জীবনে তাঁরা আধ্যাত্মিক সাধক৷ এঁদেরই ল মানব৷
এই আধ্যাত্মিক সাধক পরমপুরুষের তীব্র বেগে চলতে চলতে একদিন এসে পৌঁছান এমন এক স্থানে যেখানে মানসিক সত্ত্বার শেষ ও আধ্যাত্মিকতার শুরু৷ সে সময় তাঁকে আর সাধারণ মানুষের পর্যায়ে ফেলতে পারি না৷ তাঁকে তখন ল দেবতা৷ মানবাস্তিত্বের এই যে পরিণতি যেখানে মানসিক স্তর আধ্যাত্মিক স্তর--- দু’য়ের হয় সংযুক্তি, সেই অবস্থায় পৌঁছানো প্রত্যেকটি মানুষের কাম্য ও কর্তব্য৷ মানবতার চরম উন্নতি এখানেই৷ এরপর আর মানবতা থাকে না, থাকে শুধু দেবত্বের মহিমা৷ যেখানে পশুতার পরিসমাপ্তি , সেখানে থেকে শুরু হয় মানবতার যাত্রা৷ আর মানবতার চরম শিখরে উন্নয়নের পরই শুরু হয় দেবত্বের পরমা প্রশান্তি৷ Where animality ends humanity begins, where humanity culminates divinity starts. এই মানবতার চরম বিকাশ ও দেবত্বের প্রারম্ভ ও দু’য়ের যে সন্ধি পর্যায় তারই ওপর ভিত্তি করে মানবিক মৌল নীতি নির্র্ধরিত হয়৷
অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানবজাতির ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দের্খ যে কোথাও মানবিক মূল্য সম্মানিত হয়নি৷ সম্মান তো দূরের কথা মনুষ্যত্বের দিকে কেউ দাক্ষিণ্যের দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করে নি৷ মানুষ শ্রদ্ধা করেছে তাদের যার দ্বারা তার স্বার্থপূর্তি হতে পারে৷ ভূলুন্ঠিত মানবতাকে অবহেলা করে করে’ তারা সম্মান করেছে তাদের, যারা সমাজের উচ্চমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত৷ এই উচ্চ মঞ্চের অহঙ্কার থেকে নীচে নেমে এসে মাটির মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করায় অনেক াধা৷ মানুষের অবহেলা আরও তীব্রভাবে প্রকট হয়েছে প্রতিটি যুগের শেষ অধ্যায়ে৷ মহান ক্ষত্রিয়দের সন্তানেরা, যাঁরা বংশপরম্পরাক্রমে রাজসিংহাসনে অধিকার ভোগ করতেন, তাঁরা নিজেদের প্রজাপালনের কর্তব্যটুকু বিস্মৃত হয়ে, মানুষের কল্যাণের পবিত্র দায়িত্বটুকু কে ভুলে গিয়ে নিজেদের বিলাস ব্যসনের উপাচার সংগ্রহে ব্যস্ত থেকেছেন সারাক্ষণ৷ নিপীড়িত মানুষের জীবনের টুকিটাকির খর তাঁরা কখনও নেননি৷ দারিদ্র্যের যাতনায় হয়ত ওষ্ঠাগত প্রাণ, কিন্তু রাজকর না দেওয়ার অপরাধে অধস্তন কর্মচারীর বেতের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বৃদ্ধ প্রজার দুর্বল জীর্ণ শরীরগাত্র৷ দয়ালু ও মানবপ্রেমিক রাজা যে ছিলেন না তা নয়৷ কিন্তু এমন রাজা কোথায় যিনি সমস্ত মানুষের দৈহিক ও মানসিক ক্ষুধা পরিতৃপ্ত করে প্রজ্ঞাঘন সত্তার সঙ্গে মহামিলনের আয়োজন করে দিয়েছেন? নিজেদের? নিজেদের প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বজয়ের অপ্রতিরোধ্য বাসনায় তাঁরা রণ-অভিযান করেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে৷ সাধারণ মানুষের হাসি কান্নার খোঁজ খর রাখার সময় কই তাঁদের৷ (ক্রমশঃ)