পূর্ব প্রকাকশিতের পর
ঠিক একই চিত্র দেখি বিপ্রযুগেও৷ মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতদের কাছে ঘেঁসাই অসম্ভব ব্যাপার৷ নিরীহ মানুষ বিপ্রের মন তুষ্ট করতেই ব্যস্ত৷ নৈবেদ্য, দক্ষিণা, পাদ্যর্ঘ্য দিয়ে পূজা-হচ্ছে বিপ্রদের কিন্তু ওপাড়ায় একটি দুঃস্থ পরিবার না খেয়ে শুকিয়ে মরছে, তাদের দিকে তাকানোর ফুরসুৎ কারোর নেই৷ কারণ তাদের দিকে তাকিয়ে তো লাভ কিছু নেই৷ বিনিময়ে পাব নাতো কিছুই, তাই যাক তারা যমালয়ে৷ মরুক তাদের সবাই৷ আমাদের করার কিছুই নেই৷ পূজা, অর্চনা, বিধিনিয়ম পালনে আমাদের কত কাজ৷ মন্দির, মসজিদ্, চার্চের অধিষ্ঠাত্রী দেবদেবীর অর্চনায় মানুষ নিজের দিনগুলি এইভাবে নিঃশেষ করে ফেলেছে৷ মনুষ্যতের পূজা আর হয়ে ওঠেনি৷ বিপ্রদের শাস্ত্র অনুযায়ী ইট, কাঠ, পাথরের তৈরী দেবালয়ের দাম মানুষের থেকে অনেক বেশী৷ শীতের সন্ধ্যায় হয়ত কাঁপতে কাঁপতে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল বৃদ্ধ ভিখারী৷ অবসন্ন দেহ, সারাদিনের ভিক্ষা হয়ত জোটেনি কিছুই৷ মন্দিরের কাঁসর ঘণ্টা শঙ্খধবনির কলরোলে তখন দেবতার আরতি হচ্ছে বিধিমত৷ করজোড়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত ভক্তবৃন্দ৷ মন্দিরের বাইরে অর্ধনগ্ণ ভিখারী দাঁড়িয়ে কাঁপছে থরথর করে৷ আরতির শেষে একে একে বেরিয়ে গেল সবাই সবার শেষে পুরোহিতকে যদি সে প্রার্থনা করে এক কোণে থাকবার জন্যে, তার সেই প্রার্থনা মঞ্জুর হয় না৷ পুরোহিত বলর্েন, তোমার জন্যে আমার দেবালয় অপবিত্র হতে দিতে পারি না৷ নীরবে চলে যেতে হয় বৃদ্ধকে অনিশ্চিত তার আস্তানায় নিজেকে কবর দিতে শীতের কফিনে৷ একটা মানুষের জীবনের কোন দাম নেই৷ দাম শুধু জড় ইঁটের -কাঠের শুচিতার৷ ধর্মমতের ওপর ভিত্তি করে তৈরী হয়েছে পাপ পুণ্যের খসড়া, তৈরী হয়েছে বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন দণ্ডসংহিতা ও শাস্ত্র নিজেদের কায়েমী স্বার্থের দূরভিসন্ধিতে সেইসব শাস্ত্রকে অপৌরুষের বলে প্রচারিত করা হয়েছে৷ তাই মানুষের থেকে তথাকথিত শাস্ত্রবর্ণিতশাসত্র দেববাণীর দাম অনেক বেশী৷ মানুষ সেই বাণীর সেই ব্যবস্থার অবমাননা বা বিরুদ্ধাচরণ করলে তাকে পেতে হবে কনঠোর শাস্তি৷ বিজাতীয় মানুষকে স্পর্শ করা মহাপাপ৷ সমাজ থেকে তাকে হতে হবে বিতাড়িত সেই পাপের জন্যে৷ শাস্ত্রমতে হয়ত প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, সে প্রায়শ্চিত্ত কখনও কখনও তার প্রাণহানিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ কেউ যদি এই কঠোর শাস্তি থেকে একটু শৈথিল্য প্রার্থনা করে, সমাজগুরুরা তা দিতে অপারগ৷ কী করতে পারেন তাঁরা, শাস্ত্র লেছে যে! পুঁথিসর্বস্ব যাদের জীবন তারা মানুষের জীবনের মূল্য কি বোঝে? কত যুগ কত জীবন কত ধাপ পেরিয়ে একটা জীব মানুষের শরীর পায়৷ তাই লা হয়েছে, ‘দুর্লভং মানুষং জন্ম’৷ কিন্তু এই ধরণের কত অমূল্য ত্বীবনকে শাস্ত্রের বিধান মানতে গিয়ে অকালে বিনষ্ট হতে হয়েছে৷ কত নিরীহ মানুষের জীবন, শাস্ত্রের যূপকাষ্ঠে বলি দিতে হয়েছে তার হিসেব কে রাখে!
পাপ বা পুণ্য দেশ-কাল-পাত্র-ভেদে মানসিক বিকৃতির নামবিশেষ৷ যে ধরণের বিকৃতিকে এক দেশে বা এককালে একজন পাত্র বলেছে পাপ, অন্য দেশ বা অন্য কালে অন্য কেজন লেছে পুণ্য৷ তাই ব্যাষ্টি-বিশেষের, কাল.-বিশেষের পাপ-পুণ্যের ধারণাকে চরম লে মনে করার পেছনে কোন বলত্তি নেই৷ কারণ বিশেষ বিশেষ ধর্মমতাশ্রয়ীবিশ্বাস্, প্রাকৃতিক বা অন্য কোন কারণে সৃষ্ট সমাজের পুঞ্জীভূত সংস্কার, এই দু’টোর যে কোন একটাকে বা একসঙ্গে দু’টোকে কেন্দ্র করে পাপ-পুণ্য বোধ তৈরী হয় ওএই বোধ দেশ-কাল-পাত্র ভেদে পাল্টায়৷ তাই দেখেছি প্রাচীন ভারতের লোকেরা নির্বিকার চিত্তে পতি-বিয়োগে শোকাকুলা অসহায়া নারীকে টেনে হিঁচড়ে মৃত স্বামীর চিতায় আগুনে পুড়িয়ে মারত৷ এটাই ছিল তাদের শাস্ত্রের পুণ্যকর্ম৷ কিন্তু আজ সেই কর্মকেই বলা হবে পাপ৷ এই মেকি ধর্মবোধ মানুষকে শোষণ করেছে বার বার৷ শাস্ত্রের বিধানে অন্ধ বিশ্বাসী মানুষ সেদিন এই ভাবে নৃশংস নরমেধ যজ্ঞ করে তৃপ্তি পেত৷ শাস্ত্র বলেছে কুমারী জীবন ধারণ করা পাপা, তাই ন’বছরের অনূঢ়া বালিকাকে মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধকে বিবাহ করতে বাধ্য করা হয়েছে৷ আবার সেই বৃদ্ধ পতির মৃত্যুর পর শাস্ত্রের শ্লোক শুণিয়ে তাকে শেখানো হয়েছে, মৃত পতির কাছেই তাকে ফিরে যেতে হবে, দ্বিতীয় বিবাহ হতেই পারে না৷ ভাবপ্রবণা নারী মৃত্যুর পর স্বামীর প্রেতাদ্মার সঙ্গে মিলিত হবার আশায় আজীবন কৃচ্ছ সাধন চালিয়ে যেতে চেষ্টা করে৷ কিন্তু পুরুষদের বহু বিবাহে কোন দোষ নেই৷ যে সমস্ত নারীদের অসহায়ভাবে বহুপত্নীকের স্ত্রী হতে হয়েছে, তাদের জ্বলতে হয়েছে সারাজীবন সতীনের জ্বালায়৷ তার স্বাক্ষর রয়েছে ছোট ছোট গ্রামীণ ছড়ার মধ্যে৷ সতীনকে মারতে পারলেই শান্তি---
‘‘নাড়ু গাড়ু গাড়ু
সতীন মেরে হাতে পরব খাড়ু
শুধু সতীন নয়, বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থায় কোথাও কোথাও আজও বাড়ীর বউদের শাশুড়ী ও ননদের খোঁটায় সারাজীবন দুর্বিষহভাবে কাটাতে হয়৷ সরা মেপে নাকি বউদের রান্না করা হ’ত৷ সেই সরাটি যদি ভেঙ্গে যায়, তবে সেদিন বউদের কত না আনন্দ৷ কিন্তু শাশুড়ী আরও শক্ত মানুষ, সরার পরিবর্তে হাতের মুঠোয় চাল রাঁধেন বউদের জন্যে৷
ছোট সরাখানি ভেঙ্গে গেছে,
বড় সরাখানি আছে,
নাচ আর কাঁদ বউ,
হাতে আটকল আছে৷
কী ভয়ানক নিষ্ঠুরতা৷ মানুষের সাধারণ নূ্যনতম প্রয়োজন মেটাবার ক্ষেত্রেও এইরূপ নিষ্ঠুরভাবে কার্পণ্য করা হ’ত৷ এইভাবে তখনকার নারীদের ওপর নিয়ম-কানুনের নির্যাতন এমন কি নিজের ঘরের মধ্যেও অত্যাচার, সবকিছু মিলে তার জীবন ছিল অসহনীয়৷ সহ্য করতে না পেরে গোপনে গোপনে কাঁদতে হয়েছে সেই সমস্ত অসহায়া নারীদের৷ প্রতিকারহীন অত্যাচারে কত লক্ষ লক্ষ নারী বিনিদ্র রচনীর অন্ধকারে গুমরে কেঁদে মরেছে কে তার হিসেব রাখে৷ শাস্ত্র-শাসনের ষ্টিম রোলারের কাছে এই ধরণের কোমল মাটির মত ভাব-প্রবণতা, আশা-আকাঙ্খা, দুঃখলাঞ্ছনা সব গুঁড়িয়ে গেছে৷ সেই ক্রন্দন, সেই আর্তনাদ কেউ কাণ পেতে শোণেনি৷ পাপ-পুণ্যের অবিবেকী নিয়মকানুনে মানুষের প্রাণের ঠাকুরকে বারবার করা হয়েছে ঘৃণা, পদাঘাত৷ (ক্রমশঃ)