সামাজিক সুবিচার ঃ নারী

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কোন বিশেষ কার্যে বা জীবনের কোন বিশেষ ক্ষেত্রে, কোন বিশেষ মানুষ বা শ্রেণীর মধ্যে যদি কোন শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক বা আধ্যাত্মিক দুর্বলতা দেখা দেয়, তবে বাকীদের উচিত তাদের হূদয়বৃত্তির সবটুকু মাধুর্য ঢ়েলে দিয়ে তাদের সেই দূর্বলতাটুকু দূর করে’ দেওয়া৷ প্রকৃত মানবিকতা বা প্রকৃত অধ্যাত্মদৃষ্টির অভাবে মানুষ কিন্তু ঠিক তার উল্টোটাই করে’ থাকে৷ কারুর কোথাও কোন দুর্বলতা দেখতে পেলে সুবিধাবাদী মানুষ সেই ফাঁক দিয়ে শিং গলিয়ে তার প্রাণের ফসলটুকু খেয়ে ফেলতে চায়–দুর্বলের ব্যথা বা মর্মবেদনার কথা ভেবে দেখাটাই নিজের দুর্বলতা বলে’ মনে করে৷ (তাই)  সমাজে যত প্রকারের অনর্থ ঘটে থাকে তার প্রায় ৭৫ ভাগই হয়ে থাকে মানুষের প্রতি মানুষের সুবিচারের অভাবে৷

অধিকাংশ জীবের মত মানুষের সমাজেও নারীরা শারীরিক বিচারে পুরুষের চাইতে দুর্বল৷ স্নায়ুর দুর্বলতার জন্যে মনও তাদের কিছুটা দুর্বল৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাজের কাছে তাদের মূল্য পুরুষের চাইতে এক পাইও কম নয়৷ স্বার্থপর পুরুষ কিন্তু এই মূল্যবোধের অপেক্ষা না রেখে নারীর দুর্বলতার সুযোগটুকুই ষোল আনা নিয়েছে ও নিচ্ছে৷ মুখে মাতৃজাতি বলে’ ঘোষণা করলেও আসলে তাদের অবস্থাটা করে’ রেখেছে ঠিক গৃহপালিত গোরু–ভেড়ার মত৷ একথা খুবই সত্যি যে কতকগুলি বিশেষ ক্ষেত্রে যোগ্যতার অভাবের ফলেই নারীরা ধীরে ধীরে তার অধিকার বা স্বাধীনতা খুইয়ে বসেছে, আর এই জন্যেই যাঁরা বিশেষ বিশেষ কতকগুলি যোগ্যতাকেই অধিকার প্রাপ্তির একমাত্র চাবিকাঠি হিসেবে দেখতে চান, তাঁরা নারীকে সর্বদাই বেশ একটা কড়া শাসনে, নিজেদের বিনা পয়সায় পাওয়া ক্রীতদাসী হিসেবে দেখতে চান৷

নারীরা কিন্তু আজ যে অধিকার হারিয়েছে–অন্ততঃ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে হারিয়েছে বলে’ মনে হচ্ছে– সে জিনিসটাও যথাযথ সমাজাশ্রয়ী মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ব্দপ্সন্তুন্প্স–হ্মব্দ প্তম্ভব্দন্ব্দগ্গ করলে বলতে হয় যে, নারীরা তাদের স্বাধীনতা হারায়নি–তারা পুরুষকে বিশ্বাস করে’ তাদের হাতে নিজেদের ভাগ্য ছেড়ে দিয়েছে৷ নিজেকে অসহায় ভেবে, বা হূদয়বৃত্তির আহ্বানে নারী একদিন যে অধিকার তার হাতে তুলে দিয়েছিল আজ নারীরই প্রয়োজন বুঝে পুরুষের উচিত ধীরে ধীরে তা নারীর হাতে ফিরিয়ে দেওয়া৷ প্রকৃতির সন্তান হিসেবে যে আলো–হাওয়া–মাটি–জল পুরুষ তার ভোগ্য হিসেবে পেয়ে থাকে–তার অধিকার অবাধভাবে নারীকে দিতে হবে৷ বস্তুতঃ   এটাকে অধিকার দেওয়া না বলে’ বলব অধিকার স্বীকার করে’ নেওয়া৷ কিন্তু এই অধিকার স্বীকার করে’ নিতে গিয়ে যদি ভাবালুতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় তাতে সমাজের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা৷ ধরা যাক দায়াধিকারের কথা৷ বস্তুতঃ এ সম্বন্ধে কোন সিন্ধান্তে পৌঁছুতে গেলে যে মূলনীতিটা থাকা দরকার, সেটা হচ্ছে কাউকে বঞ্চিত করব না, নারী পুরুষকে দায়াধিকারে সমান সুযোগ দোব, অথচ আইন তৈরী এমনভাবে করব, যাতে করে’ সম্পত্তির পরিচালনা বা রক্ষণাবেক্ষণ সুষ্ঠুভাবে হতে পারে, ও পারিবারিক অশান্তির সম্ভাবনাও কম দেখা দেয়৷  দায়াধিকার বিধান রচনার সময়ে বিশেষ সতর্কভাবে দৃষ্টি রাখতে হবে যে, পিতৃগত কুল ব্যবস্থার খাতিরে এমন কিছু যেন করে’ বসা না হয়, যার ফলে নারীকে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে ভ্রাতা বা দেবর–ভাশুরের গৃহে দাসীবৃত্তি করতে বাধ্য হতে হয়৷ অর্থাৎ কিনা সমানাধিকারের ভিত্তিতে ভোগ দখলের দাবী স্বীকার করে’ নিয়ে উত্তরাধিকারের বিধি পিতৃগত কুলব্যবস্থায় চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে৷  কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার দিতে গিয়ে অনেকে জোর করে’ নারীকে নারী–ধর্ম বিরোধী গুরুতর শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম–সাপেক্ষ কার্যে নিয়োগ করতে চায়৷ এ জাতীয় মনোভাব অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ৷ একথা স্বীকার করতেই হবে যে, শারীরিক ও স্নায়ুগত শক্তি পুরুষের চাইতে নারীর কম৷ তাই কর্মভূমি এতদুভয়ের হুবহু এক হতে পারে না৷ নারীর শারীরিক ও মানসিক সংরচনা যে রকমের তাতে করে’ তাদের পক্ষে শিশুসন্তান পালনে যতটা যোগ্যতার প্রয়োজন তার সবটুকু থাকলেও তাদের সবরকমভাবে গড়ে’ বড় করে’ তোলা, অন্ন–বস্ত্র–শিক্ষা–চি যথাযথ ব্যবস্থা করে’ দেওয়া রীতিমত অসুবিধাজনক, অথচ সন্তানকে তার কাছে রাখতেই হবে–নইলে সন্তানের পক্ষে বাঁচা মুস্কিল হয়ে দাঁড়ায়৷        তাই এ ব্যাপারে অর্থাৎ অন্ন–বস্ত্রের সংস্থানের পক্ষে মুখ্য দায়িত্ব যদি নারীর বদলে পুরুষ নেয়, আর নারী তার সন্তান প্রতিপালন করে’ সম্ভবক্ষেত্রে ও প্রয়োজনবোধে ঘরে থেকে বা ঘরের বাইরে গিয়ে মেহন্নত করে’ অর্থোপার্জন করে তাতে সন্তানের বা সমাজের বিশেষ কোন অসুবিধা হয় না৷

ভাবালুতার ফলে অনেকে ভাবেন কিছু সংখ্যক নারীকে পার্লামেণ্টের সদস্যা বা মন্ত্রী করে’ দিলেই বুঝি তা সমানাধিকারের বা নারী–প্রগতির জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে৷ কিন্তূ এ মনোভাবটা কি ঠিক অধিকার স্বীকার করে’ নেওয়া, বা প্রগতিকে ত্বরান্বিত করা–নীতি হিসেবে এই রকমের ভাবগ্রহণ করতে গিয়ে যদি যোগ্যকে উপেক্ষা করা হয়, তার ফলে কি সমগ্র গোষ্ঠী বা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না অধিকার স্বীকার করা একটা আইনগত তথা সামগ্রিক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার, আর প্রগতিকে ত্বরান্বিত করার পক্ষে দ্রুত শিক্ষাব্যবস্থাই একমাত্র পথ৷ তাই কোন দেশের নারী মন্ত্রী বা রাষ্ট্রদূত হয়েছেন দেখে’ সে দেশের নারীর সত্যকার মান নির্ধারিত হয় না৷ সমাজে নারীর মান উন্নত করতে গেলে অত সহজে বা অত সস্তায় সে কাজ হবার নয়৷

স্ত্রী–পুরুষের স্বাধীনতা যেমন স্বীকার করতে হবে, ঠিক তেমনই তাদের মেলামেশায় একটা সংযমসম্মত সুসম্বন্ধ বিধিও রেখে দিতে হবে৷ যাঁরা আধুনিকতার ছোঁয়াচ থেকে কন্যাকে দূরে রাখতে চান বলে’ তাদের স্কুল–কলেজে পাঠাতে নারাজ–তাঁরা হয়তো জানেন না যে, আধুনিকতার ঢ়েউ তাঁদের অজ্ঞাতসারেই তাঁদের অন্তঃপুরে হাঁড়ি–হেঁসেলে বহু পূর্বেই ঢুকে গেছে৷ তাই পর্দা টাঙ্গিয়ে বা বোর্খা ঢ়েকে তাঁরা তার হাত থেকে বাঁচবার যে চেষ্টা করে’ থাকেন, তা একটা প্রহসন মাত্র৷ যুগের হাওয়াকে জোর করে’ আটকে রাখা যায় না–তার মধ্যেও যে একটা গতিশীলতা রয়েছে! বুদ্ধিমানের কাজ এই যুগপ্রবাহকে নিজের মনীষার সাহায্যে কল্যাণের পথে নিয়ন্ত্রণ করা৷ সব সময় মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা এক জিনিস নয়৷ স্ত্রী স্বাধীনতা ভাল– তা বলে’ স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না৷ স্বেচ্ছাচারিতা–তা সে পুরুষেরই হোক বা নারীরই হোক– সামাজিক কাঠামোকে অল্পদিনের মধ্যে ভেঙে চুরমার করে’ দিতে পারে৷ ব্যষ্টিগত জীবনে শুচিতা নারী–পুরুষ দুয়েরই সমানভাবে প্রয়োজন, আর সে প্রয়োজন সিদ্ধ করতে গেলে সত্যিকারের অধ্যাত্ম–দৃষ্টি থাকা দরকার৷ নারী বা পুরুষ কারও প্রতি অবিচার করে’ এ প্রয়োজন সিদ্ধ হবার নয়৷ মানুষ মাত্রেরই বোঝা দরকার যে, কোন কিছুকে গড়ে’ তুলতে গেলে বা বাঁচিয়ে রাখতে গেলে তার প্রতিটি অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের মধ্যে দরকার একটি নিবিড় সহযোগিতামূলক আচরণের৷ মানুষ জড় নয়, তাই তার প্রতিটি সামবায়িক সংঘটন টিঁকে থাকে শুধু যে সহযোগিতার ওপরে তা নয়–এ সহযোগিতার মধ্যেও একটু বৈশিষ্ট্য আছে৷ আর সেটা হ’ল এই যে, সহযোগিতাটা প্রভু–দাসের সম্পর্কে গড়ে’ না উঠে–স্বাধীন মানুষের সহূদয়তাপূর্ণ পরিবেশেই গড়ে’ ওঠা দরকার৷  That should be a co-ordinated co-operation and not a sub-ordinated one