তোমরা যারা জমির খাজনা সংক্রান্ত বিধিব্যবস্থা নিয়ে পড়াশোণা করেছ তারা জান যে ভারতে পাঠান, মোগল, প্রাক্–ৰৌদ্ধ ও ৰৌদ্ধযুগে রাজাকে খাজনা দেওয়া হত সোণার বিনিময়ে৷ দশ–বিশটা গ্রামকে একত্র করে’ এক একটা revenue village বা মৌজা তৈরী হত আর গ্রামবাসীদের মধ্যে একজনকে ক্ষমতা দেওয়া হত খাজনা সংগ্রহের৷ এই খাজনা বা কর আদায়কারীদের সরকার কোন পয়সাকড়ি দিত না, জমি দিত যা চাষ করে’ তারা জীবিকা নির্বাহ করত৷ তারা কৃষিক্ষেত্রে রাজা ও জনসাধারণের মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগী (intermediaries) রূপে কাজ করত, আর ধীরে ধীরে এরাই শক্তিশালী জমিদারে পরিণত হ’ল৷ প্রাচীনকাল থেকেই এই মধ্যস্বত্বভোগীদের অস্তিত্ব ছিল৷ এদের বলা হত জমিদার, পত্তনিদার, দরপত্তনিদার, সেপত্তনিদার, জোতদার, বর্গাদার ও অধিকারী৷ অবশ্য প্রাউট এই প্রথাকে সমর্থন করে’ না৷
অতীতে শক্তিশালী রাজার অধীনে থাকতেন অনেক ছোট রাজা৷ এই দুই ধরনের রাজাই নিজস্ব সৈন্যদল ও মিলিশিয়া রাখতেন যদিও মধ্যস্বত্বভোগীদের সেই অধিকার ছিল না৷ বর্ত্তমানে অসম রাইফেলস ও রাজপুত রেজিমেন্ট মিলিটারীরই অঙ্গ৷ তাই তাদের আর মিলিশিয়া বলে গণ্য করা হয় না৷ মিলিশিয়া মানে অন্যের ওপর নির্ভরশীল নয় এমন স্থানিকবাহিনী বা নিজস্ব সৈন্যদল৷ এই মিলিশিয়া পরিচালনা করার জন্যে চাই ক্ষমতা ও দাপট, আর যার সেই গুণ থাকত তাদের বলা হত মিলিটান্ট বা সামরিক ক্ষমতাসম্পন্ন৷ যদি ছোট রাজা অন্য ক্ষমতাশালী রাজাকে কর প্রদান সহ সব ব্যাপারেই মেনে চলত, তখন বলা হত, তারা সেই রাজার ''supremacy'' বা প্রভূত্ব স্বীকার করে’ নিয়েছে৷ অবশ্য ''supremacy'' আর ''suzerainty'' এই দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য আছে৷ ''suzerainty'' শব্দটার অর্থ হ’ল ছোট রাজা কোন ক্ষমতাবান রাজার অধিকার স্বীকার করে’ নিয়েছে, কিন্তু তাকে করপ্রদান করতে সে বাধ্য নয়৷ যেমন অষ্ট্রেলিয়া ব্রিটিশ রাজা বা রাণীর suzerainty স্বীকার করে, কিন্তু ব্রিটিশ সরকারকে কোন করপ্রদান করে না৷
সেই যুগে তিন রকমের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল ঃ গরীব জনসাধারণ নিজেদের মধ্যে দ্রব্য বিনিময় করত যারা কিছুটা বিত্তশালী ছিল তারা রজতমুদ্রার বিনিময়ে জিনিসপত্র কিনত আর ধনী লোকেরা ক্রয় করত স্বর্ণ মুদ্রার মাধ্যমে৷ কর সংগ্রহকারী এই তিনের মধ্যে যে কোনটির মাধ্যমে কর সংগ্রহ করত কিন্তু তারা রাজাকে খাজনা দিত স্বর্ণবিত্তের মাধ্যমে৷
দীর্ঘকাল ধরে’ এই কর বা খাজনা ব্যবস্থা চলে এলেও আকবরের সময় এর একটা নির্দিষ্ট রূপ দেওয়া হ’ল৷ যেমন আকবর ডিক্রী জারী করলেন যে খাজনা আদায়কারীদের জমি দেওয়া হবে পাঁচ বা দশ বছরের জন্যে৷ পরবর্ত্তীকালে লর্ড কর্নওয়ালিশ সিদ্ধান্ত নিলেন যে তাদের জমি দেওয়া হবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে৷ তিনি বিধান দিলেন যে কর আদায়কারীদের প্রদত্ত জমির মালিকানা ও তাদের অধিকার বংশানুক্রমিক হবে৷ এই ব্যবস্থা এই জন্যে নেওয়া হয়েছিল যাতে কর আদায়কারী, কর আদায় হয়ে যাওয়ার পরে, এলাকা ত্যাগ করে’ চলে না যায়৷ আকবর আরও একটি ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন করলেন যে প্রতিটি জমিখণ্ডের (plot) উত্তর ও পশ্চিম সীমা জমির মালিকের অধিকারভুক্ত হবে৷ জমির বিধিনিয়মকে বলা হত ‘‘পাট্টা কবুলিয়ৎ’’ ব্যবস্থা৷ আকবরের প্রধানমন্ত্রী টোডরমল এই ব্যবস্থা কার্যকর করেন৷ জমির খাজনা সংক্রান্ত ব্যবস্থাকেও বলা হত জমিদারী ব্যবস্থা৷
আকবর জায়গীরদার প্রথারও প্রবর্ত্তন করেছিলেন৷ জমিদারী ও জায়গীরদারী এই দুই প্রথাতেই জমির খাজনা দেওয়া হত রাজাকে৷ এদের মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে জমিদারী প্রথায় জমিদার যদি সময়মত খাজনা প্রদানে অসমর্থ হত, তাকে কারাবাসে পাঠানো হত৷ আর বকেয়া খাজনা দিয়ে দিলে তাকে মুক্তি দেওয়া হত৷ জায়গীরদার প্রথায় খাজনা প্রদানে অসমর্থ হলে জায়গীরদারের জমি বাজেয়াপ্ত করে’ নেওয়া হত৷ সমগ্র ভারতে হয় জমিদারী প্রথা না হয় জায়গীরদার প্রথা বলবৎ ছিল৷ যদিও ব্রিটিশ আমলে জমিদারদেরই মুখ্য খাজনা আদায়কারী রূপে গণ্য করা হত৷
জমিদারেরা শুধুমাত্র খাজনা আদায়কারী রূপে গণ্য হত, ও তাদের কোন রাজনৈতিক অধিকার ছিল না৷ অবশ্য তারা যা খাজনা আদায় করত তার একটা নির্দিষ্ট অংশই রাজকোষে জমা পড়ত তাই জমিদারেরা এক ধরনের সামাজিক পরগাছার মতই আরামে আয়েসে জীবন অতিবাহিত করত৷ জমিদারী ব্যবস্থায় সরকারকে কোন অর্থ ব্যয় করতে হত না –– এটা সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব সংগ্রহের একটা ব্যবস্থা মাত্র ছিল৷
ব্রিটিশ যুগে কৃষি বিভাগে সরকার কর্ত্তৃক দুইজন উচ্চপদস্থ অফিসার এই কর সংগ্রহ ও কৃষিকাজের তত্ত্বাবধানের জন্যে নিযুক্ত হত৷ এদের মধ্যে যিনি civilian পর্যায়ভুক্ত তিনি করসংক্রান্ত কার্যালয় পরিচালনা করতেন৷ তিনি ছিলেন সচিব (secretary) পদমর্যাদাযুক্ত, ও তার কার্যালয়কে বলা হত সেক্রেটারিয়েট৷ অপর জন হতেন কৃষির ব্যাপারে অভিজ্ঞ ও কারিগরী জ্ঞান সম্পন্ন৷ তাঁকে বলা হত অধিকর্ত্তা (director), ও তাঁর কার্যালয়কে বলা হত ডাইরেকটরেট৷ সচিব ইন্ডিয়ান সিবিল সার্বিসের সদস্য হতেন৷
রাজস্ব বিভাগে একটি রেভেন্যু বোর্ড থাকত৷ ইন্ডিয়া সিবিল সার্বিসের একজন সদস্য সেই বোর্ডের সভাপতি হতেন৷ এই পদের গুরুত্ব এত বেশী ছিল যে, ভাইসরয় অসুস্থ থাকলে তাঁর পক্ষে রেভেন্যু বোর্ডের সভাপতি সরকারের সমস্ত কার্যাবলী পরিচালনা করতেন৷ সেকালে রাজস্ব বিভাগের কত গুরুত্ব ছিল তা এই ব্যবস্থাতেই ৰোঝা যায়৷ আজ রাজস্ব বিভাগ যেন সরকারের বোঝাস্বরূপ, আর তার আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণই বেশী৷
রাশিয়ায় জার–সম্রাটদের সময় সেখানেও এক ধরনের রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল, আর রাজস্ব আদায়কারীরা ভারতের মতই বংশানুক্রমিকভাবে অধিকার ভোগ করতেন৷ রাশিয়ায় এই ব্যবস্থা ছিল অবশ্য এক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, কেননা রাজস্ব আদায়কারীরা রাষ্ট্র ক্ষমতাও ভোগ করতেন৷ কিন্তু ভারতে এই ধরনের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না, কেননা জমিদারদের কোন রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকত না৷ জমিদার কোন অপরাধ করলে অন্য সাধারণ মানুষের মত তাকেও বিচারব্যবস্থার সম্মুখীন হতে হত৷ জমিদারেরা সামন্তপ্রভু না হওয়ার জন্যে তারা অন্যের জমি কেড়ে নিতে পারত না৷
ব্রিটেনেও ছিল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, ও তাতে ব্যারন, ভাইকাউন্ট, আর্ল, মার্কওয়েসেস্, ডিউক –– এরা সব ছিলেন সামন্তপ্রভু৷ তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও ছিল ও তাঁরা হাউস অব লর্ডের সদস্য হতেন৷ হাউস অব কমন্সের সদস্যরা নির্বাচিত হতেন সাধারণ মানুষদের ভোটে৷ পরবর্ত্তীকালে এই ব্যবস্থা করা হ’ল যে হাউস অব কমন্স কোনো আইন পাশ করে’ পাঠালে হাউস অব লর্ডস তা প্রত্যাখ্যান করতে পারত৷ কিন্তু হাউস অব কমন্স দ্বিতীয়বার তা পাশ করে পাঠালে, হাউস অব লর্ডস তাতে সম্মতি দিতে বাধ্য থাকত, ও রাজা বা রাণী তাতে হস্তাক্ষর করতে বাধ্য থাকতেন৷ এতে ৰোঝা যায় যে সেখানে পুরোদস্তুর সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম ছিল৷ ইংল্যান্ডে নিয়ম ছিল যে, কোনো লর্ডের জ্যেষ্ঠ পুত্র যদি কোনো বিবাহ বিচ্ছিন্নাকে বিবাহ না করে’ থাকে তবে সে হাউস অব লর্ডের সদস্য হবে৷ কিন্তু ফ্রান্সে নিয়ম ছিল সামন্তপ্রভুর সব ছেলেরাই লর্ড বলে গণ্য হবে৷ এতে লর্ডের সংখ্যা এত বেশী বেড়ে গিয়েছিল যে তারা তাদের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিল৷
জমিদার প্রথার কিছু ভাল দিকও ছিল৷ ভাল জমিদাররা গরীব প্রজাদের দেখাশোনা করত৷ তারা যদি কর প্রদানে অসমর্থ হত তবে অনেক সময় জমিদার তাদের পক্ষ থেকে কর জমা করে’ দিত৷ অনেক জমিদারের নিজস্ব বনাঞ্চল (private forest) ছিল৷ আর সরকারী বনাঞ্চলকে বলা হত সংরক্ষিত বন (reserve forest) । এই ব্যষ্টিগত মালিকানাধীন বনাঞ্চল জমিদারেরা সাধারণতঃ ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করত৷ এর ফলে পরিবেশগত সাম্য ঠিকভাবে বজায় থাকত৷ বন্যা, ভূমিস্খলন, ভূমিক্ষয় কম হত, আর জমির উর্বরতা বজায় থাকত৷ গ্রীষ্মকালে নদী সচরাচর শুকিয়ে যেত না৷ জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর এই সব private forest কেটে সাফ করে’ দেওয়া হয়েছে, ও এই ভাবে পরিবেশের ভারসাম্যও ধ্বংস হয়েছে৷
জমিদারী প্রথার অনেক ত্রুটিও ছিল৷ চাষীদের জমিতে কোন অধিকার ছিল না–তারা ছিল শুধুমাত্র কর্ষণকারী৷ অথচ জমিদারেরা এক বিশাল পরিমাণ জমি নিজেদের ব্যষ্টিগত মালিকানায় রেখে দিত৷ তদতিরিক্ত জমিদারেরা যত রাজস্ব আদায় করত, আর সরকারের কোষাগারে যা জমা দিত তার মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকত৷
জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচার চলতে থাকায় এই প্রথা বিলুপ্ত করে’ দেওয়া হ’ল৷ বারংবার মানুষকে যদি একই কথা শোণানো হতে থাকে তবে মানুষ এক সময় ভাবে যে তাতে নিশ্চয়ই সত্যতা আছে, ও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে৷ জমিদারী ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও তাই–ই ঘটেছিল৷ জমিদারী ব্যবস্থা রদ্ হয়ে যাওয়ার পরে সরকারকে বেতন দিয়ে কর সংগ্রহ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হ’ল যার খরচ নির্বাহ হত এই রাজস্ব বিভাগ থেকেই৷ জমিদারী ব্যবস্থা রদ্ করে সরকারের রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় নি৷ জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত না করে’ সরকার যদি পূঁজিপতিদের পূঁজির ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতেন, আর তাদের bank balance আর সঞ্চিত স্বর্ণবিত্তকে সিলিং–এর আওতায় আনতেন, তাতে সমাজের বেশী উপকার হত৷ এছাড়া আরও নানা ভাবে জমিদারদের ক্ষমতা খর্ব করা ও চাষীদের স্বার্থ রক্ষা করা যেতে পারত৷ তার পরিবর্ত্তে সাধারণ মানুষকে নিরন্তর শোণানো হতে থাকল, যে চাষ করে’ জমি তার৷ এই যুক্তি যদি মেনে নিতে হয় তবে বলতে হয় যে দাড়ি কামায়, মাথার মালিকও সেই–ই৷
১৩ জুলাই ১৯৮৮, কলিকাতা