প্রাচীন ভারতের তপোবনের অধ্যাত্ম-ভিত্তিক শিক্ষার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার যোগসাধনের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী স্থাপন করে ছিলেন শুরুতে তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রাচীন ভারতের মুনীঋষিদের আদর্শকে তিনি এই শিক্ষার ভিতরূপে গ্রহণ করেছিলেন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার দিবসেই তিনি তাঁর আদর্শ পরিষ্কার ভাবে সুপরিস্ফুট করেছিলেন তিনি প্রাচীন ভারতের ঋষিদের আদর্শের মূল কথাকে তুলে ধরে বলেছিলেন,তাদের বেশভূষা বিলাসিতা কিছুই ছিল না অথচ বড়ো বড়ো রাজারা এসে তাঁদের কাছে মাথা নত করতেন আমরা টাকাকড়ি জুতোছাতা পাবার জন্যে যেরকম প্রাণপণ খেটে মরি, তাঁরা সত্যকে পাবার জন্যে তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট স্বীকার করতেন সেইজন্যে তাঁরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বড়ো ছিলেন তাঁরা অভয় ছিলেন, ধর্ম (সার্বভৌম মানবধর্ম) ছাড়া আর কিছুকেই ভয় করতেন না তাঁদের মনের মধ্যে এমন-একটা তেজ ছিল, সর্বদাই এমন একটি আনন্দ ছিল, তাঁরা কোনো রাজা-মহারাজার অন্যায় শাসনকে গ্রাহ্য করতেন না, এমনকি মৃত্যুকেও তাঁরা ভয় করতেন না
এই সত্যানুসন্ধানের আদর্শ, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের ভিত্তিতেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাকে তিনি বলেছেন মনুষত্বের পূর্ণত্ব লাভের সাধনা তারই সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন আধুনিক সভ্যতার শিক্ষার বিভিন্ন শাখাকে তিনি চেয়েছিলেন, আধুনিক জড়বাদী তথা ভোগবাদী প্রভাবের মারাত্মক বিষ থেকে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে তিনি তাঁর এই আদর্শ তাঁর বিভিন্ন রচনা ও প্রবন্ধাবলীতে সুস্পষ্ট ভাষাতেই বলেছেন আর, বিদ্যালাভকে তিনি সাধনা হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন তিনি ভাবতেন তার উপযুক্ত স্থান নাগরিকতার কলুষ পরিবেশ নয়, তপোবনের স্নিগ্দ পরিবেশ তাই তিনি ক্লাসরূমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থার পরিবর্তে বৃক্ষতলে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন গাছপালার প্রাকৃতিক পরিবেশ, পাখীর কলতান, খোলামেলা পরিবেশই ছিল তাঁর পছন্দ প্রকৃতিকে ইট, কাঠ দিয়ে একেবারে বেঁধে ফেলা নয়, খোলামেলা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা তিনি চাইতেন নিরাপত্তার জন্যে ঘরবাড়ী তো চাইই, কিন্তু যতদূর সম্ভব প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্যে মহানগরী কলকাতার রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ থেকে বহুদূরে গিয়ে প্রকৃতির ঠিক কোলটিতে বসে তিনি উদ্দেশ্যসাধনে ব্রতী হয়েছিলেন
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শকে সমগ্র দেশের তথা বিশ্বের গুণীজন উচ্চপ্রশংসা করেছেন বিশ্বভারতীর আলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে
রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্বভারতীর আদর্শ যাতে ঠিক ঠিক ভাবে রক্ষিত হয়, যাতে অর্থাভাবে একে ধঁুকতে না হয় এই উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার এটির পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন
কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত, এর আর্থিক দায়িত্ব যথাযথভাবে বহন করা ও যাতে রবীন্দ্র আদর্শ অনুরাগী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ্গণ মিলে এই বিশ্বভারতীর আদর্শের প্রদীপকে সযত্নে জ্বালিয়ে রাখেন তার দিকে নিরপেক্ষভাবেই সতর্ক নজর রাখা বর্তমানের ক্ষমতার কাড়াকাড়ি ভিত্তিক কদর্য রাজনীতির বিষবাষ্প থেকে কবিগুরুর এই মহান প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করার দায়িত্ব সকল সরকার ও রবীন্দ্রানুরাগী বিদ্ব্যৎ সমাজ তথা জনগণের
কিন্তু বেশ কিছুদিন থেকে আমরা লক্ষ্য করছি আধুনিক জড়বাদ, ভোগবাদ তথা পঁুজিবাদ ও রাজনীতির ত্র্যহস্পর্শযোগে শান্তিনিকেতনে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে সম্প্রতি শান্তিনিকেতনের অন্তর্গত পৌষমেলার ময়দানকে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের প্রাচীর দিয়ে ঘেরার উদ্যোগকে কেন্দ্র করে ঘোর অশান্তি দেখা দিয়েছে জনসাধারণের বিশেষ করে যাঁরা প্রাচীর তুলতে বাধা দিয়েছেন, ভাঙাচুরও চালিয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য, এখানে বিশাল মেলা হয়, যা আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে এটি এখন সর্বমানবের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে একে কেন্দ্র করে বহু মানুষের কর্মসংস্থানও হয় তাছাড়া, এই ময়দানে বহু ছেলে-মেয়ে খেলাধুলা করে, আনন্দ করে এই খোলা মেলা মাঠকে কর্তৃপক্ষ প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলতে চাইছে এইভাবে কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের প্রবেশাধিকার হরণ করতে চাইছে রবীন্দ্রনাথের মুক্ত পরিবেশের আদর্শও কর্তৃপক্ষ নষ্ট করতে চাইছে বিস্তীর্ন ময়দানকে প্রাচীরবদ্ধ করে
কর্তৃপক্ষের ও চারপাশের জনগণের মধ্যে একটা বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে সেটা রবীন্দ্রনাথের কাম্য ছিল না অবশ্য বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষও এই ময়দানে অসামাজিক কাজের অভিযোগ তুলেছেন এ দায়িত্ব তো স্থানীয় প্রশাসনের রবীন্দ্রনাথের সাধনাস্থলে যাতে কোনোরকম অসামাজিক কাজকর্ম না হয় তা দেখা প্রশাসনের কর্তব্য
এ ব্যাপারে আমরা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সবার কাছে অনুরোধ করব, সবাই মিলে রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে রক্ষা করুন রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী দেশের গর্ব, আজকের বিপথগামী সভ্যতাকে যথার্থ-পথ প্রদর্শনের এক বাতিস্তম্ভ
দেশের রবীন্দ্রনুরাগী বিদ্বৎসমাজকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করব
তাছাড়া, কিছুদিন আগে এও খবর পাওয়া গিয়েছিল কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সুবাদে এখানে বাংলাভাষাকে অপাঙক্তেয় করার চেষ্টা হচ্ছিল এখন যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরপত্র বাংলাতে লেখার ব্যবস্থা রয়েছে, এটা বন্ধ করার চেষ্টা চলছিল শান্তিনিকেতনের অনেক সাইনবোর্ড থেকেও বাংলা হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে এটা যদি হয় তাহলে তা হবে অমার্জনীয় অপরাধ
যে বাংলাভাষায় রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার লাভ করে বাংলাকে বিশ্বসভার আসনে বসালেন, সেই বাংলার অপমান বাঙালীরা সহ্য করবে না আগেই বলেছি, বিশ্ব বিদ্যালয়ের আর্থিক দায়িত্ব কেন্দ্র গ্রহণ করেছে বলে, এখানকার শিক্ষাদর্শের ওপর কোপ দেওয়ার কোনো অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের নেই
সবশেষে আবার বলব, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মহান্ আদর্শ যাতে বিশ্বভারতীতে সুন্দরভাবে সুরক্ষিত থাকে, যাতে বিশ্বভারতীতে শান্তির পরিস্থিতি বজায় থাকে, তজ্জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যসরকারের প্রতিনিধি ও তৎসহ রবীন্দ্রানুরাগী বিদ্বৎসমাজের প্রতিনিধিরা একসঙ্গে বসে শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন শান্তিনিকেতনকে রাজনীতির কুস্তীর আখড়া বা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করবেন না
- Log in to post comments