সার্থক গণতন্ত্র আজও অ-ধরা

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলকে প্রতিহত করার চেষ্টা একটা রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে৷ কিন্তু সেই কৌশলে কোন হিংসার স্থান নেই৷ গণতন্ত্র সম্পর্কে প্রচলিত প্রবাদ হলো---‘‘জনগণের জন্যে, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন৷ সোজা কথায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন৷ তাই তাদের প্রধান দায়িত্ব জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষা করা ৷ তবে এই দায়িত্ব আজীবন নয়৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক শাশনব্যবস্থার ভিন্ন ভিন্ন রূপ আছে৷ তবে গণতন্ত্রের মৌলনীতি একটাই রাষ্ট্রের পরিচালকদের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতে হবে৷ ভারতবর্ষে প্রতি পাঁচবছর অন্তর রাষ্ট্র-পরিচালকদের জনগণের দ্বারে উপস্থিত হতে হয় নির্বাচিত হওয়ার জন্যে৷

এইখানেই জনগণের বিশেষ ভূমিকা আছে উপযুক্ত প্রার্থীকে নির্বাচিত করার৷ কিন্তু এর জন্যে যে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সচেতনতা দরকার -ভারতবর্ষে সত্তর শতাংশের বেশী মানুষের সেই সচেতনতা নেই৷ অবশ্য ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিভিন্ন রাজ্যে এই শতাংশের হারে কিছু হের-ফের আছে৷

ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় লজ্জা স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও দেশের জনগণের বৃহত্তম অংশ সামাজিক -অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বিষয়ে অজ্ঞ অসচেতন৷ তাই ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রাপ্ত বয়স্কদের বৃহদাংশ বোটাধিকার প্রয়োগের গুরুত্বই বোঝেন না৷ রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন-প্রার্থীদের  ভালমন্দ বিচার করার ক্ষমতাও নেই৷ জনগণের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই আদর্শহীন-জনস্বার্থ-বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্ষমতাসীন হয়৷

ভারতীয় গণতন্ত্রের এ-এক মারাত্মক ব্যধি৷ ভারতে বহু দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আরও একটি ত্রুটি কোন দল বা মোর্র্চ শতাংশের বেশী আসনে জয়ী হলেও বোটার সংখ্যায় পঞ্চাশ শতাংশের অনেক নীচে থাকে৷ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ শতাংশ বোট পেয়েও সরকার ঘটন করে৷ তাই আসন-ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার বলে ঘোষণা করলেও জনসমর্থনের ভিত্তিতে সেই সরকার সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের সরকার৷

ভারতীয় গণতন্ত্রের এই ত্রুটির ফাঁক দিয়েই অসৎ দুর্নীতিগ্রস্ত প্রবঞ্চক ধান্দাবাজরা রাজনৈতিক দলে আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতাসীন হতে চায়৷ এইসব দল ও নেতাদের হাতে কখনই জনস্বার্থ সুরক্ষিত হয় না৷ বরং আমলা, প্রশাসন-বিচারব্যবস্থা সর্বক্ষেত্রে দলীয় ও ব্যষ্টি আধিপত্য বিস্তার করে ব্যষ্টিস্বার্থ চরিতার্থ করতে নানা কৌশল অবলম্বন করে৷ এর জন্যে অগণতান্ত্রিক পথে  হিংসার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না৷ অজ্ঞ অসচেতন জনগণকে মিথ্যা ভাষণে প্রভাবিত করে অথবা ভয় দেখিয়ে হুমকি দিয়েও বোট আদায় করে নেয় ক্ষমতা লোলুপ নেতারা৷ এমন কি বিচার বিভাগকেও প্রভাবিত করে সাধারণ মানুষকে ও প্রবঞ্চিত ব্যষ্টিকে আইনসম্মত বিচার থেকে বঞ্চিত করে সোজা কথায় ক্ষমতাসীন থাকলে ব্যষ্টিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থরক্ষায় সবরকম অগণতান্ত্রিক পথ অবলম্বন করা যায় গণতন্ত্রের বেদীতে বসে৷ অর্র্থৎ আত্মত্যাগ  ও সার্বিক জনকল্যাণের আদর্শ ভারতীয় রাজনীতি থেকে উধাও৷ আর এসবের জন্যেই যেন-তেন প্রকারে ক্ষমতাসীন হওয়াই দলগুলির লক্ষ্য হয়৷ সেই কারণেই গণতন্ত্রের বেদীতে এত হিংসা এত রক্তপাত! তাই ভারতবর্ষ বিশ্বের বৃহৎতম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও সার্থক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আজও প্রতিষ্ঠিত হয় নি৷