স্বাধীনতার সত্তর বছরেও ভারত দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রভাবমুক্ত নয়

লেখক
স্নেহময় দত্ত

১৯৪৭ থেকে ২০১৭---পার হল সত্তরটা বছর৷ বৈদেশিক শাসন থেকে মুক্ত সত্তর বছরের স্বাধীন ভারত৷ বহুত্যাগ, তিতিক্ষা, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে এসেছে স্বাধীনতা৷ এই স্বাধীনতায় রয়েছে অজস্র অত্যাচারের মর্মান্তিক বেদনা--- বহুবীরত্ব গাথা৷ বীরের রক্তস্রোতে, মাতার অশ্রুধারায় সিক্ত এই স্বাধীনতা৷ সংগ্রামের দীর্ঘ পথে রয়েছে দেশমাতৃকার চরণে, স্বাধীনতার বেদীমূলে অনেক অনেক  উৎসর্গীকৃত প্রাণের আহুতি--- ফাঁসির মঞ্চে  বলিদান৷ এই যে আহুতি, বলিদান, সংগ্রাম, তা কিন্তু এই খন্ডিত ভারতের জন্যে নয়৷ ছিল অখন্ড ভারতবর্ষের জন্যে৷ কিন্তু দু:খের বিষয় ভারতবর্ষের মানুষ পেল না অখন্ড দেশ, পেল খন্ডিত ভারত৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের  মহান যোদ্ধা নেতাজী সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে মরণপণ মুক্তি সংগ্রামের ফলে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশশক্তি যখন বুঝতে পারল ভারতবর্ষে তাদের শাসনের ভিত নড়ে উঠেছে, তখন তারা তৎকালীন দক্ষিণপন্থী আপোষকামী নেতাদের সঙ্গে স্বাধীনতার বিষয়ে আলাপ আলোচনার শুরু করে দিল৷ ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে বাধ্য হলেও তাদের বিভাজন নীতির কৌশলে অটল ছিল৷ হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ও বিভাজন যা তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের একেবারে গোড়াতেই সৃষ্টি করে ছিল যা স্বাধীনতার প্রাক্কালে চরমতম পর্র্যয়ে উন্নীত করতে  অর্র্থৎ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ দিতে চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছিল৷ ফলে ভারতবর্ষের খন্ডিতকরণও  চূড়ান্ত পর্র্যতেই এসে গিয়েছিল , সাম্রাজ্যবাদী কৌশল,  উভয় সম্প্রদায়ভুক্ত দেশীয় পঁুজিবাদীচক্র  ও তাদের প্রতিভূ দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের অদূরদর্শিতা এবং সর্র্বেপরি ক্ষমতা করায়ত্ত করার মোহে সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্বের  ভিত্তিতে ভারতবর্ষ খন্ডিত হল ৷ দক্ষিণপন্থী কংগ্রেস শক্তি খন্ডিত স্বাধীন ভারতের মসনদে আসীন হল জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে৷

বৈদেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভ ঘটেছে ঠিকই কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেনি৷ দেশের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণভার পঁুজিপতিদের হাতেই৷ ফলে শোষণ নিপীড়ণ-নির্র্যতনের শিকার সাধারণ মানুষ৷ রাজনৈতিক নেতারা যতই বৈপ্লবিক বুলি আওড়ান না কেন, পঁুজিপতিদের স্বার্থ সুরক্ষিত না করে তাঁদের উপায় নেই৷

সাধারণ-মানুষ বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হলেও স্বাধীনতার সত্তর বছরে অনেক ক্ষেত্রেই যে দেশের অগ্রগতি হয়েছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না৷

শিক্ষার ‘অভাব’ ভারতে ছিল যথেষ্টভাবেই৷ শিক্ষার আলো সর্বস্তরে  না পৌঁছালেও স্বাধীনতার পর শিক্ষাক্ষেত্রে গতি এসেছে৷ বাড়ছে শিক্ষিতের হার৷ পাশ্চাত্য ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে ‘মানুষ’ আজ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে৷ সর্র্বংশে না হলেও  নারীরাও অনেকাংশে শিক্ষার আলোয় এসেছে৷ পুরুষদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিচ্ছে নারীরাও৷ শিক্ষার আলোকে আলোকিত হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই   নারীরা শুধু যে স্বনির্ভর তাই নয়, সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই তারা সুপ্রতিষ্ঠিত --- আপন মহিমায় ভাস্বর৷ শিক্ষায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব তথা আধুনিকতার  স্পর্শ ভারতকে অনেক এগিয়ে নিয়ে চলেছে৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভারতের প্রভূত উন্নতি ঘটেছে৷ বিজ্ঞানের কল্যাণে শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প, পরিবহণ, প্রতিরক্ষা সর্বক্ষেত্রেই এসেছে গতি৷ সামরিক শক্তিতে বর্তমান ভারত সমীহ পাবার মত  জায়গাতেই রয়েছে৷ মহাকাশ গবেষণায়  মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে ও ভারতের স্থান বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলির মধ্যেই৷ আবার ডিজিটালাইজেসনের পথে ও  ক্রমশই: এগিয়ে চলেছে  উন্নতির শিখরে প্রাচুর্যও রয়েছে এক শ্রেণীর মানুষের আর সেই প্রাচুর্যতাও ক্রম:বর্দ্ধমান৷ অপরদিকে তেমনি অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক হল  বহু মানুষের কোনরকম কর্মসংস্থান  নেই --- দারিদ্রতা চরমে৷ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এই নূন্যতম প্রয়োজন পূর্ত্তির  কোনরকম গ্যারান্টি সরকার দিতে পারেনি সর্বশ্রেণীর মানুষকে৷ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে রয়েছে চরম বঞ্চনা৷ অর্র্থৎ অর্থনীতির সুষম বিকাশ তথা বন্টন কোনরকমভাবেই  হয়নি৷

স্বাধীনতার সত্তর বছরে এসে আরেকটি বিষয়ের ওপর আলোচনা অত্যন্ত জরুরী৷ স্বাধীনতার জন্মলগ্ণ থেকেই যে কথাটা মানুষ শুনতে অভ্যস্ত তা হল জাতীয় সংহতি ও সেই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা৷ কিন্তু বাস্তবের মাটিতে তা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে?  বহু বর্ণ বহুভাষাভাষী, বহু জাতি উপজাতির দেশ ভারতে সংহতি কতটা গড়ে উঠেছে? 

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতে খন্ডিত করে স্বাধীনতার প্রাপ্তি৷ কিন্তু খন্ডিত ভারত থেকে কী দ্বিজাতিতত্ব অপসারিত হয়েছে? ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে কী দ্বিজাতিতত্ব প্রবলভাবে দেশকে নাড়া দিচ্ছেনা? এ প্রশ্ণগুলি আজ মানুষকে প্রবলভাবেই ভাবিয়ে তুলেছে বলেই মনে হয়৷

কেন এরকম সংশয়? ভারতের রাজনীতি যে পথ ধরে চলে আসছে তা থেকে এরকম সংশয়ের সৃষ্টি৷ রাজনীতির যাঁরা চালিকা শক্তি, যাঁরা সংহতির জন্যে গলা ফাটান, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে থাকেন, সেইসব নেতারাই কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তার বিপরীতধর্মী-পথে চলে থাকেন৷ বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গী তথা বিভাজন নীতিই ডান-বাম অথবা তথাকথিত প্রগতিশীল সব রাজনৈতিক দলের তথা নেতাদের রাজনীতির হাতিয়ার, নির্র্বচনী বৈতরণীপার হতে বিশ্লেষণাত্মক পথকেই তাঁরা বেছে নেন৷ বহুভাষাভাষী, বহুজাতি-উপজাতিতে বিভক্ত ভারতে নির্র্বচন হয়ে থাকে এই জাতপাত ভিত্তিক সেন্টিমেন্টে৷ যেখানে যে জাতির বা উপজাতির গরিষ্ঠতা সেখানে সব দলই সেভাবেই প্রার্থী মনোনয়ণ করে থাকে৷  উচ্চবর্ণের মানুষের থেকে দলিত শ্রেণীর আধিক্য থাকায় তাদের কাছে টানতে নানা কৌশল অবলম্বন করে থাকে সব রাজনৈতিক দল৷ যার জ্বলন্ত প্রমাণ দেশের সর্র্বেচ্চ সাংবিধানিক পদের নির্র্বচন৷

উচ্চবর্ণের দল বলে পরিচিত কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল বিজেপি ওই তকমা মুছে ফেলতে ও দলিত শ্রেণীর প্রার্থী ঠিক করল৷ বিরোধীগোষ্ঠী ও মনোনীত করল দলিত প্রার্থী এই আশঙ্কায় যে তা না হলে মানুষের কাছে যদি ভুল বার্র্ত পৌঁছায় ও পরবর্তী বিভিন্ন নির্র্বচনে যদি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়! এই ধরণের রাজনীতি বিশ্লেষনাত্মক তথা বিভাজনমূলক ছাড়া কিছু নয়৷ সব রাজনৈতিক দলই এই ধরণের ভাবধারা নিয়েই রাজনীতি করছে৷

স্বাধীনতার সত্তর বছর ধরে বিভিন্ন সময়  যারা শাসন ক্ষমতায় সেই শাসকশ্রেণী কিন্তু সমগ্র জাতির উন্নতিকল্পে কাজ করেনি৷ যারা দলিত শ্রেণী বা পিছিয়ে থাকা বিভিন্ন জাত,যাদের মধ্যে শিক্ষার আলো সেভাবে পৌঁছয় নি, আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে  যারা অনুন্নত  তাদের  আর্র্থিক বৈষম্য ও সামজিক বৈষম্য দূর করা বা শিক্ষার আলোয় তাদেরকে নিয়ে আসার পরিবর্তে তাদের নিয়েই করা হয়েছে রাজনীতি৷ প্রকৃত উন্নতি বিধান না করে নির্র্বচনের আসন সংরক্ষণ, চাকুরী ক্ষেত্রে  সংরক্ষণের চিন্তাধারা নিয়েই  চলেছে৷  তাতে না হয়েছে পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নতিবিধান না লাভবান হয়েছে দেশ৷ এই ধরণের সংরক্ষণ নীতি বরং সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্বেষ-বিভাজনই বাড়িয়ে তুলেছে৷ কারণ তথাকথিত উচ্চবর্ণের মধ্যে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া অনেকেই রয়েছে পিছরে বর্গের জন্যে সংরক্ষণ নীতিতে তারা বঞ্চনার শিকার হচ্ছে৷

 দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে খন্ডিকরণের কারণে খুব সঙ্গত ভাবেই একশ্রেণী এখানে সংখ্যালঘিষ্ঠ৷ কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয় সংহতির কথা বলেও সেই সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশের প্রতি বিশেষ ব্যবস্থাদির নীতি ধর্মের নিরপেক্ষতায় ও জাতীয় সংহতির মূলেই  কী আঘাত নয়? ওই বিশেষ সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘিষ্ঠ তক্মা দিয়ে তাদের জন্যে বিশেষ সুবিধা, অধিকার, বিশেষ আইনি ব্যবস্থার সংস্থান রাখাটা খুব বাস্তবোচিত হয়েছে বলে মনে হয় না৷ এটাকে এক ধরণের তোষণ ছাড়া অন্যকিছুই বলা চলে না৷ এর ফলে তাদেরকে দেশের মূলস্রোত থেকে পৃথক করে রাখা হয়েছে৷ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এক পক্ষকে তুষ্ট করতে গিয়ে আর এক পক্ষের মধ্যে অসন্তোষের বীজ বপন করা হয়েছে৷ ফলে স্পষ্ট হয়েছে বিভাজন--- সৃষ্ট হয়েছে হিংসা-দ্বেষ-সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ৷ স্বাধীনতার  ঊষা লগ্ণ থেকে তৎকালীণ সরকার তথা শাসক দল কংগ্রেস এই তোষণনীতি চালিয়ে এসেছে৷ তথাকথিত প্রগতিশীল তক্মাধারী রাজনৈতিক দলগুলি ও দক্ষিণ পন্থী আঞ্চলিক দলগুলিও এই ক্ষেত্রে ওই একই নীতির ধারক৷ এর বিষময় ফল মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে যেমন উত্তর ভারতে, তেমনি পশ্চিমভারতে৷ অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বাদুড়িয়া, বসিরহাটেও  সৃষ্টি হয়েছিল উত্তেজনাকর পরিস্থিতি৷

আবার বর্তমানে কিছু উগ্রবাদী হিন্দু সংঘটনের কার্যকলাপ এমনই,যেমন গোরক্ষা একটি, তাতে ও  বিদ্বেষ-বিভাজনের বাতাবরণ সৃষ্টি হচ্ছে৷ এক্ষেত্রে কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদল বিজেপি ‘যারা সবকা সাথ সবকা বিকাশের’ কথা বলছে, তাদের ভূমিকাও তর্র্কতীত নয়৷

আর কশ্মীরের কথাতো বলার অপেক্ষাই রাখে না৷ কশ্মীরের ভারতভূক্তির ঊষালগ্ণ থেকেই সেখানে  বিশেষ অধিকার , সুযোগ-সুবিধা দিয়েও সেখানকার মানুষদের যে কতটা ভারতের মূল জাতীয় স্রোতভুক্ত করা গেছে সেকথা কশ্মীরবাসীই ঠিকমত বলতে পারেন! কেননা কশ্মীরের নিরবচ্ছিন্ন ঘটনাবলী, মৌলবাদী ও উগ্রপন্থীদের ভারত বিরোধী জেহাদ, যার পিছনে পাকমদত অত্যন্ত সুস্পষ্ট, অন্য কথাই বলে৷ কশ্মীরের বিভিন্ন আঞ্চলিক দল, তা তারা যে কোন সর্বভারতীয় দলেরই হাত ধরে থাকুুক না কেন, তাদের ভূমিকাও একেবারে গোড়া থেকেই সন্দেহের ঊধের্ব নয়৷ যেমন উল্লেখ করা চলে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মেহেবুবা মুফতি,  যাঁর দল কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল বিজেপি-র জোটসঙ্গী, খোদ দিল্লিতে এসে এক অনুষ্ঠানে সংবিধানের ৩৫ এ ধারার পক্ষে সওয়াল করে  বলেন যে কশ্মীরে বিশেষ অধিকার লঙ্ঘিত হলে সেখানে জাতীয় পতাকা ধরার কেউ থাকবে না বলে তিনি নিশ্চিত৷ কশ্মীর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেখানে এ ধরণের কথা জোরের সঙ্গে বলতে পারেন সেক্ষেত্রে মৌলবাদী ও বিচ্ছিন্নতাকামীদের কথা আর কিই বা হতে পারে! পাক সংলগ্ণ কশ্মীরে যে ধরণের জঙ্গিপণা শুরু হয়েছে তাতে ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা যে চরম বিপদের মুখে তাতে কী সন্দেহের কোন অবকাশ থাকতে পারে৷

শুধু কশ্মীর কেন, স্বাধীনতার সত্তর বছরে ভারতের আর এক প্রান্ত পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়েও সৃষ্টি হয়েছে এক অগ্ণিগর্ভ পরিস্থিতির , যাকে কশ্মীরের থেকে কোন অংশেই কম বলা চলে না৷ আর তার কারণও রাজনৈতিক দলগুলির নির্র্বচনী নীতি,,তোষণের রাজনীতি৷ পাহাড়ীয়া দার্জিলিঙ পশ্চিবঙ্গেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ সেই দার্জিলিঙকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবীতে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে তুলেছে বহিরাগত গোর্র্খরা৷ দার্জিলিংয়ের মূল অধিবাসী পাহাড়ি লেপচা, ভূটিয়া ও বাঙালীরা সেখানে পরবাসী হয়ে গেছে৷ আর এক সময়ে নেপাল থেকে রুজিরোজগারের জন্য আগত গোর্র্খরা আজ দার্জিলিংকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের পৃথক রাজ্য করতে চাইছে৷ অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি পরবর্তীকালে সিপিএম, কংগ্রেস সবদলই বহিরাগত ওই গোর্র্খদের নিয়ে রাজনীতি করে এসেছে, তাদের স্বার্থের কথাই চিন্তা করে এসেছে৷ লেপচা, ভুটিয়া বা পাহাড়ি বাঙালীদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেনি৷ বর্তমানে কেন্দ্রের  শাসক দল বিজেপিও ওই গোর্র্খদের নিয়ে বিশেষ করে যে দল গোর্র্খল্যান্ডের দাবীতে  অশান্তি করে চলেছে তাদের হাত ধরেই দু’দুবার দার্জিলিং কেন্দ্রের বৈতরণী পার হয়েছে, যদিও বিজেপি-র কোন সংঘটনই নেই পাহাড়ে৷ দার্জিলিংয়ের পরিস্থিতিতে কেবল পশ্চিমবঙ্গই যে বিপন্ন তা কিন্তু নয়, বিপন্ন ভারতের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব৷ কারণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন, যার সঙ্গে বর্তমানে ভারতের বিরোধ চরম পর্যায়ে, দার্জিলিং থেকে খুব দূরে নয়৷

আগেই উল্লেখ করেছি, দেশের সার্বিক কল্যাণ তথা বিকাশ সাধনের পরিবর্তে বিশ্লেষণাত্মক তথা বিভাজনের পথেই কংগ্রেস সহ সকল গান্ধীবাদী দলের, মার্কসবাদী ও তথাকথিত সমাজবাদী দলসমূহের এবং বর্তমান কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি রাজনৈতিক অবস্থান ও নির্র্বচনী বৈতরণী পার হওয়ার নীতি, সেই কারণে স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও ভারতে সাম্প্রদায়িক সুস্থিতি আসেনি--- সৃষ্ট হয়নি একজাতি, একপ্রাণ ভারতবাসী সেন্টিমেন্ট তথা মানসিকতা৷ কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষই নয়, একই হিন্দুধর্মের  অনুসারী বিভিন্ন জাতির মধ্যে ও উপজাতির মধ্যে কোথাও কোথাও ক্ষোভ-বিক্ষোভ যথেষ্ট তুঙ্গে৷ এককথায় ভারতের  অভ্যন্তরীণ অবস্থা যথেষ্ট উদ্বেগজনক!

স্বাধীনতার পর থেকে কোন সরকার, কোন রাজনৈতিক দল বৈষম্য ও বিভেদমূলক চিন্তাধারা দূরে সরিয়ে সংশ্লেষনাত্মক মনোভাব বা ঐক্যসূত্র ধরে ভারতকে একসূত্রে  গাঁথার তথা এক জাতি সত্তার উন্মেষ ঘটাতে সচেষ্ট হয়নি৷  দেশের উন্নয়ন তথা একতার জন্য ঐক্যসূত্রে যে প্রাথমিক ও অন্যতম প্রধান শর্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক  ক্ষেত্রের  শোষণ দূরীকরণ, বিকাশসাধন সে দিকে কোন প্রকার গুরত্ব দেওয়া হয়নি৷ সে দিকে গুরুত্ব দিলে আজকে যে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা হয়তো প্রশমিত হতে পারত!

যে দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে দ্বিখন্ডিত করা হল, অত্যন্ত দু:খের ও উদ্বেগের বিষয় স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও খন্ডিত  ভারতকে সেই দ্বিজাতিতত্ব প্রবলভাবে নাড়া দিচ্ছে৷  আর দ্বিজাতি বলতে কেবল হিন্দু-মুসলিম সমস্যাই নয়, সেই সঙ্গে বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্নজাতি , উপজাতির মানুষও ক্রমশঃই মূল স্রোত থেকে  বিচ্ছিন্ন হওয়ার মানসিকতা নিয়ে আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য চাইছে৷

এমনটা হওয়া উচিত নয়,তথা ছিল না৷ যাঁদের ত্যাগ , সংগ্রাম, প্রাণ বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা এসেছে, তাঁরা এমন স্বাধীনতা চান নি৷ তাঁরা  চেয়েছিলেন অখন্ড ভারত--- মানবতার মুক্তি সার্বিক বিকাশ সাধন৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান যোদ্ধা সুভাষচন্দ্র বসুর কথাতেই বলি, ‘‘মনুষ্য জীবন আমাদের নিকট একটা অখন্ড সত্য৷  সুতরাং যে স্বাধীনতা আমরা চাই--- সে স্বাধীনতা ব্যতীত জীবনধারণই একটা বিড়ম্বনা--- যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগে যুগে আমরা হাসিতে হাসিতে রক্তদান করিয়াছি--- সে স্বাধীনতা সর্বতোমুখী! জীবনের সকলক্ষেত্রে, সকলদিকে আমরা মুক্তির বাণী প্রচার করিবার জন্য আসিয়াছি৷ কি সমাজনীতি, কি অর্থনীতি, কি রাষ্ট্রনীতি, কি ধর্মনীতি--- ‘‘জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমরা সত্যের আলোক, আনন্দের উচ্ছ্বাস ও উদারতার মৌলিক ভিত্তি লইয়া আসিতে চাই৷ ’’

বহুভাষাভাষী, নানাবর্ণ-সম্প্রদায়, বিভিন্ন জাতি-উপজাতিভুক্ত ভারতে যে অনৈক্য, বিবাদ-বিসম্বাদ তা দূর করতে ‘প্রাউট’ দর্শনের প্রবক্তা শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকারের কয়েকটি কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, ‘‘বিভিন্ন কারণে , যে বিভেদ, যে মনোমালিন্য আজ সমাজে বিদ্যমান, মানুষের সমষ্টিগত কল্যাণের তাগিদে সে বিভেদকে দূর করতে হবে---এ কার্য সাধন করতে হলে জনগোষ্ঠীর জীবনধারার বহুমুখীতার মধ্যে, বিভিন্নতার মধ্যে খঁুজে বের করতে হবে  কমন পয়েন্টগুলোকে--- সেগুলোকে উৎসাহ দিতে হবে আমাদের৷ আর যেখানে যেখানে বিভেদ রয়েছে পয়েন্ট অফ ডিফারেন্স রয়েছে সেগুলোকে কোনদিন উৎসাহ দেওয়া উচিত হবে না৷ ....‘Points of unity should be encouraged and points of differences should be discouraged .’’

দেশকে যাঁরা ভালবাসেন, দেশের ঐক্য, অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন থাকুক এটাই যাঁদের কাম্য, যাঁরা দেশের সার্বিক মুক্তি তথা মানবতার বিকাশ সাধনে আগ্রহী, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সেই সব মানুষেরা এগিয়ে আসুন--- বিভাজন নীতির বিরুদ্ধে, সর্বপ্রকার মৌলবাদী ভাবধারার  বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলুন৷