ভক্তের সম্পর্কে, সাধকের সম্পর্কে, পরমপুরুষের প্রতি যার প্রেম রয়েছে তার সম্পর্কে ভগবান কৃষ্ণের কিছু মূল্যবান উক্তি রয়েছে৷ এ সম্বন্ধে আজ আমি কিছু বলব৷
ভগবান বলছেন,
‘‘শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ
পরধর্মাৎ স্বানুষ্ঠিতাৎ৷
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ
পরধর্মো ভয়াবহঃ৷৷’’
স্বধর্ম হচ্ছে সব থেকে মূল্যবান বস্তু৷ যদি পরধর্মের অনুশীলন করতে খুব ভালও লাগে, পরধর্মের অনুশীলন যদি সহজও হয়, তাহলেও মানুষের উচিত স্বধর্মের অনুশীলনে দৃঢ় নিষ্ঠা রাখা৷ এখন, এই স্বধর্ম কী? প্রতিটি বস্তুর নিজ নিজ ধর্ম– সত্তাগত বৈশিষ্ট্য আছে৷ অক্সিজেনের একটা সত্তাগত বৈশিষ্ট্য বা হ্মব্জপ্সহ্মন্দ্বব্জব্ আছে, নাইট্রোজেনের একটা সত্তাগত বৈশিষ্ট্য আছে৷ আর এই সত্তাগত বৈশিষ্ট্যই বস্তুর পরিচিতি বহন করে৷ দুধের রঙ যদি শাদা না হয়, তাহলে মানুষ তাকে দুধ বলে মানবে না৷ জলে যদি তৃষ্ণা নিবারণের ক্ষমতা না থাকে, তাকে জল বলে কেউ মানবে না৷ অগ্ণিতে যদি দাহিকাশক্তি না থাকে, তাহলে কেউ তাকে অগ্ণি বলবে না৷ বস্তুর পরিচিতি তার ধর্মেই৷
ঠিক এইভাবে মানুষেরও স্বধর্ম আছে৷ এই স্বধর্মের জন্যে অন্য জীব থেকে সে পৃথক৷ অক্সিজেন নিজের স্বধর্মের জন্যে নাইট্রোজেন বা হাইড্রোজেন থেকে পৃথক৷ ঠিক এমনিভাবে মানুষও জীব, কুকুর–ছাগল–মুরগী জীব কিন্তু জীব হলেও মানুষের একটা বিশেষত্ব আছে, তা হ’ল মানবধর্ম৷ এটাই মানুষের জন্যে স্বধর্ম৷ আর মানুষের স্বধর্ম কী? পরমপুরুষকে পাওয়ার জন্যে সচেষ্ট হওয়া৷ পশুজীবন জড়াত্মক৷ খাওয়া ও মরা–এটাই হ’ল পশুধর্ম৷ মানুষের ক্ষেত্রে তা নয়, মানুষের জীবনটা পশুর মত নয়৷ পশুর ক্ষেত্রে খাওয়াটা মুখ্য ক্রিয়া৷ বিড়ালকে লাথি মার, পাঁচ মিনিট পরে আবার মাছ খাওয়ার জন্যে আসবে৷ কেননা, বিড়ালের জীবনে খাওয়াটাই মুখ্য কাজ৷ খাওয়া, মরণকে বরণ করা ও জীবনধারণ করা– মনুষ্যেতর জীবের এইটাই মুখ্য ক্রিয়া৷ আর মানুষের মুখ্য জীবনবৃত্তি হচ্ছে পরমপুরষের উপাসনা করা, পরমপুরুষকে ভালবাসা৷ মানুষের শরীর, মন ও আত্মা আছে৷ সাধনা করতে গেলে তাকে বেঁচে থাকতে হবে৷ বেঁচে থাকার জন্যে, অন্ন–বস্ত্রাদির প্রাপ্তির জন্যে তাকে প্রচেষ্টা চালাতে হবে৷ কিন্তু এটা মুখ্য কাজ নয়৷ যাতে সে সাধনা করতে পারে, তার জন্যেই অন্ন–বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে হবে৷ এই কারণে অন্ন–বস্ত্রাদি মানুষের জন্যে মুখ্য নয়৷ আর এই কথাটাই যখন মানুষ ভুলে যায়, তখনই তার পতন হয়, তার অধোগতি হয়ে যায়৷ সে পরধর্মে চলে যায়, মানব ধর্মে আর থাকে না৷ মানুষের এই যে স্বধর্ম তা–ই হ’ল ভাগবত ধর্ম, তাই হ’ল মানবধর্ম৷ এখানে ধর্ম মানে রেলিজিন (religion) নয়৷ ধর্ম মানে ‘প্রপার্টি’–সত্তাগত বৈশিষ্ট্য, ধর্ম মানে স্বভাব৷
ভগবান কৃষ্ণ বলছেন, ‘স্বধর্ম পালনে যদি কষ্টও হয়, এমনকি মরণও হয়, তাহলেও স্বধর্মে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা উচিত৷’ স্বধর্মের জন্যে মৃত্যু হয় তো হোক, তাতে কিছু
যায় আসে না৷ কিন্তু মনুষ্যত্ব থেকে আমরা দূরে সরে যাব না, মানবধর্ম থেকে দূরে সরে যাব না৷
‘‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পরধর্মো ভয়াবহঃ৷’’
এমনকি স্বধর্মে থেকে যদি মৃতুও হয়, হোক, মানুষ রূপেই মৃত্যু হোক, পশুরূপে নয়৷ পাপের সঙ্গে আপোষ করে মরব না৷ তাই, মনে রাখবে, যে ভক্ত, যে সাধক, যে পরমপুরুষকে ভালবাসে, সে কখনও পাপের সঙ্গে আপোষ করবে না৷ সে ষোল আনা আদর্শে দৃঢ় থাকবে৷পনেরো আনা আদর্শে দৃঢ় থাকলুম, এক আনা পাপের সঙ্গে আপোষ করলুম, তা চলবে না৷ তাই কোনদিন এধরনের কাজ করবে না৷
‘পরধর্মো ভয়াবহ’ ঃ –যা পশুর ধর্ম, যা ভাগবত ধর্ম নয়, মানব ধর্ম নয়, তা ভয়াবহ কেন? কারণ এর ফলে নিজের অধোগতি তো হয়ই, অসৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্যে অন্য মানুষের ক্ষতি হয়৷ এটা কু–দৃষ্টান্ত৷ মানবধর্ম থেকে বিচ্যুত হওয়া, কেবল পাতকের কাজ নয়, মহাপাতকের কাজ৷ কারণ এর দ্বারা অন্যান্য মানুষও কু–কর্ম শিখবে৷ কু–ভ্যাস শিখবে৷
সমস্ত বস্তু নিজের গতিতে চলে, চলতে চলতে কালের প্রভাবে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফলে তার গতির দ্রুতি ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে৷ The speed is slowly retarded, এই অবস্থায় তাতে আবার দ্রুতি আনবার জন্যে, acceleration আনবার জন্যে, শক্তি সম্প্রয়োগ দরকার৷ শক্তি সম্প্রয়োগ না করলে কাজ হবে না৷ হতে পারে শক্তি সম্প্রয়োগ করলে তার সাময়িক কষ্ট হবে, সাময়িক কালের জন্যে অন্যে ভুল ৰোঝাবে, তবুও তা করতে হবে৷ যখন মানুষ দেখবে সমাজের গতিতে দ্রুতি নেই, তখন দ্রুতি আনবার জন্যে যারা শক্তি সম্প্রয়োগ করবে, তারাই হল সদ্বিপ্র৷ তারা সমাজের বরেণ্য, পূজনীয়, সমাজের পথপ্রদর্শক৷ আর সদ্বিপ্রদের প্রেরণা দেওয়ার জন্যে, অনেক যুগের পরে, যখন দেখা যায়, সদ্বিপ্রদের গতিও হ্রাস পেয়ে গেছে তখন সদ্বিপ্রদের মজবুত করে গড়ে তোলবার জন্যে পরমপুরুষকে নিজেকে আসতে হয়৷
এইজন্যে ভগবান বলেছেন,
‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজাম্যহম্৷৷’’
যখন ধর্মের গ্লানি আসে, গতি রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন সমাজে গতি আনবার জন্যে, গতিতে দ্রুতি আনবার জন্যে পরমপুরুষকে তারক ব্রাহ্মরূপে অবতীর্ণ হতে হয়৷