মানব সভ্যতার ঊষালগ্ণ থেকে মানুষ বলে আসছে আর তাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে বলছে যে যদি তুমি এটা করো তবে স্বর্গ পাবে আর যদি না করো তবে নরকে যাবে৷ একটা হ’ল স্বর্গ বা বেহেস্ত (Heaven), অপরটা হ’ল নরক বা দোজখ্ (Hell)৷ এ বিষয়ে কত রঙ-বে-রঙের চিত্র দেখিয়ে সাধারণ বিশ্বাসপ্রবণ মানুষকে ৰোঝানো হয় যে নরকবাসীদের কী দুঃসহ যাতনায় না ভুগতে হয়৷ আর যারা কর্মগুণে স্বর্গে যায় তারা কী অপূর্ব আনন্দে না দিন কাটায়৷ তারা সোণার পালঙ্কে শোয়, রুপোর পালঙ্কে পা বিছিয়ে আরাম করে আর শুয়ে শুয়ে তারা চর্ব-চূষ্য-লেহ্য-পে ভোগ করে৷ গত কয়েক হাজার বছর ধরে এই ধরনের বহুতর গাল-গল্প চলে আসছে, এই ধরনের ডগমা বা ভাবজড়তা শাখা প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে গণমানসে সঞ্চারিত হচ্ছে৷ এসবের পেছনে মূল মতলবটা হ’ল যে মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে সৎ পথে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অথবা তার ভীতম্মন্যতার সুযোগ নিয়ে তাকে ভালোভাবে শোষণ করা৷
এখন দেখা যাক, এই যে স্বর্গ-নরক সম্পর্কিত কাহিনীর দার্শনিক দৃষ্টিকোণগুলো আদৌ গ্রহণযোগ্য কিনা অথবা এগুলি নিতান্তই ৰৌদ্ধিকতা বর্জিত ভাবজড়তা বা ডগ্মা কিনা৷ এখন প্রশ্ণ হ’ল, সুখ ভোগটা করে কে? -- না, ভোগটা করে মন, শরীর নয়৷ আবার তেমনি দুঃখ ভোগটাও করে মন৷ কর্মের কর্তা হ’ল মন৷ শরীরের মাধ্যমে মনই কাজ করে৷ আবার কর্ম-ফল ভোগাটা হ’ল মানুষের মন৷ মন হয় শরীরের মাধ্যমে ভোগটা করে নয়তো মনের দ্বারা সরাসরি ভোগ করে৷ শারীরিক কষ্ট হলে সেই কষ্টটা শরীরের মাধ্যমে ভোগ করে মন৷ আবার কখনও কখনও এমন হয় যে কারো বিশেষ পরিচিত ব্যষ্টির মৃত্যু হলে সেই মৃত্যুজনিত দুঃখ মনই প্রত্যক্ষ রূপে ভোগ করে৷ এতে কোন শারীরিক মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা নেই৷ মৃত্যুর পর মানুষের মন আর মস্তিষ্ক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ স্নায়ুকোষের অভাবের ফলে মন ৰীজাকারে থেকে যায়, কর্ম করতে পারে না৷ কেন না স্নায়ুকোষ না থাকলে তার ভৌতিক স্পন্দনের সাহায্য মিলছে না৷ যদি মস্তিষ্ক বা স্নায়ুকোষ না থাকে তা হলে মন সুখভোগ বা দুঃখ ভোগ করবে কেমন করে? সুখ ভোগ বা দুঃখ ভোগের অনুভূতি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের মাধ্যমে গৃহীত হয়৷ যেমন ভুত৷ সংস্কৃত ভাষায় ভুত কে বলা হয় প্রেত৷ মস্তিষ্কের অভাবে প্রেত সুখ ভোগ বা দুঃখভোগ করতে পারে না৷ কারণ মৃত্যুর পর তার তো আর শরীর থাকে না৷ আর মনের সাথে চৈত্তিক ধাতুর কোন সম্পর্ক থাকে না৷ এই অবস্থায় মনও কাজ করতে পারে না৷ কেন না তার শরীর তো আর নেই৷ এই অবস্থায় ভুতও থাকতে পারে না, প্রেতও থাকতে পারে না৷ তাই ভুত-প্রেত বলে কিছু নেই৷ বিদেহী মনের দ্বারা কর্ম ফল ভোগ একেবারে অসম্ভব৷ সম্ভব নয়, এমন কি কোন কিছু করাও সম্ভব নয়৷ যতক্ষণ মন ও মস্তিষ্ক এক যোগে কাজ করে ততক্ষণই কোন কাজ করা সম্ভব বা কর্মভোগ করা সম্ভব৷ অতএব ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই যে মৃত্যুর পর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মন কোন কিছু করতে পারে না৷
এই পৃথিবীতে মানুষ সৎকর্ম বা অসৎকর্ম যাই করুক না কেন তার ফলভোগ তৎক্ষণাৎও হতে পারে, এই জীবনেও হতে পারে আবার পর জীবনেও হতে পারে৷ যদি কারুর মৃত্যু হয়ে গেল আর তার পুনর্জন্ম হ’ল না এই অন্তর্বর্তী সময়টায় কর্মফল ভোগ সম্ভব নয়৷ যেমন, যে লোকটার জিব নেই সে যেমন কিছুই খেতে পারে না তেমনি তার দ্বারা ফলভোগও সম্ভব নয়৷ যেমন ধর, কারুর মৃত্যু হয়ে গেল৷ জীবিত কালে যে খাবারটা সে খেত সেটা খেত তার শরীর৷ চিকিৎসা হ’ত তার শরীরটারই৷ এইজন্যে মানুষ যতদিন জীবিত আছে ততদিন তার ঠিক ঠিক উপযুক্ত খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত৷ মৃত্যু হয়ে গেলে আর এ সব করার অবকাশ নেই৷ সেই অবস্থায় তুমি একটা কাজই করতে পার৷ পরমপুরুষকে বলতে পার যে যতদিন এই মানুষটা আমাদের সাথে ছিল ততদিন যতদূর সম্ভব আমরা তার সেবা-শুশ্রুষা করেছি৷ এখন সে আর আমাদের মধ্যে নেই৷ তাই হে পরমপুরুষ, সেই তুমি মানুষটাকে দেখাশুনা করো৷ আনন্দমার্গে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বিধি এই দৃষ্টিকোণ থেকেই রচিত হয়েছে৷
এই ব্যক্ত জগৎ সপ্তলোক তথা পঞ্চকোষে বিভাজিত৷ ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ তপঃ ও সত্য -- এই সপ্ত লোকের অধীশ্বর হলেন পরমপুরুষ৷ তারই পবিত্র জ্যোতির ধ্যান করা হয়৷ সেই ধ্যান মন্ত্রকে সবিতৃ ঋক্ বলা হয়৷ সাধারণত লোকেরা যাকে গায়ত্ত্রী মন্ত্র বলে থাকে৷ এই সপ্তলোক বলতে পৃথক পৃথক দুনিয়া ৰোঝায় না৷ এই সপ্তলোকের নিম্নতম স্তর হ’ল ‘ভূঃ’ লোক আর ঊর্ধ্বতম স্তর হ’ল ‘সত্য’ লোক৷ এই উভয় স্তরই পরমপুরুষ দ্বারা আধৃত৷ আর এই দু’য়ের মধ্যবর্তী যে পঞ্চলোক সেটাই হ’ল মানব মনের পঞ্চকোষ৷ ভুবর্লোক হ’ল স্থূল মন যা প্রত্যক্ষভাবে দৈহিক কর্মের সাথে সম্পর্কিত৷ আর স্বর্লোক হ’ল সূক্ষ্ম মন৷ আর মনোময় কোষ হচ্ছে মানসিক স্তর৷ মুখ্যতঃ সুখ-দুঃখের অনুভূতি স্বর্লোক আর মনোময় কোষে হয়ে থাকে৷ তো এই যে স্বর্লোক একেই লোকে স্বর্গ বলে৷ স্বঃ গ ঞ্চ স্বর্গ৷ সুখ দুঃখের অনুভূতি এই স্তরেই হয়ে থাকে৷ সৎকর্ম সমাপনান্তে মনের মধ্যে যে একটা গভীর প্রসন্নতা জাগে সেটা এই স্বর্লোক বা মনোময় কোষে হয়ে থাকে৷ এই স্বর্লোক সর্বদাই তোমার সাথে সাথে রয়েছে৷ যখন সৎকর্ম করো, মানব থেকে অতীমানবত্তায় উন্নীত হও তখন এই স্বর্লোক আনন্দানুভূতিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে৷ আর যদি মানুষের শরীর পেয়েও অধম কর্ম করতে থাক তাহলে তোমার স্বর্লোক দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে৷ তখন মনের সমস্ত অংশটাই আত্মগ্লানিতে ভরে ওঠে৷ স্বর্গ-নরক বলে কোন পৃথক পৃথক কিছু নেই৷ এই পৃথিবীতে তোমার মনের মধ্যে স্বর্গ লুকিয়ে রয়েছে৷ তাই যে পণ্ডিত বা মূর্খ মানুষকে স্বর্গ-নরকের অলীক কাহিনী শোণায় সে ঠিক কাজ করে না৷ বরং সে বিশ্বাসপ্রবণ মানুষদের জেনে শুনে পথভ্রষ্ট করে, বিপথে পরিচালিত করে তাই এই সমস্ত মানুষদের থেকে সযত্নে দূরে থাকবে৷ এরা ভাবজড়তার প্রচারক৷ এরা ডগমার প্রচারক৷
এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখবে এই যে ভূর্লোক, তুমি এই ভূর্লোকে রয়েছো কিন্তু তোমার মন তার থেকেও নীচে নেমে যাচ্ছে৷ সেই অবস্থায় স্থূল বস্তু থেকেও ভুর্লোক স্থূল৷ মন তার থেকেও অধিকতর জড় হয়ে যায়৷ মানুষের শরীর রয়েছে ঠিকই কিন্তু তার মনটা মানুষের মনের চেয়ে অধিকতর জড় হয়ে যায়৷ এমন কিছু পশুপক্ষীর মনের চেয়েও অধিকতর জড় প্রাপ্ত হয়৷ এমন কি ইট, কাঠ পাথরের চেয়েও৷ সেই মন ভূঃ, ভুবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ সত্যের দিকে এগোয় না যদিও কামময় কোষ, মনোময় কোষ যথাক্রমে মনের ঊর্ধ্ব থেকে ঊর্ধ্বতর কোষ৷ কিন্তু তার যে ধরনের ভাবনা, যে ধরনের পরিস্থিতি সেটা ভুর্লোক, স্থূল থেকেও স্থূল৷ এগুলো কোন পৃথক সত্যলোক নয়৷ কেন না বাস্তবে এ সবকিছুই মনের মধ্যে নিহিত রয়েছে৷ এগুলো হ’ল তল, অতল, বিতল, তলাতল, পাতাল, অতিপাতাল ও রসাতল৷
রসাতল হ’ল সর্বনিম্ন তল৷ যে লোকটার শরীর মানুষের মত কিন্তু কর্মগুলো মনুষ্যোচিত নয় তার অবস্থাটা কেমন? এমনিতে সে ভুর্লোকে রয়েছে ঠিকই৷ কিন্তু তার মন ভুর্লোকের নীচে নেমে যাচ্ছে ও মৃত্যুর পর সে আর মানুষের শরীর পাবে না৷ সে তখন ইট, কাঠ, পাথরের মত সম্পূর্ণ জড়দেহ পাবে৷ অথবা গাছপালা, কীট-পতঙ্গ হয়েও জন্মাতে পারে৷ এসব ঠিক কথা, এসব যুক্তিগ্রাহ্য কথা৷ স্বর্গ-নরকের কথা বেহেস্ত-দোজখ্ (Heaven and Hell) -এর্ কাহিনী একেবারে ৰুজরুকি৷ এর পেছনে রেলিজন বা মঝহব কাজ করে ঠিকই, অপরকে ভীতি প্রদর্শন অথবা শোষণের জঘন্য মনস্তত্ত্ব ছাড়া এর পেছনে আর কোন সত্যতা নেই৷ এটা আগাগোড়াই ডগমা বা ভাবজড়তা৷ ৰুদ্ধিমান মানুষ, ধার্মিক সাধক এ ধরনের ডগমাকে প্রশ্রয় দেবে না৷ বরং সে বলবে, ‘‘এই ধূলির ধরণীকে স্বর্গে রূপান্তরিত করো৷ মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান্ ও চিকিৎসার সুব্যবস্থা করো৷ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এগিয়ে চল৷ আর এভাবে আমাদের এই মাটির পৃথিবীটা স্বর্গে রূপান্তরিত হোক৷’’