শিক্ষা সংস্কারের নামে শিক্ষা সংকোচন

লেখক
আচার্য সাত্যাশিবানন্দ অবধূত

গত ২৯শে জুলাই কেন্দ্রীয় সরকার নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় বৈঠকে পাশ করল এই বৈঠকে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নাম পরিবর্তন করে করা হল শিক্ষামন্ত্রক যদিও এই নাম পরিবর্তনের কোনও আবশ্যকতাই  ছিল না।

সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ তালিকাভুক্ত কিন্তু সাম্প্রতিক করোনাকালের উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাজ্য সরকার গুলির সঙ্গে কোনোমাত্র আলোচনা না করে,সংসদের নির্র্বচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও  কোনোমাত্র আলোচনা না করে মোদি সরকার একতরফাভাবে এই নূতন শিক্ষানীতি ঘোষণা করল,  এতে তাঁদের স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতারই পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে রাজ্যসরকারগুলিকে উপেক্ষা করে এই শিক্ষানীতি ঘোষনা নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোর মূলে আঘাত করা।

এই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র অনুমোদনকে মুক্তকন্ঠে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদি বলেছেন,শিক্ষাক্ষেত্রের বহু প্রতিষ্টিত এই সংস্কার আগামী দিনে লক্ষ লক্ষ জীবন বদলে দেবে।

প্রধানমন্ত্রী শিক্ষানীতির সংস্কার নিয়ে এত বড়াই করছেন, কিন্তু  আসলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যেই এতে চরমভাবে অস্বীকৃত অবশ্য স্বাধীনতার পর থেকে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার বা বিভিন্ন রাজ্যে তারাই ক্ষমতায় এসেছেন, কেউই শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য আদর্শ মানুষ তৈরী তথা মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন-এই মূল উদ্দেশ্যকে চরমভাবে অবহেলাই করেছে মনের বিকাশ বা  চরিত্র নির্র্মনের দিকে কোনো সরকারই মনোযোগ দেয়নি।

শিক্ষা প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির মেরুদণ্ড পশুরা জন্মের পর থেকেই পশুর স্বভাব প্রাপ্ত হয়, কিন্তু একটি মানবশিশুকে প্রকৃত মানুষ  করে গড়ে তুলতে শিক্ষার একটা বিরাট ভূমিকা অনিবার্য হয়ে দেখা দেয় প্রকৃত শিক্ষার অভাবে মানুষ অমানুষ হয়ে ওঠে শিক্ষাই পারে মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে আর শিক্ষার  অভাবে সমাজের সর্বস্তরে অবক্ষয় দেখা দেয়, সর্বক্ষেত্রেই বিপর্যয় দেখা দেয়।

মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার আদর্শ সমাজ নির্র্মণে তাই  শিক্ষার ওপর অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন মূল্যবোধ সম্পন্ন,সৎ,নীতিবান মানুষ ব্যতিরেকে সমাজের কোনো ক্ষেত্রেই উন্নতি সম্ভব নয়, তিনি বলেছেন, সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে--- তাকেই বিদ্যা শিক্ষা বলা হবে যা মানুষকে সর্বক্ষেত্রে বিমুক্তির পথ দেখাবে তিনি বলেছেন, মানুষের জীবন ত্রিস্তরীয়--- ভৌতিক (ফিজিক্যাল), মানসিক ও আত্মিক তাই সেটাই প্রকৃত শিক্ষা যা মানুষকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংসৃকতিক, আধ্যাত্মিক--- সমস্ত ক্ষেত্রেই সমস্ত বাধা বিপত্তির উপলখণ্ডকে সরিয়ে তার সার্বিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।

সেজন্যে শিক্ষাক্ষেত্রে নীতিশিক্ষা তথা চরিত্র নির্র্মণের শিক্ষাটা অত্যন্ত জরুরী যুগান্তকারী প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শিক্ষার মূলনীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এও বলেছেন, শিক্ষানীতির ভিত্তি হওয়া উচিত নব্যমানবতাবাদ, অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ, পশুপক্ষী-তরুলতা সবার প্রতি ভালবাসা ও দায়িত্ববোধের জাগরণ শিক্ষার মধ্যে যেন কোনও প্রকার  জাত-পাত সম্প্রদায়বোধের ছিটেফোঁটাও না থাকে তিনি আরও বলেছেন, প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা ও পাশ্চাত্ত্যের বিজ্ঞান---এই দুয়ের সমন্বয় ঘটাতে হবে আধ্যাত্মিকতার নামে যেন কোনোপ্রকার অযৌক্তিক কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও সংকীর্ণ ভাবধারাকে প্রশ্রয় না দেওয়া হয়।

কিন্তু বর্তমান মোদি সরকারের ঘোষিত শিক্ষানীতির মধ্যে এই এই মানুষ তৈরীর শিক্ষার কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।

বৃত্তিমুখী শিক্ষার  নামে মোদি সরকার যে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তাকে করপোরেট শিক্ষা ছাড়া অন্য কিছু বলা যাবে না মানুষের মধ্যে  মহৎ আদর্শ ও উন্নত সংসৃকতির প্রতি আকর্ষণ না ঘটিয়ে,  মানবমনের সুকুমার বৃত্তিগুলিকে ধবংস করে যান্ত্রিক রোবট তৈরীর এই যে পরিকল্পনা, পুঁজিপতিশ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধিটাই এর লক্ষ্য।

ছাত্র-ছাত্রাদের মধ্যে বৃত্তিশিক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য কিন্তু তাদের মনের বিকাশের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে পুঁজিপতিদের পছন্দমত প্রযুক্তিশিক্ষা পুঁজিবাদী শোষণের ভিতই শক্ত করবে।

প্রধানমন্ত্রী যদি যথার্থই শিক্ষার সংস্কার চাইতেন, তাহলে দল-মতের ঊধের্ব উঠে সমস্ত দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ্দের সঙ্গে পরামর্শ করে, সমস্ত রাজ্য সরকার গুলির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেই নূতন শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করা উচিত ছিল শিক্ষার মত এতবড় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এভাবে একতরফা নীতি ঘোষণা করা হঠকারিতার নামান্তর জাতীয় শিক্ষানীতির নামে শিক্ষার এই সংকোচন ও বাণিজ্যকরণের সর্বত্র প্রতিবাদ হওয়া উচিত।