শিক্ষাদানের পদ্ধতি কীরকম হওয়া উচিত তা চিরকালেরই এক জটিল প্রশ্ণ৷ মানুষের মনের ওপর পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম৷ যে পরিবেশে একজন জন্মায়, বেড়ে ওঠে, তার প্রভাব জীবনের শেষক্ষণ পর্যন্ত সেই মানুষটির ওপর কার্যকরী থাকে৷ একজন যেভাবে শিক্ষা পেল সেই অনুযায়ী তার মানসিক সংরচনাও তৈরী হয়৷ আর মানুষের জীবনে শারীরিক সামর্থ্যের চেয়ে মানসিক ক্ষমতার প্রভাব অনেকগুণ বেশী শক্তিশালী ৷
এ ব্যাপারে আমি কিছু আলোকপাত করছি৷ তোমরা ৰুদ্ধিমান, নিশ্চই ৰুঝে নেবে৷ ধর, কোনো একটি দেশে একজন মানুষ তথাকথিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো পরিবারে জন্মগ্রহণ করল৷ সেখানে সে নানারকম অত্যাচারের শিকার হয়ে প্রবল মানসিক চাপের কবলে পড়ল৷ এক্ষেত্রে যদিও সেই মানুষটির ওপর সেই দেশের পারিপার্িশ্বকতার প্রভাব রয়েছে তবুও এই মানসিক চাপের দরুণ সে হয়তো সেই দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে যেতে বাধ্য হ’ল৷ শারীরিকের চেয়ে মানসিকতার প্রভাব প্রবলতর হওয়ার কারণেই এটা ঘটল৷
আমরা যদি মানুষের কল্যাণের কথা ভাবি তাহলে আমাদের শিক্ষাদানের সব চেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতিটাই খুঁজে বের করতে হবে৷ (শিক্ষার মাধ্যমে) মনকে ঠিকভাবে গড়ে নিতে পারলেই মানুষ জীবনে সার্বিক সার্থকতা অর্জন করবে৷ বিচারশীল মন তখন ঠিক ৰুঝে নেবে জীবনে নিরন্তর উৎসাহ–উদ্দীপনা বজায় রাখার প্রকৃত উৎস–স্রোতটা কোথায়–কেন এক ৰৃহত্তম পরম চেতনাসত্তাই সবকিছুর মূল প্রেরণাস্থল৷
শিক্ষা মনের সমস্ত পুরনো, জীর্ণ, অপাংক্তেয় ধ্যানধারণাকে ভেঙ্গে তছনছ করে তাকে নোতুন ভাবে গড়ে দেয় ও মনকে চরম উপলব্ধি তথা সত্যের পরমাস্থিতির দিকে চালিত করে৷
শিক্ষাপদ্ধতির ব্যাপারে আমাদের তিনটি মূল বিষয় মনে রাখতে হবে৷ প্রথমতঃ শিক্ষার ভিত্তি হবে প্রখর বাস্তবতাৰোধ৷ শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো ভাবজড়তা, গোঁড়ামী, ভৌগোলিক বা জাতিগত ভেদ–বিভেদের বিন্দুমাত্র স্থান থাকবে না৷
দ্বিতীয়তঃ শিক্ষা এরকম হবে যাতে শিক্ষার্থীর মনে যথার্থ জ্ঞানের ক্ষুধা জাগ্রত হয়৷ ছাত্র–ছাত্রারা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে নিজেদের মনে এক অবস্থার চাপ সৃষ্টি করবে, সব জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়ার জন্যে তাদের মন আকুল হয়ে উঠবে– ‘‘এর উত্তরটা কী? তা কি সঠিক? ’’ তাদের মনোভাবটা হবে–‘‘আমি সব কিছু জানতে চাই৷ আমি সমগ্র বিশ্বকে অধিগত করতে চাই৷’’ আরবী ভাষায় শিক্ষার্থীর জন্যে তালিব–উল্–ইল্ম্ শব্দটি ব্যবহূত হয় যার অর্থ হচ্ছে ‘জ্ঞানের প্রকৃত অনুসন্ধানকারী’ ৷ এই রকম প্রচণ্ড জ্ঞানের ক্ষুধা জাগিয়ে তুলতে হবে যাতে শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে, পিতামাতা, প্রতিবেশীকে নিরন্তর প্রশ্ণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে–‘‘এটা এরকম কেন? ওটা ওরকম কেন? কেন এরকম ঘটল?’’ এইভাবে সে যেন সমগ্র
বিশ্বকে নিজের মধ্যে সমাবিষ্ট করে নিতে চাইবে৷
তৃতীয়তঃ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মন থাকবে সাম্যাবস্থায় যাতে তা কোনোরকম অবাঞ্ছনীয় তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত না হতে পারে৷
এ হ’ল শিক্ষাপদ্ধতির মূল তিনটি তত্ত্ব৷ মনে রাখতে হবে মানুষসহ অন্যান্য জীবের জন্যেও শিক্ষা আবশ্যিক৷ একটি কুকুরকে, একটি গোরুকে যদি উপযুক্ত ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় তাহলে তারা মানুষেরই অনেক কাজে লাগবে৷
অনেকে জিজ্ঞাসা করেন–‘‘আনন্দমার্গ হাইস্কুল, বড় বড় ডিগ্রি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি না খুলে এত কিণ্ডার গার্টেন স্কুল পরিচালনা করে কেন?’’ এর উত্তরটা হচ্ছে–কিণ্ডার গার্টেন স্কুল হ’ল একটি মৌলিক ব্যাপার আর মানুষ গড়ার প্রকৃত ভিত্তিটা এখানেই তৈরী হয়৷ একজন যদি চোর বা অপরাধী তৈরী হয়েই গেল তাহলে সেই মানুষটিকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন থাকে কি? তাই শিশুবয়স থেকে একজনকে গড়ে তুলতে হবে৷ জীবনের প্রাথমিক স্তরেই যদি একজন মূল শিক্ষাটা পেয়ে যায়–তাহলে পরবর্তীকালে যত ঝড়ঝঞ্ঝা, বাধাবিপত্তি আসুক না কেন, সে স্বচ্ছন্দে সে সবের মোকাবিলা করতে পারে৷ কাঁচা অবস্থায় বাঁশকে যেভাবে দরকার সেইভাবেই কেটেছুঁটে, বাঁকিয়ে–দুমড়িয়ে তৈরী করা যায়৷ পাকা অবস্থায় তা করতে গেলেই বাঁশটি নির্ঘাত ভেঙে যাবে৷ তাই কিণ্ডার গার্টেন স্কুলের ওপরে বেশী জোর দিতে হবে কেননা এই স্কুলগুলি হচ্ছে মানুষ ও সমাজ গড়ার প্রাথমিক স্তর৷
তাহলে শিক্ষার জন্যে কী প্রয়োজন? উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে একদিকে মানুষ জগতের স্থূলতার প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবে, আর অন্য দিকে এক উন্নততর জীবন, আদর্শমুখী জীবনের প্রতি মনের আকুতিকে সদাজাগরুক রাখতে পারবে৷ এইভাবে মানুষের মধ্যে শিক্ষালাভের জন্যে প্রেরণা নিরন্তর বজায় থাকবে৷ সব মানুষ তো অবশ্যই, সমস্ত সৃষ্ট জীবকেও আমাদের উপযুক্ত ভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে৷ প্রতিটি গাছপালা, পশুপাখিকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করতে হবে৷
প্রাউট অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য হ’ল–‘‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’’৷ শিক্ষা হ’ল তাই যা বিমুক্তি অর্থাৎ স্থায়ী মুক্তি প্রদান করে৷ শিক্ষার প্রকৃত অর্থ হ’ল ত্রিভৌমিক বিকাশ–মানবীয় অস্তিত্বের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক এই তিনস্তরেই একসঙ্গে ও সমানভাবে উন্নতি৷ এর ফলে ব্যষ্টিত্বের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রগতি সংসাধিত হয়৷ এই শিক্ষা প্রসুপ্ত মানবীয় সম্ভাবনাকেও জাগিয়ে তোলে যাতে করে তার যথার্থ উপযোগ সম্ভবপর হয়৷ প্রকৃত শিক্ষিত তাকেই বলব যিনি প্রভুত জ্ঞান অর্জন করেছেন, তা অনেক বেশী মনে রেখেছেন ও নিজের বৈবহারিক জীবনে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছেন৷