শিক্ষক দিবসের গুরুত্ব

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্‌হা

প্রতি বছর ৫ সেপ্ঢেম্বর দিনটি আমাদের দেশে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়৷ বস্তুত এই ‘শিক্ষক দিবস’ পালনের তাৎপর্য্য অত্যন্ত ব্যাপক৷ শিক্ষককুলের প্রতি যথোচিত সম্মান প্রদর্শন ও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মেলবন্ধনই এই দিবসের প্রধান উপজীব্য৷ অতি প্রাচীন কাল থেকেই গুরুশিষ্য পরম্পরা এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ৷ পূর্বে গুরুগৃহে শিষ্যরা অবস্থান করে বিদ্যাভ্যাস ও অন্যান্য শিক্ষা লাভ করতো৷ পরবর্তীকালে তাঁরা সেই শিক্ষার সুফল বৈয়ষ্টিক জীবনে ও সামাজিক জীবনে প্রতিফলিত করার প্রয়াসী হতেন৷ এমনকি রাজপরিবারের সন্তান-সন্ততিরাও এই একই ব্যবস্থাপনার মধ্যেই শিক্ষিত ও প্রতিপালিত হ’ত৷ গুরুর কাছে শিষ্য ছিলেন অতি প্রিয় সন্তানসম ও গুরু ছিলেন শিষ্যের নিকট ঈশ্বর তুল্য৷ ফলস্বরূপ গুরুর স্থান ছিল সমাজের শীর্ষে ও সামাজিক জীবনে নীতিবাদ, ধর্মপরায়ণতা, শৃঙ্খলা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল সদাজাগ্রত ও ব্যবহারিক জীবনের অঙ্গীভূত৷ প্রকৃতপক্ষে গুরু শিষ্যের এই পারস্পরিক সম্পর্ক ভারতবর্ষের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অত্যন্ত মজবুত করেছে৷ তাই আজও শিক্ষকতা নিছক একটি পেশা রূপে পরিগণিত না হয়ে জীবনাদর্শ ভিত্তিক মহৎ কর্তব্য রূপে সমাজে স্বীকৃত৷ আর এখানেই নিহিত আছে ‘শিক্ষক দিবস’ পালনের মূল পরাকাষ্ঠা ও তাৎপর্য্য৷ অবশ্য বর্তমানে বেশ কিছুকাল ধরে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের অবনতির ঘটনাক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে যার ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা ও সামগ্রিকভাবে সমাজ ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে৷ বিগত বছরগুলিতে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও অন্যান্য মাধ্যমে পরিবেশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায় যে, বিভিন্ন ঘটনায় শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ কোথাও ছাত্রছাত্রার দ্বারা শিক্ষক, অধ্যক্ষ প্রকাশ্যে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিগৃহীত হচ্ছেন৷ কখনও শিক্ষক-শিক্ষিকা কর্তৃক ছাত্রছাত্রারা মাত্রাতিরিক্ত লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত বা অশালীন আচরণের শিকার হচ্ছেন৷ আবার কখনও অভিভাবক-অভিভাবিকাগণ শিক্ষক-শিক্ষিকা নিগ্রহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন৷ ফলতঃ শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের মধুর শৃঙ্খল ভেঙে চুড়মার হয়ে যাচ্ছে ও শিক্ষকের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে৷ ঘটনা সমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি তথা শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি, অস্বচ্ছতা ও অসম্পূর্ণতাই এগুলোর প্রকৃত কারণ৷

শিক্ষক-ছাত্র মেলবন্ধনের মূল সূত্র হ’ল ভালবাসা ও শ্রদ্ধা৷ অতীতে শিক্ষকতাকে বরণ করে নিতেন স্বাধীনচেতা, সৎ, নীতিবান ও মানুষের সেবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ মানুষজন, যাঁরা ছাত্র-ছাত্রাদের প্রাণঢালা ভালবাসার মাধ্যমে শিক্ষাদান করতেন৷ প্রয়োজনে হয়ত শাসনও করতেন তবে তা ছিল ছাত্র-ছাত্রার মঙ্গল কামনায়---কখনও তা অত্যাচারের পর্যায়ে পরিণত হতো না৷ ফলে সেই শাসন ছাত্রছাত্রা বা অভিভাবক-অভিভাবিকা খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতেন৷ বরং এ বিষয়ে ছাত্রছাত্রা, অভিভাবকের কাছে নালিশ করলে তাঁরা রুষ্ট হতেন কারণ, শিক্ষক প্রয়োজনবোধে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ও ছাত্রের শাস্তিবিধান করেছেন, যেহেতু তাঁরা বিশ্বাস করতেন শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে৷

বর্তমানে উভয়পক্ষেরই ভাব বিনিময়ের অপ্রতুলতা ও অসহনশীলতা আর সঠিক সীমাজ্ঞানের অভাব এই সম্পর্কের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করেছে৷

একথা অনস্বীকার্য যে, এমন অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন, যারা প্রকৃত শিক্ষক সুলভ মানসিকতা সম্পন্ন ও মানবসেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই তাঁদের কর্তব্য পালন করছেন---ছাত্রছাত্রা ও বিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে তাঁদের শ্রম, সময়, অর্থ সবই নিঃস্বার্থভাবে দান করে চলেছেন৷ এমনকি অবসরকালীন প্রাপ্ত অর্থের একটা বড় অংশ এই সকল উদ্দেশ্যে ব্যয় করেছেন৷ তাদের এই নিরলস শ্রম ও আত্মত্যাগ সমাজে সর্বদাই স্মরণীয় হয়ে থাকবে৷ এই সমস্ত মানুষজন আছেন বলেই শিক্ষাঙ্গন পুরোপুরি কলুষিত হয়ে যায়নি---তবে তাদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় নেহাতই কম, কোটিতে গুটিক মাত্র৷ শিক্ষাক্ষেত্রের এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ, মাৎস্যন্যায় অবস্থার পরিবর্তন আশু প্রয়োজন৷ সঠিক শিক্ষাপদ্ধতি ছাত্রছাত্রাদের শুধুমাত্র টিউশন সর্বস্ব পুস্তক ও নোটকীটে পরিণত করবে না, শিক্ষান্তে একটি সার্টিফিকেট ও চাকুরীর ছাড়পত্র দিয়েই ক্ষান্ত হবে না---এগুলির অতিরিক্ত মানবিক গুণ সম্পন্ন বলিষ্ঠ চরিত্রের সত্যিকারের মানুষে পরিণত করবে৷ শিক্ষায়তনগুলির মধ্যে সুশৃঙ্খলা, দৃঢ় অনুশাসন, স্বচ্ছ প্রবেশাধিকার নীতিপদ্ধতি ও পঠনপাঠনের সুস্থ পরিবেশ একান্ত কাম্য৷ বিভিন্ন বিষয়গত পাঠ ও শিক্ষা ছাড়াও মানবিক গুণগুলি বিকাশের সুব্যবস্থা, নীতিবাদ,, সততা, বিশ্বৈকতাবাদ ও নব্যমানবতাবাদের প্রকৃত শিক্ষাই আজকের ছাত্রছাত্রাদের আগামী দিনের সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে৷ মানব প্রেম তথা সামগ্রিকভাবে জীব-প্রেমের আদর্শ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতাই একদিন শিক্ষক-ছাত্রের মধুর সম্পর্ককে পুনরুজ্জীবিত করবে---আর তখনই প্রকৃত অর্থে ‘শিক্ষক দিবস’ পালনের সঠিক মর্মার্থ অনুধাবন করা সম্ভব হবে৷