শক্তি মদের সাংঘাতিক লক্ষণ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

অষ্টাদশ লোকসভার নির্বাচন চলছে৷ এই লেখার সময় সাতদফা নির্বাচনের এখনও একটি বাকি আছে৷ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সব পক্ষই নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত৷ প্রচারের ভাবখানা দেশের ও দেশবাসীর কল্যাণে দলীয় কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত৷ কারণ সার্থক গণতন্ত্রের কথা হ’ল জনগণের কল্যাণের জন্যে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের সরকার৷ কিন্তু দেশের নেতাদের উচিত-অনুচিত বোধের বড় অভাব৷ যেমন যে জনগণ রাষ্ট্রের শাসক নির্বাচন করে তার মধ্যেও সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনার ভীষণ অভাব৷ জনগণের এই অজ্ঞতা, এই অভাব আজকের রাষ্ট্রনেতাদের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে সাফল্য অর্জনের বড় মূলধন৷

রঙ্গমঞ্চ শব্দটাই ব্যবহার করলুম কারণ রঙ্গমঞ্চের কুশিলবদের চালচলন হাবভাবের সঙ্গে তাদের বাস্তব জীবনের কোন সম্পর্ক থাকে না৷ তেমনি নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে নেতারা যে ভাষণ দেয় জনগণের সামনে, যে প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছোটায় তার অধিকাংশই ভুয়ো৷ মঞ্চ থেকে নেমে এসে আর মনে রাখে না৷ নির্বাচনী প্রচারের রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা ভাষণে যে প্রতিশ্রুতি দেন তার কত শতাংশ পালন করে তার তথ্য তুলে ধরার প্রয়োজন মনে করছি না৷ জনগণের তিক্ত অভিজ্ঞতাই যথেষ্ঠ৷ প্রশ্ণ উঠতে পারে তবু জনগণ কেন বার বার এদের নির্বাচিত করে৷ উত্তর আগেই দেওয়া হয়েছে৷ জনগণের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক চেতনার অভাব৷

তবু রাষ্ট্র পরিচালনার যতগুলি প্রথা আছে তার মধ্যে গণতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ যদিও সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়৷ যাঁরা রাষ্ট্রের শাসক নির্বাচন করবেন সেই নির্বাচক মণ্ডলীর নির্দিষ্ট শিক্ষার  মান থাকা উচিত৷ কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রে বয়স নির্দ্ধারিত সাবালোক হলেই বোটদানের অধিকার প্রাপ্ত হয়, রাষ্ট্র সমাজ, রাজনীতি অর্থনীতি বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হলেও৷ এই অজ্ঞানতার অন্ধকারেই ভারতীয় রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে৷ দেশ জ্ঞান না থাকলে দেশ প্রেম জাগে না৷ দেশ প্রেম না জাগলে দেশবাসীর সেবার আগ্রহ থাকে না৷ এই অজ্ঞতা ও আগ্রহের অভাবই রাজনীতিকে বাণিজ্যনীতিতে পরিণত করেছে৷ ‘‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’’৷ সেই লক্ষ্মী লাভের আশায় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক অসৎ লোকের ভীড়৷

এত সাতকাহন লেখার কারণ দেশের নেতানেত্রীদের আচার, আচরণ ব্যবহারে ব্যাভিচার ও বিকৃতির লক্ষ্মণ দিন দিন প্রকট হচ্ছে৷ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শাসক বিরোধী উভয়পক্ষেরই পরস্পরের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও সৌজন্য বজায় রাখতে হয় নেতা-নেত্রীদের আচরণে তার কোন বালাই নেই ব্যতিক্রমী দু-এক ছাড়া৷ সম্প্রতি নির্বাচনী প্রচারে দেশের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী নেতাদের সম্পর্কে ও একটি জনগোষ্ঠীকে ইঙ্গিত করে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন তা কখনই শোভাপায়না গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে বসে থাকা ব্যষ্টির পক্ষে৷

তবে ভারতীয় রাজনীতিতে এই অশ্রদ্ধা অসৌজন্যতা এই প্রথম নয়৷ স্বাধীনতার আগে থেকেই জাতীয় কংগ্রেসে গান্ধী সুভাষ বিরোধীতার সময়ও গান্ধীপন্থি নেতাদের মধ্যে আচার ব্যবহারে ব্যাভিচার ঘটতে দেখা গিয়েছিল৷ স্বয়ং বিশ্বকবি লিখেছিলেন---‘‘সংকটের সময় তাঁদের ধৈর্য্যচ্যুতি হয়েছে, বিচারবুদ্ধি সোজাপথে চলেনি৷ পরস্পরের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও সৌজন্য, যে বৈধতা রক্ষা করলে যথার্থভাবে কংগ্রেসের বল ও সম্মান রক্ষা হত, তার ব্যভিচার ঘটতে দেখা গেছে, এই ব্যবহার বিকৃতির মূলে আছে শক্তি ও স্পর্ধার প্রভাব৷

দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেস মুক্ত ভারত চাইলেও নিজে কিন্তু সেই কংগ্রেসী সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাজনীতি করছেন৷ তাঁর মধ্যেও শক্তি মদের সাংঘাতিক লক্ষণ দেখা দিচ্ছে৷ ক্ষমতা হস্তচ্যুত হবার লক্ষণ দেখা দিলেই তিনি ধৈর্য হারাচ্ছেন, ভাষণে অশালীন শব্দ নিংসৃত হচ্ছে৷ গান্ধী সুভাষ বিরোধের সময় গান্ধীপন্থীদের মঞ্চ থেকে আবাজ উঠেছিল ‘হিন্দুস্থান কা হিটলার কী জয়৷ মহাত্মা গান্ধী কী জয়৷’ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেসমুক্ত হলেও কংগ্রেসী রাজনীতির ধারক ও  বাহক৷ কংগ্রেসী সংস্কৃতিমুক্ত তিনিও নন৷ তাই শক্তি মদের সাংঘাতিক লক্ষণ তাঁর আচরণেও প্রকট৷