চলা জগতের ধর্ম৷ চলে চলেছে বলেই এই পৃথিবীর নাম জগৎ৷ ‘গম’ ধাতুর উত্তর ক্কিপ্ প্রত্যয় করে ‘জগৎ’ শব্দ নিষ্পন্ন যার মানে হ’ল---চলা যার স্বভাব৷ ব্যষ্টিগত জীবনে যেমন চলতে হয় সমষ্টিগত তথা সামূহিক জীবনেও তেমনি চলতে হয়৷ কিন্তু এই যে চলা, এই চলার জন্যে তিনটে জিনিসের প্রয়োজন আছে৷ একটা হচ্ছে---চলার জন্যে একটা সম্প্রেষণ, পেছন থেকে একটা ধাক্কা৷ যখন চলাটা বন্ধ হয় তখন ধাক্কা দিয়ে বলতে হয় চল চলতে হবে৷ দ্বিতীয়তঃ নিজে যে চলবে তার চলার সামর্থ্য থাকা চাই অর্থাৎ চলার উপযুক্ত রসদ তার থাকা চাই৷ নইলে সে চলবে কী করে? আর তৃতীয় হচ্ছে ঃ চলছে একটা লক্ষ্যের দিকে৷ এই তিনটে জিনিস চাই৷
প্রাচীনকালে মানুষ যূথৰদ্ধভাবে তথা একক ভাবে যে চলে এসেছে সে চলার আজও বিরাম নেই৷ সে চলার পথে কোনো যতিচিহ্ণ নেই বা থাকৰে না৷ এটা অপরিচ্ছেদ---কোনো কমা, সেমি- কোলন, কোলন, পূর্ণচ্ছেদ এতে নেই৷ মানুষ সাধারণতঃ চলে কিসের প্রেষণায়, কিসের শক্তিতে, আর কিসের দিকে লক্ষ্য রেখে? দেখা গেছে মানুষ চলে দুটো ভাবে৷ এই দু’টো ভাবের আমি নাম দিয়েছি সম্প্রতি লিখিত ‘সভ্যতার আদি বিন্দু---রাঢ়’ পুস্তকে৷ একটা হচ্ছে আত্মসুখ তত্ত্ব আর একটা হচ্ছে সম-সমাজ তত্ত্ব৷
আত্মসুখ তত্ত্ব হচ্ছে---যা কিছুই করছি সুখ পাবার প্রেষণায়, সুখ পাবার পদবিক্ষেপে আর পরে সুখে প্রতিষ্ঠিত হৰার জন্যে৷ এই আত্মসুখ তত্ত্ব জিনিসটা ভাবজড়তার(dogma) ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগৌলিক যতগুলো তত্ত্বের দ্বারা মানুষ সাধারণতঃ পরিচালিত হয় সবগুলো ভাবজড়তার দ্বারা চলে চলেছে৷ আর এই ভাবজড়তা বা ডগমা জিনিসটা সম্পুর্ণভাবে আত্মসুখ তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ আত্মসুখের লোভেই মানুষ ভাবজড়তার বশ্যতা স্বীকার করে৷ অনেক মানুষ, যারা লেখাপড়া শিখেছে তারা কী জানে না যে ভাবজড়তার বশ্যতা স্বীকার করছি, ৰুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিচ্ছি, কাজটা ভাল করছি না৷ সৰ বোঝে, সব জানে, সব জ্ঞানপাপী, ৰুঝেসুঝেও ওরা ডগমাকে মানে৷ কেন? ---না, তারা দেখে, এই যে ভাবজড়তা এটা আত্মসুখ তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷’ এটা ভালই হোক আর মন্দই হোক---অন্যের ভালই হোক আর মন্দই হোক আমি তো কিছুটা সুখ পেলুম৷ এই মনোভাবের দ্বারা প্রেষিত হয়ে তারা ভাবজড়তার দাস হয়ে পড়ে৷
এই সভ্য জগতে লেখাপড়া জানা মানুষও ডগমাকে ‘ডগমা’ বলে জেনেও মেনে থাকে৷ কেবল তার মনের কোণে একটা আশা থাকে যে ডগমাকে মানলে লৌকিক জগতে একটা জাগতিক সুখ পাবো৷ আর তাই এই সভ্যজগতেও যেখানে জ্ঞানের বিস্তার কিছু কম হয়নি সেখানে দেখছি মানুষ অন্ধের মত ভাবজড়তার বশীভূত হয়ে চলেছে৷ এই ভাবজড়তার মায়াজাল ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিতে হৰে, এই ভাবজড়তার লৌহ কপাট ভেঙ্গে খানখান করে দিতে হবে৷
তারপর আসছে সম-সমাজ তত্ত্ব৷ সবাইকার লক্ষ্য পরমপুরুষ৷ আর পরমপুরুষের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি ব্যষ্টিগতভাবে ও সামূহিকভাবে৷ কিন্তু সামূহিক জীবনে যে সমস্ত অসাম্য-বৈষম্য রয়েছে---সেই বৈষম্যগুলোকে যদি আমি বজায় রেখে চতে চাই তবে চলতে পারৰো না৷ বৈষম্য একদিকে দূর করৰার চেষ্টা করৰো, আর সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলৰো৷ বৈষম্যকে দূর করতে পারলে সৰাইকার অগ্রগতি দ্রুততর হৰে---এই ভাবনায় প্রেষিত হয়ে যদি পরমপুরুষের দিকে চলি তাতে আত্মসুখ নাও থাকতে পারে কিন্তু প্রশান্তি আছে, পরমপুরুষের প্রসাদ প্রাপ্তির নির্মেঘ আনন্দ আছে৷ তাই সমাজের মানুষজাতের সকলকে সঙ্গে নিয়ে এই রকমের একটা তারতম্য বিহীন সমাজ গড়ে পরমতত্ত্বের দিকে এগিয়ে চলৰার প্রয়াস---এইটারই নাম সম-সমাজতত্ত্ব৷
তাই আমার বক্তব্য এই যে, যে সকল বুজরুকি এই সম-সমাজতত্ত্বের পরিপন্থী তাকে বর্জন করৰো যে জিনিস এই সম-সমাজতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হতে মানুষকে সাহায্য করৰে তাকে সাদরে বরণ করে নেৰো৷ আর যে তত্ত্ব এর প্রতিকূলতাকে সরিয়ে দেবো৷ তাকে পথের কাঁটা জ্ঞানে সরিয়ে দেৰো৷ আর সরাবার ৰ্যাপারে কোনো ভাবজড়তাকে বা কোনো মমতাকে অপৌরুষেয়ৰোধে আসকারা দেৰো না৷ এইটাই হৰে আজকের মানুষের যথার্থ কাজ৷ এই কাজ করৰার জন্যে সব মানুষকে হাতে হাত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হৰে৷ অতীতে কে কেমন ছিল তা ভাৰলে চলৰে না৷ সে শাদা কী কালো তা ভাৰলে চলৰে না৷ কেবল এই কথাটা মনে রাখতে হৰে যে আমাদের পরম তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হতেই হৰে ও সম-সমাজতত্ত্বের ভিত্তিতে নোতুন একটা মানব সমাজ গড়েই আমাদের তা করতে হৰে৷ সম-সমাজতত্ত্বের আইডিয়াটা যখন পেয়েছি, যখন এই আইডিয়াকে বাস্তবায়িত করৰার শারীরিক শক্তি সামর্থ্য, ৰুদ্ধি ও আত্মিক প্রজ্ঞা পেয়েছি, কেন এই সর্ৰাঙ্গসুন্দর সর্বার্থসার্থক আইডিয়ার বলিষ্ঠ রূপকার হিসেবে নিজের ভূমিকাকে সার্থক করে তুলৰো না৷ কেন পৃথিবীতে এই আসাকে, থাকাকে, নিঃশ্বাসের প্রতিটি বিন্দুকে, অস্তিত্বের প্রতিটি স্পন্দনকে জড়-শক্তিতে, মানসিকতায়, ৰোধিতে ধন্য করে তুলৰো না৷
(আনন্দনগর, ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৮১)