সমাজের উন্নতি বা প্রগতি ব্যষ্টি–বিশেষের একক প্রচেষ্টায় হয় না, বা হতে পারে না৷ কেউ দেয় মস্তিষ্ক, কেউ দেয় হাত, কেউ পা৷ তাই সুবিচার করতে গেলে পা–কে হীন আর মাথাই সর্বস্ব অথবা মাথাটার কোন দাম নেই–বুদ্ধিজীবী মাত্রেই শোষক, আর যারা গায়ে গতরে খেটে চলেছে তারাই সবকিছু–এই দুই প্রকার চিন্তাধারাই সমান বিপজ্জনক৷ আসল কথাটা হচ্ছে কে নিজের সামর্থ্য কতখানি কাজে লাগিয়েছে সেইটাই বিচার করে’ দেখা৷ সমুদ্র বাঁধতে গিয়ে হনুমানের পর্বত বয়ে আনা, আর কাঠবেড়ালীর নুড়ি বয়ে আনা তত্ত্বগত বিচারে তুল্যমূল্য৷ কারও আন্তরিকতাতেই আমরা সন্দেহ রাখতে পারি না, অবজ্ঞাও করতে পারি না৷ নিজের সম্পদ যে যথাযথভাবে খাটায়নি সে যদি, যে নিজের সম্পদ ষোল আনা খাটিয়েছে তার চাইতে কিছুটা বেশী কাজও করে’ থাকে, তবে তাকে কোন বাড়তি তারিফ করতে পারব না৷
‘মেহন্নতি মানুষেরই দুনিয়া’–এ কথাটুকুকে চরম সত্য বলে’ মেনে নিলে বৌদ্ধিক পরিশ্রমকে অস্বীকার করতে হয়, বা মনে মনে তার মূল্য বুঝেও তাকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়৷ দারিদ্র্য এই তথাকথিত মেহন্নতি মানুষেরও আছে, আবার তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মানুষেরও আছে–আমরা এ দুয়ের কারও সমস্যাকেই প্রধান করে’ দেখব না৷ আমরা মানুষের সমস্যা সমাধান করবার সময় তার আর্থিক ও মানসিক অভাবগুলো বুঝে মানুষের মন নিয়ে, মানুষের ভালবাসা নিয়ে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাব৷ কোন দল বিশেষের মুখ চেয়ে এই দুনিয়াটার গায়ে ‘শ্রেণী বিশেষের সম্পত্তি’ বলে’ ছাপ মেরে দোব না৷১৪
নারী জাতির উপযোগ
মানব–ইতিহাসে আমরা দেখেছি, নারীরা কেবল নারীত্বকে গৌরবাম্বিত করেনি, সমস্ত মানবজাতিকে গৌরবাম্বিত করেছে৷ দর্শনে, আধ্যাত্মিকতায়, সমাজ–সংস্কারে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে–কোথাও নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই৷ জটিল দার্শনিক তত্ত্বের সমাধানেই হোক, বা সামাজিক শিক্ষা, নৈতিক সংস্কারই হোক–সর্বক্ষেত্রেই মেয়েরা পুরুষের মতই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে৷ বিপদে–আপদে পুরুষকে প্রেরণা জোগাতেও নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য৷
পুরুষের মতই নারীর মধ্যেও প্রভূত সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে৷ নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রকৃতিগত ও দেহ সংরচনাগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে পার্থক্য সমমৈত্রী–ভিত্তিক সহযোগিতাকেই(co-ordinated co-operation) প্রশস্ত করে৷ উভয়ের মধ্যে প্রভু–ভৃত্য সম্পর্ক–সুলভ সহযোগিতা(Sub-ordinated co-operation) মোটেই সমর্থন যোগ্য নয়৷
কিন্তু ইতিহাসের ধারাপ্রবাহে আমরা দেখেছি, সারা পৃথিবী জুড়ে নারীদের ওপর শোষণের মর্মান্তিক চিত্র৷ আজও পুরুষ শাসিত সমাজ–ব্যবস্থায় নারীর স্থান প্রায় দাসীর মতই–এটা কেবল মন্দই নয়, এটা নিন্দনীয়ও৷ নারীদের ওপর এ ধরণের অবদমন ও ভাবজড়তার সাহায্যে তাদের ওপর মানস–র্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানানো উচিত৷ এই ভাবজড়তার বিলোপের জন্যে, ও মানসিক শোষণের কবল থেকে নারী ও নারীত্বকে মুক্ত করতে যা চাই তা হ’ল ঃ–
l বিশ্বের সমস্ত দেশে সমস্ত নারীর জন্যে অবৈতনিক শিক্ষা৷
l সামাজিক, শিক্ষাগত ও ধর্মমতের ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার বৈষম্যের অবসান৷
l সমস্ত নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা৷
আমরা, বিশেষ করে’ নারীদের মধ্যে সৃষ্টি করতে চাই এক বলিষ্ঠ গতিশীল ও বৈপ্লবিক সমাজ–চেতনা৷ নারীরা নব–প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে সর্বপ্রকার দাসত্বের প্রতীক ও ভাবজড়তাগুলোকে নিশ্চিহ্ণ করতে উঠে পড়ে’ লেগে যাক৷ আমরা চাই, নারীরা সম–মৈত্রী ভিত্তিক সহযোগিতার নোতুন যুগের সূচনা করুক৷ আজকের নারী–জাতি হোক নোতুন বিপ্লবের অগ্রদূত৷ গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে মানবতার এই অভূ্যত্থান অত্যাবশ্যক৷৪৫
অবদমিত জনগোষ্ঠীর উপযোগ
প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত মানবজাতির বিভিন্ন শাখা–প্রশাখা মিলেমিশে বিভিন্ন সভ্যতার জন্ম দিয়েছে৷ সমুদ্র ঘেরা আফ্রিকা মহাদেশের বুকে আজও সাহারার আগুন জ্বলছে, আজও নিবিড় অরণ্যের ঘন অন্ধকার তাদের চলার পথকে দুর্গম করে’ রেখেছে৷ প্রকৃতির এই বিরুদ্ধতা তাদের জীবনকে অন্তর্মুখী হতে সুযোগ দেয়নি৷ তথাকথিত সভ্য সমাজ রাজনৈতিক স্বার্থে এদের সভ্য হওয়ার সুযোগ করে’ দেয়নি৷ তাই অতীতে তারা বড় সভ্যতা গড়তে পারেনি৷ কিন্তু তাদের মধ্যেও মানবিক সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে–শুধু সেই সম্পদ গুলোকে আজ উপযুক্ত পরিবেশ দিয়ে জাগিয়ে তুলতে হবে৷৩০
প্রাউট প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে৷ উদাহরণস্বরূপ, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের মধ্যে উপজাতিরা সব থেকে বঞ্চিত৷ ত্রিপুরা সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গার ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপজাতিরা দরিদ্র ও অশিক্ষিত৷ তদের সামাজিক–র্থনৈতিক উন্নতি বিধানের উদ্দেশ্যে অনতিবিলম্বে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত৷ বিশেষ ব্যবস্থা সমূহের মধ্যে থাকবে শিক্ষা ক্ষেত্রের অসাম্য দূর করা, ব্যাপক কুটিরশিল্পের প্রচলন, সুষ্ঠু কৃষি সহযোগিতা, অতিরিক্ত সেচের জল সরবরাহ, বিদ্যুৎ সহ অন্যান্য শক্তি উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা, আর রেল ও টেলিফোনের সাহায্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ দেওয়া৷
এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে, ও তাদের অবলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ এইসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে আফ্রিকার জুলু ও পিগমী, বাংলার লোধা, ছোটনাগপুরের বীরহোড়, মালদহের মালো, বিহারের রোহতাস জেলার ভোজপুরী ভাষাভাষী আঙ্গার, কাশ্মীরের লাদাখী, ইউরোপের রোমাঁশ, অষ্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যাণ্ডের মাওরী, ও কিন্নড়–এর সিডিউল্ কাষ্টরা৷ রাঢ় ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কৈবর্ত্ত্যদের অবলুপ্তির আশঙ্কা না থাকলেও, তাদের জন্মহার সাধারণ জন্মহার থেকে কম৷ এই সমস্যা সমাধানে অবিলম্বে সচেষ্ট হতে হবে৷
বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীর উপযোগ
বিভিন্ন লোক বিভিন্ন ধরণের–জাগতিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক–শক্তিতে সমৃদ্ধ৷ তদের নিজ নিজ সামর্থ্যের সাহায্যে সমাজকে সেবা করার কাজে তাদের উৎসাহিত করা উচিত৷ একইভাবে গোষ্ঠী–সামর্থ্যকেও সমাজের কাজে লাগাতে হবে৷ উদাহরণস্বরূপ, গোর্খারা যেহেতু যুদ্ধে পারঙ্গম, সেহেতু তাদের সেই ধরণের গুণের উপযোগিতা নিতে হবে৷ আবার, জার্মানদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কারের ঝোঁক রয়েছে, তাই তাদের সেই কাজেই উৎসাহিত করতে হবে৷