মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যখনই সভ্যতার সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে তখন সঙ্কট থেকে মানব সমাজকে পরিত্রাণের জন্য তারকব্রহ্ম যুগত্রাতা রূপে সমাজে বারংবার আবির্ভূত হয়েছেন৷ আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে তারকব্রহ্ম সদাশিব প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে তার দিব্যজ্যোতিতে উদ্ভাসিত করেছিলেন৷ তিনি ছিলেন মানবেতিহাসের প্রথম তারকব্রহ্ম৷ তিনি মানবসভ্যতার আদি পিতা৷ প্রচণ্ড আধ্যাত্মিক স্পন্দনের দ্বারা---সমাজচক্রে দিয়েছিলেন এক বিরাট ধাক্কা ভগবান সদাশিবের বৈবহারিক তন্ত্র-যোগ ভিত্তিক সাধনা বিজ্ঞান, বিবাহ পদ্ধতি, নৃত্য,গীত বাদ্য সমন্ধিত সঙ্গীত বিজ্ঞান চিকিৎসা বিজ্ঞান, বৈদ্যক শাস্ত্র প্রভৃতি সে যুগের অনুন্নত মানুষের কাছে ছিল এক বিপ্লবাত্মক নোতুন যুগের সূচনা৷ ভগবান সদাশিব সমাজচক্রের গতিতে দিব্য স্পন্দনের দ্বারা যে গতি প্রচণ্ড দ্রুতি এনে দিয়েছিলেন তার ফলে তা কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত চলে সমাজ তরতরিয়ে সামনে দিকে এগিয়ে চলেছিল৷ কালচক্রের আবর্তনে যখন সমাজ চক্রের গতি আবার শ্লথ হয়ে আসে তখন তাতে নানা আবিলতা তথা শোষণ, দুর্নীতি, পাপাচার বৈষম্য, স্বার্থপরতা ইত্যাদি বাসা বাঁধে৷ ফলে সমাজচক্রের গতি একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়৷ এমতাবস্থায় আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ধরাধামে তারকব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণরূপে যুগপুরুষের আবির্ভাব হল৷ মানবেতিহাসে তা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা৷ কারাগারে তার জন্ম হলেও কারাগারের শৃঙ্খল তাকে বাঁধতে পারেনি৷ পাপ শক্তির প্রতীক কৃষ্ণের মামা কংস শতচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে মারতে পারেনি৷ উল্টে কৃষ্ণের হাতেই তার নিধন হয়েছিল৷
বর্তমান সমাজে কৃষ্ণের কোমলরূপ তথা শিশুকৃষ্ণ, নাড়ু গোপাল, বালক কৃষ্ণ, বংশীধারী রাখালরাজা কৃষ্ণের লীলাময় রূপটিই বেশী দেখা যায়৷ লেখক, পালাকার, গীতিকার, সবার লেখনীতে, কাব্যে, গানে ও সুরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাময় রূপটিই বেশী ধরা পড়েছে৷ ব্রজের কৃষ্ণকে নিয়ে রচিত হয়েছে শত শত কাব্য, সাহিত্য, গান ইত্যাদি৷ কিছুটা উপেক্ষিত থেকে গেছে তার জীবনের অতিগুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়৷ সেটা হচ্ছে পার্থসারথি কৃষ্ণ৷ ব্রজের কৃষ্ণ অতি কোমল৷ তিনি বাঁশীর সুরে সবাইকে কাছে টেনে নেন৷ কিন্তু পার্থসারথি কৃষ্ণ কঠোর,সংকল্পে অটল, তার কাছে অত সহজে যাওয়া যায় না৷ পার্থসারথি কৃষ্ণের সঙ্গে মহাভারত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে৷ মহাভারতকে বাদ দিলেও শ্রীকৃষ্ণ স্বমহিমায় ভাস্বর থাকেন৷ কিন্তু পার্থসারথিকে বাদ দিয়ে মহাভারত আর মহাভারত থাকে না৷ মহাভারতের সেই রাজতন্ত্রের যুগে ভারতবর্ষ ছিল অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত৷ পাপাচারী অধার্মিক দুষ্ট শক্তির অহংকারে মদমত্ততা, দম্ভ, স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে গিলে খাওয়ার মানসিকতা, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার ইত্যাদি কারণের ফলে রাজ্যে রাজ্যে খেয়োখেয়ি লেগেই থাকত৷ সমাজ বিশেষ করে রাজশক্তিগুলোর মধ্যে অধার্মিকতা, পাপাচার ও ভ্রষ্টাচার এতটাই বেড়ে গিয়েছিল সে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা সংশোধনমূলক সমস্ত ব্যবস্থাই ব্যর্থ হয়ে যায়৷ তখন বাধ্য হয়েই ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সমাজের ধার্মিক মানুষদের রক্ষার্থে ও দুষ্ট পাপাচারীদের বিনাশের জন্য ১৮দিনের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে হয়৷ যুদ্ধশেষে পাপী ও অধার্মিক কৌরববা ধবংস হয় ও শ্রীকৃষ্ণের সাহচর্যর ও প্রেরণায় ধার্মিকতা, সহনশীলতা, সংযম ও ত্যাগের কষ্টিপাথরে যাচাইয়ে উত্তীর্ণ পাণ্ডবরা বিজয়ী হন৷ তৎকালীন ভারতবর্ষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলিকে শ্রীকৃষ্ণ এক ছাতার তলায় এনে এক অখণ্ড মহাভারত রচনা করেছিলেন৷ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গীতার তিনি শ্লোকে রেখে গেছেন তার অমোঘবাণী---
‘‘যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লাণির্ভবতি ভারত, অভূ্যত্থানম অধর্মস্য তদাত্মানাং সৃজম্যহম্
পরিত্রানায় সাধুনাং বিনাশায় চদুসৃকতং, ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে৷’’
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের সাড়ে তিন হাজার বছর পর গীতায় প্রদত্ত তার অমোঘ বাণীর প্রতিফলন হল আবার৷ সমাজদেহ যখন হিংসা, দুর্নীতি, শোষন, অধার্মিকতা, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপরতা, ভোগসর্বস্বতা, পাপাচার, ব্যভিচার, রূপ আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়৷ সমাজদেহের গতি হয় রুদ্ধ৷ এ সব থেকে সমাজদেহকে তথা সমাজচক্রকে মুক্ত করে দিব্যস্পন্দন দ্বারা তার গতিতে প্রচণ্ড দ্রুতি এনে দিতে যুগপুরুষ তারকব্রহ্মরূপে বর্তমান যুগে পুনরায় আবির্ভূত হলেন৷ তারকব্রহ্ম যুগপুরুষ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী রূপে৷ সমাজের সার্বিক কল্যাণে তিনি দিলেন সর্বাত্মক জীবনাদর্শ, দিলেন যোগ ও বিদ্যাতন্ত্রভিত্তিক আধ্যাত্মিক অনুশীলন সামাজিক অর্থনৈতিকতত্ত্ব, প্রাউট, নব্যমানবতাবাদ ও আরও আরও? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রচনা করে ছিলেন মহাভারত৷ আজ উন্নত বিজ্ঞানের যুগে মহা বিশ্ব সংরচনার জন্য শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বিশ্বমানবতা সবকিছু উজার করেদিলেন৷ সার্থকরূপ পেল গীতার সেই ভবিষ্যতবাণী---.....সম্ভবামি যুগে যুগে
- Log in to post comments