পূর্ব প্রকাশিতের পর
কিন্তু অল্পদিন পরে যখন তারা বিজ্ঞানের প্রয়োগ বা ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তারা সেই সমস্ত বস্তুর বিরুদ্ধে সমালোচনা বা ঘৃণা প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয় ও যে সমস্ত বস্তু তারা ্বাধ্য হয়ে ব্যবহার করত, এখন সেগুলোর ব্যবহার তাদের পক্ষে সহজ হয়ে ওঠে, কারণ পুরাতন বস্তুর দুষ্প্রাপ্যতা বা স্বল্পতা হেতু, তারা ক্রমেই নোতুন দ্রব্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়৷
এ থেকে বলা যেতে পারে যে যারা বিজ্ঞানের সমালোচনা করে, তারা প্রকৃত প্রস্তাবে গঙ্গার ধারাপ্রবাহেকে উল্টোদিকে অর্থাৎ গঙ্গোত্তরীর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়---যা হচ্ছে সম্পূর্ণতই গতিধর্ম বিরোধী৷ এই ধরণের প্রচেষ্টা ঋণাত্মক মানসিকতার পরিচয় দেয়৷ সমস্ত জগৎটাকে উল্টো-পাল্টা করলেও সেই প্রাচীন ঋষির তপোবনের যুগ আর ফিরবে না, সাধারণ মানুষ কখনও মিলের কাপড় ত্যাগ করে গাছের াকল পরবে না কিংবা রাঁধা খাবার ফেলে রেখে কাঁচামাংস খেয়ে দিনাতিপাত করবে না৷ চীনীর যুগকে বাদ দিয়ে গুড়ের যুগে ফিরে যাওয়ার মধ্যে কোন মহত্ত্ব থাকতে পারে নদ্ধা৷ হতে পারে, যারা কদাপি চীনীর স্বাদ জীবনে উপলব্ধি করে নি, তারা স্বচ্ছন্দে গুড়ের যুগে থাকতে ভালবাসবে কিন্তু যে একদিন চীনীর সংস্পর্শে এসেছে, সে ভুলেও গুড়কে চরম স্বীকৃতি দেবে না৷ এটা হওয়ার কারণ, ক্রমে ক্রমে চীনী-মেশানো চায়ের সঙ্গেই যে তাদের সম্বন্ধটা অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অবশ্য এই ধরণের গুড়-চীনীর বিতর্কে ঢোকা অর্থহীন, কারণ গুড়ও তো একদিন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যেই আবিষৃকত দ্রয়েছিল৷
স্থুল ভৌতিকজগতের সংঘর্ষ সুপ্ত মানবশক্তিকে ক্রমেই প্রস্ফুট করে তোলে৷ পরিবেশগত প্রভাবও মানবদেহে জটিলতা পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়৷ প্রাচীন আধুনিক মানুষের সমস্যাবলী কোনক্রমেই এক ধরণের নয়৷ সমস্যার পরিবর্তনের গতিধারার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে মানবদেহ ও মন ক্রমেই জটিলতর হয়ে উঠেছে৷ প্রাচীন মানুষের দৈহিক কাঠামো আজকের সমস্যা সমাধানের পক্ষে অবশ্যই অনুপযুক্ত ছিল৷
মনের জটিলতার সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রত্যক্ষ স্থান স্নায়ুকোষগুলো ও পরোক্ষ স্থান গ্রন্থিগুলোর মধ্যে অনুরূপ প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে চলেছে৷ সমস্যার পরিবর্তনের জন্যে মানুষের মনও নোতুন নোতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়ায় নিযুক্ত হয়ে রয়েছে৷ এ থেকেই আমি লতে বাধ্য হচ্ছি যে বৈজ্ঞানিক অনুশীলনকে ক্রমেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ও তা’ কোনদিনই মানবপ্রগতির পরিপন্থী হয়ে উঠবে না৷ কিন্তু বিজ্ঞানের সমালোচকদের অধিকাংশই কেবল ভাবাবেগের মাথায় এই সহজ সত্যটা স্বীকার করতে চায় না তারা জানে না যে তারা তাদের অতীতের প্রতি অন্ধপ্রীতি দিয়ে তাদের মানসসত্তার গতিধারাকে স্থূলত্বের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে! এ দিয়ে তারা মনকে অধিকতর প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলছে ও গতিশীলতা হারিয়ে ফেলছে৷ আর যারা জীবনে চলার ছন্দকে হারিয়ে ফেলেছে, তাদি’কে তমসাচ্ছন্ন, স্থূল জড় লাই অধিকতর সমীচীন হবে৷
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনকে সর্বদাই বিভিন্ন প্রগতিশীল চিন্তা ও কর্মপদ্ধতিতে ব্যাপৃত থাকতেই হবে৷ এই সমস্ত নোতুন দায়িত্ব সম্পাদনে সক্ষম হবার জন্যে মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে চলেছে৷ এর সঙ্গে দৈহিক গ্রন্থিগুলোর কাঠামোও পরির্তিত হচ্ছে৷ এতে করে’ শুধু যে মানুষের দেহ ও মনের সংরচনা জটিলতর হচ্ছে তা নয়, মানুষের সমগ্র সমাজেও সেই জটিলতা এসে পড়েছে৷ বিভিন্ন সমস্যাও উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে৷ এই অবস্থায় আমরা কি শুধু অতীত গরিমার মহিমা কীর্তন করেই আত্মতৃপ্ত হয়ে চুপ করে বসে থাকবো? না---তা না করে আমাদের উচিত, যথাযথ বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের দ্বারা ওই স সমস্যার যথার্থ সমাধান বের করা? কথায় লে, যেমন তরবারি তেমনই তার আধার৷ এজন্যে যত জটিল সমস্যা আছে, ততই জটিল বৈজ্ঞানিক উপকরণের উদ্ভাবন করতে হবে৷ আমরা আদিম তীর ধনুক দিয়ে আধুনিক যুগের মহাশক্তিশালী আণবিক বোমার সম্মুখীন হয়ে নিশ্চয়ই হাস্যাস্পদ হতে চাই না৷
মানবদেহের অভ্যন্তরে জটিলতা যতই বাড়ছে, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণও ততই বেড়ে যাচ্ছে৷ বৈজ্ঞানিক প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এমনও ঘটতে পারে যে এই সন্দেহটাকে গোরক্ষপুরের কোন এক জায়গায় রেখে দিয়ে কেবল মস্তিষ্কটাকে লণ্ডনে পাঠানো যাবে৷ সেক্ষেত্রে দেহের ভারটাকে লণ্ডনে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন থাকবে না৷ এটা রূপকথার মত শুণতে লাগলেও নিশ্চিতই একইরকম ঘটতে চলেছে, যখন লোকে তাদের অঙ্গগুলো ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখে নিরাপদে নিদ্রাসুখ উপভোগ করতে পারবে৷
বর্ণচক্র বা শ্রেণীচক্র ক্রমাগত বিবর্তিত হয়েই চলবে৷ অর্থাৎ শ্রেণী-সংগ্রাম চলার সঙ্গে সঙ্গে কোন বিশেষ যুগে কোন বিশেষ গোষ্ঠী প্রাধান্য বিস্তার করবে৷ এখন বিজ্ঞান যদি পুরোপুরি তমোগুণী মানুষের আয়ত্তে থাকে তাহলে তার ফলও হবে নৈরাশ্যজনক৷ সেক্ষেত্রে আশার কথা এই যে, যদি ক্রমাগত কদর্য শ্রেণীসংগ্রাম চলতে থাকে তো শেষ অবধি মানুষ ঝবে যে একমাত্র সদ্বিপ্র ব্যতিরেকে আর কেউই সমাজের নেতা হতে পারে না৷ যাঁরা যম-নিয়মাদি নীতিগুলোকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেন, তাদেরই কলমে সদ্বিপ্র৷ এদের সামূহিক প্রচেষ্টার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবপ্রগতি তথা শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্ণ সম্ভাবনা৷ গণতন্ত্রও মানুষের সমস্যা সমাধানে সক্ষম নয়, কারণ গণতন্ত্রের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক প্রাধান্য বিস্তারের চরম সুযোগ পায়, অন্যদিকে আরেক দলের স্বাধীনতা শে কিছুটা ক্ষুণ্ণ্ হয়৷ যেহেতু গণতন্ত্রে কোন নীতিকেই চূড়ান্ত বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, তাই সহসা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঈর্ষা, হীনতা, অনৈতিকতা ইত্যাদি অয়াধে নিকড় গাড়বার সুযোগ পায়৷ অধিকন্তু, আপেক্ষিক সত্যগুলোকে নীতি হিসেবে পুনঃ পুনঃ স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে গণতন্ত্রের বর্ণ ও আকার পর্রির্তিত হয়ে থাকে৷ শ্রেণীহীন সমাজ-প্রতিষ্ঠা একমাত্র তাঁরাই করতে পারেন যাঁরা পরমপুরুষকে নিজের জীবনের লক্ষ্য করে নিয়েছেন ও যাঁদের সমগ্র মানস-শক্তি নিরবচ্ছিন্নভাবে সেই একই লক্ষ্যের দিকে প্রলম্বিত বা প্রযুক্ত হয়ে থাকে৷ শ্রেণী-সংগ্রামহীন সমাজে বাকি সকল শ্রেণীকে বিলীন হতেই হবে ও সমস্ত মানুগুলোকে একই আদর্শের আঙ্গিনায় এসে সমবেত হতে হবে৷ একমাত্র সদ্বিপ্রদের দ্বারাই এটা সম্ভব হতে পারে ও এজন্যেই বিশ্বের কল্যাণার্থে সদ্বিপ্রদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন৷
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)