সংকোচনেই দুঃখ, আর ব্যাপ্তিতে পাওয়া যায় সুখ৷ মানুষ যখন ক্ষুদ্র বুদ্ধি তথা ক্ষুদ্র ভাবনার দ্বারা প্রেষিত হয়ে কাজ করে তখন সে ছোট হয়ে যায়, দুঃখ পায়, আর বৃহৎ ভাবনা নিয়ে কাজ করলে আনন্দ পায়, শান্তি পায়৷ যে মানুষ ক্ষুদ্র ভাবনা নিয়ে কাজ করে তার কী হয়? তার পথই বা কী? তার পথ বিশ্লেষণের পথ৷ এককে খণ্ড খণ্ড করার পথ৷ আর যে বৃহৎ ভাবনা নিয়ে কাজ করে, সে কী করে? সে অনেককে এক করে৷ তার পথ সংশ্লেষণের৷ তাই, সংশ্লেষণই জীবন (synthesis is life) সংশ্লেষণেই শান্তি (synthesis is peace) আর বিশ্লেষণ মানে মৃত্যু (analysis is death)৷
‘‘পিতা কস্য মাতা কস্য কস্য ভ্রাতা সহোদরাঃ৷
কায়া প্রাণে সম্বন্ধঃ কাকস্য পরিবেদনা৷৷’’
মানুষ যখন নিজেকে ছোট করতে থাকে, ছোট করতে করতে শেষে দেখে– যিনি পিতা তিনিও নিজের নন, যিনি মাতা তিনিও নিজের নন, এমনকি সহোদর ভাই–বোনও নিজের নয়৷ তারপর, ‘কায়া প্রাণেন সম্বন্ধঃ’– শরীর আর প্রাণের মধ্যেও লাড়াই, এরাও এক নয়, দু’টো পৃথক সত্তা৷ শরীর আর প্রাণের মধ্যেও বিবাদ৷ তাহলে কেউই নিজের নয়৷ এইভাবে যখন মানুষ দেখে জগতে কেউই তার আপন নয় তখন তার ভিতরে হাহাকার শুরু হয়ে যায়, মনে শান্তি থাকে না৷ মরার আগেই সে মরে যায়৷ তাই সমস্ত দুঃখের পেছনে কারণটা কী? – না, বিশ্লেষণ৷ আর সমস্ত সুখের পেছনে কী কারণ? – না, সংশ্লেষণ৷
এই যে সংশ্লেষণাত্মক গতি– অনেককে এক করার প্রয়াস– এটাই সাধনা৷ সাধনা ‘আমিত্ব’কে ছোট করার জন্যে নয়, ‘আমিত্ব’কে বাড়াতে বাড়াতে অনন্ত করে দেওয়া৷ তাতে কী হবে? – না, যেদিকে তাকাবে সবেতেই ‘আমি’কে দেখবে৷ সকলের প্রতি সমদৃষ্টি, সবেতেই হবে আত্মদর্শন৷ আর ছোট করলে কী হবে? যেদিকে তাকাবে সবাই ‘পর’ মনে হবে, নিজের বলে কেউ থাকবে না৷ আর এই যে সংশ্লেষণাত্মক গতি, যাকে বলে ‘সাধনা’ তাকে ‘পুণ্য’ও বলা হয়৷ এটাই পুণ্য৷ মানুষের কাজ কী? ‘কুরু পুণ্যম্ অহোরাত্রম্’৷ মানুষের কর্ত্তব্য কী? অহোরাত্র কেবল পুণ্যকর্ম করা৷
অহোরাত্র কাকে বলে? একটা সূর্যোদয় থেকে দ্বিতীয় সূর্যোদয় পর্যন্ত যে সময়কাল, তাই অহোরাত্র৷ এক্ষেত্রে প্রাচ্য (oriental) ও পাশ্চাত্ত্য (occidental) দৃষ্টিভঙ্গি পৃথক৷ পাশ্চাত্ত্য দৃষ্টিতে রাত্রির শূন্যকাল থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্ঢা পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম দিন রাত বারোটা থেকে পরের দিন রাত বারোটা পর্যন্ত হচ্ছে এক দিন৷ প্রাচ্যের নিয়ম হ’ল একটা সূর্যোদয় থেকে আরেকটা সূর্যোদয় পর্যন্ত৷ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে সময় তাকে বলা হয় দিনমান আর সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় রাত্রিমান৷ দিনমান + রাত্রিমান = অহোরাত্র৷
‘কুরু পুণ্যম্ অহোরাত্রম্’৷ কর্ম যদি করতেই হয় কেবল পুণ্যকর্ম কর৷ আর পুণ্যকর্ম কী? সংশ্লেষণ৷ অনেককে এক করা, এককে অনেক নয়৷ ‘একজন মানুষ’ বললে সেটা হবে সংশ্লেষণ আর বিশ্লেষণ করলে মানুষের নাক, কান, মুখ পৃথক পৃথক হয়ে যাবে৷ কোন্টা বেশী গুরুত্বপূর্ণ, কোন্টা কম– এই নিয়ে লড়াইও হতে পারে৷ মাথা বলবে আমার গুরুত্ব বেশী পেট বলবে, ‘আমি কাজ করব না, দেখি কীভাবে চলে৷’
বৈয়ষ্টিক জীবনে সুখ তথা শান্তি পাওয়ার জন্যে এই যে কৌশল, পারিবারিক জীবনে সংঘ জীবনে বা রাষ্ট্রীয় জীবনেও সেই একই কথা৷ সংশ্লেষণেই সুখ৷ তাহলে প্রকৃত শিক্ষাটা কী? শিক্ষা কেমন হতে হবে? সব সময়ই সংশ্লেষণাত্মক, কখনওই বিশ্লেষণাত্মক নয়৷ তাই না বলা হয়েছে, ‘‘কুরু পুণ্যম্ অহোরাত্রম্’’৷
যে মানুষ একথা বুঝে নিয়ে দিনরাত পুণ্যকর্ম করে, সংশ্লেষণের পথ ধরে চলে, তার সম্পর্কে বেদে বলা হয়েছে ঃ
‘‘ইদং মানুষং সর্বেষাং ভূতানাম্ মধ্বস্য মানুষস্য সর্বাণি ভূতানি মধু৷
অয়মাত্মা সর্বেষাং ভূতানাং মধ্বস্যাত্মনঃ সর্বাণি ভূতানি মধু৷৷’’
এই প্রকারের যে মানুষ, এ যে কেবল নিজে একজন মানুষ তাই নয় – এই পৃথিবীর আর যে সমস্ত বস্তু আছে, সব বস্তুই তার কাছে ‘মধু’র মত মিষ্টি৷ মধু খুব মিষ্টি জিনিস, খুবই মিষ্টি৷ পৃথিবীতে কেউই পর নয়, সবকিছুই তার কাছে আপন৷
‘ইদং মানুষং সর্বেষাং ভূতানাম্ মধ্বস্য মানুষস্য সর্বাণি ভূতানি মধু৷’ এ ধরনের মানুষের কাছে পৃথিবীর সব কিছুই মধুর মত, মধু সম মিষ্টি অর্থাৎ তেতো নয়৷ মানুষ তার নিজের ব্যবহারের দ্বারা মধুকে তেতো করে দেয়৷ আসলে কোনকিছুই তেতো নয়, মিষ্টি৷
‘‘ন কশ্চিৎ কস্যচিৎ মিত্রং ন কশ্চিৎ কস্যচিৎ রিপুঃ৷
ব্যবহারেণ মিত্রাণি জায়ন্তে মানবা রিপবস্তথাঃ৷৷’’
এই পৃথিবীতে কেউ কারো শত্রুও নয়, আবার মিত্রও নয়৷ ব্যবহারের জন্যে কেউ শত্রু হয়ে যায়, আর কেউ মিত্র৷ কিন্তু এ ধরনের মানুষের কাছে পৃথিবীটাই মধুময়, আর পৃথিবীর কাছে মানুষটাও মধুময়৷ মানুষের সঙ্গে এমন ব্যবহার করো যাতে তোমার সঙ্গে সকলে মধুর ব্যবহার করে আর তুমিও সবার কাছে মধুময় হয়ে ওঠো৷
‘‘অয়মাত্মা সর্বেষাং ভূতানাম্ মধ্বস্য মানুষস্য সর্বাণি ভূতানি মধু৷’’
এই যে আত্মা, এ সবার কাছে মধুময় হোক– সমস্ত বাইরের বস্তুর কাছে মধুময় হোক তোমার শরীরের কাছে মধুময় হোক, তোমার মনের জন্যে মধুময় হোক৷ মানুষ যেখানে প্রকৃত ব্যবহার শেখে না, সংশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি রাখে না, সেখানে তার আত্মাও মধুময় হয়ে ওঠে না৷ আর যখন সে অনুভব করে যে তার নিজের অবাঞ্ছিত আচরণের জন্যে তার আত্মা মধুময় হতে পারছে না, তখন সে কী করে? তখন সে মনকে আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়, আর সেই অবস্থায় সে আত্মহত্যা করে বসে৷ আত্মহত্যার পেছনে এটাই হ’ল মনোবিজ্ঞান (psychology)৷ আত্মা তখন তার কাছে মধুময় বলে মনে না হলেও আসলে আত্মা তো মধুময়ই৷