কলিযুগ কী? যখন মানুষ ৰৌদ্ধিক অব্যবস্থা, ৰৌদ্ধিক অমিতব্যয়িতাকে নিয়ে চলতে থাকে, যখন তার শরীর ও মন আছে অথচ তার কর্মধারা বা আচরণ পশুর সমান হয়ে গেছে, সেই অবস্থাকেই বলে কলিযুগ৷ যে শুয়ে আছে, কী করতে হবে না করতে হবে ৰুঝতে পারছে না, সেই অবস্থাকে বলব কলিযুগ৷ বর্ত্তমান বিশ্বে চলছে কলিযুগ বিদ্বান ৰুদ্ধিমান ব্যষ্টি আর ধর্মের ব্যাখ্যাকারীরাও বলেন যে এটা কলিযুগ৷
ধর্মের স্বভাব কী? ‘ধর্ম রক্ষতি রক্ষিতঃ’৷ যে ধর্মের রক্ষা করে তাকে রক্ষা করা ধর্মের পক্ষে আবশ্যিক কর্ত্তব্য হয়ে যায়৷ বর্ত্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিত? ধর্মরক্ষা করার জন্যে, নিজেকে বাঁচানোর জন্যে সংঘটিত হতে হবে, একতাৰদ্ধ হতে হবে, প্রতিটি ক্ষেত্রে সকলে মিলেমিশে কাজ করতে হবে৷ এইজন্যে বলা হয়েছে–‘সঙেঘ শক্তিঃ কলৌ যুগে’৷
যেখানে সমাজে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এই ৰোধ আছে যে সে মানুষ, তাকে কী করা উচিত বা না করা উচিত এই ৰোধও আছে আর তার জন্যে চেষ্টাশীলতাও আছে, তাকে বলে ত্রেতাযুগ৷ যেখানে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এই ৰোধ আছে যে কী করা উচিত বা না করা উচিত আর তারা শুধু চেষ্টাশীলই নয়, কাজও শুরু করে দিয়েছে তাকে বলে সত্য যুগ৷ বলা হয় যে, এটা কলিযুগ৷ কিন্তু যে ৰুঝে গেছে এটা কলিযুগ, তার কর্ত্তব্য হচ্ছে এই কলিযুগে মানবতাকে বাঁচানোর জন্যে সংঘটিত হওয়া৷ এই একতাই মানব জীবনকে বাঁচাবে৷
মানব জীবন কাকে বলব? মানব জীবন হচ্ছে এই চার অবস্থার সমষ্টি–জাগ্রত, স্বপ্ণ, সুষুপ্তি আর তুরীয়৷ এর মধ্যে আছে ভৌতিক জগৎ, মানসিক জগৎ, কোয়ালিফাইড স্পিরিচুয়াল ওয়ার্ল্ড (সগুণ আধ্যাত্মিক জগৎ)৷ এই যে আধ্যাত্মিক জগৎ তা সাধকের সঙ্গে সর্বদা আছে আর সর্বদা থাকবে৷ সাধক যখন চিন্তাশীল ও জীবিত আছে, তার সঙ্গে সগুণ আধ্যাত্মিক জগৎও থাকবে৷
প্রথমের যে দু’টো ক্ষেত্র আছে অর্থাৎ ভৌতিক আর মানসিক ক্ষেত্র, এর মধ্যে ৰৌদ্ধিক ক্ষেত্রে মানুষকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে৷ কেননা অধিকাংশ মানুষ পাষণ্ড আর পাষণ্ডের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যে ভৌতিক একতা আর মানসিক একতা অত্যাবশ্যক৷ মানুষ সেখানে শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে, মহান উদ্দেশ্য নিয়ে মিলিতভাবে কাজ শুরু করে দেয়, যেখানে তাদের দ্বারা উদ্দেশ্যের পূর্ত্তি অবশ্যই হয়৷ যেখানে মহৎ ভাবনা আছে, যেখানে ৰৃহৎ ভাবনা আছে সেখানে পরমপুরুষের আশীর্বাদ তার সঙ্গে অবশ্যই আছে–সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন নেই৷ পরমপুরুষের কাছে জিজ্ঞাসা করার কোনো প্রয়োজন নেই যে এই কাজে তাঁর সমর্থন আছে কী না, এই সংকল্পের সাথে তাঁর আশীর্বাদ আছে কী না৷ এটা স্বতঃসিদ্ধ যে প্রত্যেক সৎকার্মের সঙ্গে পরমপুরুষের আশীর্বাদ আছে৷ অসৎ কর্মে পরমপুরুষের সমর্থন থাকে না–এটা পরমপুরুষের অভিশাপ৷ এইজন্যে পাপ আর পুণ্যের মধ্যে সেখানে দ্বন্দ্ব হবে সেখানে এটা স্বতঃসিদ্ধ যে পুণ্যের জয় হবে আর পাপের বিনাশ হবে৷
এই সংসার পরমপুরুষের লীলা বিকাশ৷ লীলাত্মক বিকাশই পরমপুরুষের লীলা৷ এটা কী রকম? তিনি একের সঙ্গে অন্যকে লড়িয়ে দেন, পাপের সঙ্গে পুণ্যের সংগ্রাম করিয়ে দেন, আর নিজে বসে দেখতে থাকেন যে কী রকম লড়াই চলছে৷ যদি তিনি দেখেন যে ভাগ্যচক্রে পুণ্যের পরাজয় হতে যাচ্ছে, তিনি পুণ্যের পক্ষে প্রয়োজনীয় শক্তি দিয়ে দেন৷ এই বিশ্বনাট্যে তাঁর এটাই ভূমিকা৷ তিনি এই নাটকের দর্শক মাত্র, নাটকের পাত্র নন৷ কোনো দর্শক যদি না থাকে, নাটক অনুষ্ঠিত হতে পারে না৷ দর্শক না থাকলে নাটকের পাত্র–পাত্রী হতোৎসাহিত হয়ে পড়ে– কেউ উপস্থিত নেই, তাহলে নাটক করে কী হবে এই নাটকের যিনি মূখ্য দর্শক তিনিই পরমপুরুষ৷ যদি সাধু আঘাতপ্রাপ্ত হয় তাহলে তার সহায়তা করা তার কর্ত্তব্য হয়ে যায়৷
এই যে সাধু–সাধুর মধ্যে সংগ্রাম, এটা হয় ভৌতিক ক্ষেত্রে আর মানসিক ক্ষেত্রে, স্থূল ও সূক্ষ্মলোকে৷ এই সংগ্রামে সাধকের জয় অবশ্যই হয়৷ এটা কী রকম? যদি সাধক জীবিত থেকে গেল তবে তো অবশ্যই জয় হবে, আর দুর্ভাগ্যবশতঃ সংগ্রামে তার মৃত্যু হয়ে গেল, তাতেও সাধকের জয় অর্থাৎ সর্ব অবস্থাতেই জয়৷ ভগবান বলেন যে সংগ্রামে সাধক যদি জীবিত থেকে গেল তাহলে জগতে সত্যের প্রতিষ্ঠা তারা করে দেবে আর যদি মৃত্যু হয়ে গেল তো তৎক্ষণাৎ মোক্ষপ্রাপ্ত হয়ে যাবে৷ আর পরমপুরুষকে সে যেরকম বলবে–যদি এ রকম বলল, ‘‘হে পরমপুরুষ, আমি আবার শরীর ধারণ করতে চাই, আবার কাজ করতে চাই’’,–তবে সেটাই সে প্রাপ্ত হবে৷ যদি বলে, ‘‘হে পরমপুরুষ, আমি তোমার সঙ্গেই থাকতে চাই’’, তাহলে সে সেটাই পাবে অর্থাৎ এই স্বাধীনতা সাধকেরই আছে, পরমপুরুষের নয়৷
এই যে ভৌতিক মানসিক সংঘর্ষের মাধ্যমে মানুষ এগিয়ে চলে, তার ফলস্বরূপ গুণাত্মক ধর্ম আর গুণাতীত ধর্ম–এই দুইয়েই তার প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়৷ যে এই সংঘর্ষে ভয় পায় সে মনুষরূপে তো থাকতেই পারে না–জীব রূপেও থাকে না৷ সে ইট, কাঠ, পাথরে পরিণত হয়৷ জীবিত প্রাণীরূপে নিজের পরিচয় দেবার অধিকার হারিয়ে ফেলে৷ আমি তো বলব যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করে সেই–ই সাধক–তারাই আমার পুত্র আর কন্যা৷ যার মধ্যে আন্তরিক বা বাহ্যিক সংঘর্ষ করবার সাহস নেই তারা ক্লীব, নপুংসক, হিজড়ে৷
গীতাতে একবার সংগ্রাম শুরু হবার ঠিক পূর্বে এই দুর্বলতা প্রথমে অর্জুনের মনে এসে গেছিল যে এতো আত্মীয়, এতো এই, এতো ওই ইত্যাদি৷ যেখানে আদর্শের সংঘর্ষ সেখানে আত্মীয়স্বজন ইত্যাদি ভাবনা কিছুই থাকে না৷ তুমি আছ, তোমার সঙ্গে আছে তোমার ধর্ম৷ ধর্মই সবচেয়ে বড় মিত্র৷ ‘এক এব সুহূদ ধর্ম নিধনেপি অনুযাতি’– মানুষের সুহূদ একই সত্তা৷ সেটাই ধর্ম৷ সে মৃত্যুর পরেও সঙ্গে থেকে যায়৷ আর জগতে যত তার সুহূদ বা বন্ধুজন থাকে তারা বড় জোর শ্মশান পর্যন্ত যাবে, সেই পর্যন্ত সঙ্গ দেবে৷ তারপরে নিজের নিজের ঘরে চলে যাবে, তোমার সঙ্গে থাকবে না৷ ধর্ম হচ্ছে সংঘর্ষময়৷ ধর্মের জন্যে সাধক সংগ্রাম করবে, সংগ্রাম বিনা ধর্মসাধনা হয় না ধর্মসাধনা এক সমর, সাধনা হচ্ছে সংগ্রাম৷ কেবল ঘরে বসে থেকে, জানালা বন্ধ করে ধর্ম–সাধনা হয় না৷ মনের ভেতরকার সংগ্রাম আর বাহ্যিক জগতেও সংগ্রাম, এই দুই কু–প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে তুমি সংগ্রাম করে চলেছ৷
বহির্জগতে ধর্মসাধনার স্বরূপটা কী? বহির্জগতে হীনাচারী আছে, দুষ্ট লোক আছে, পাপী আছে, এদের সকলের বিরুদ্ধে নির্মমভাবে লড়াই করতে হবে৷ সেখানে মমতা দেখানো এক দুর্বলতা, কাপুরুষতা সেই অবস্থায় মমতা থেকে দূরে থাকবে৷ তাই অর্জুনের মধ্যে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্বলতা এসে গিয়েছিল, কৃষ্ণ তাকে এই রকমই ৰুঝিয়ে ছিলেন যে এই প্রকারের মমতা বা দুর্বলতা হচ্ছে ক্লীবতা, নপুংসকতা৷ হে পার্থ, হে অর্জুন, এর থেকে দূরে থাকো৷ ক্লীবতা থেকে দূরে থাকো, ক্লীবতা থেকে মৃত্যুও ভালো৷ ক্লীবতার পরিণাম কী হয়? তারা মনুষ্যরূপে থাকে না৷ কুকুর বা বিড়ালের শরীরও সে প্রাপ্ত হয় না৷ সে হয়ে যাবে পাথর৷ তোমরা সাধক, তোমরা আমার পুত্র–কন্যা, তুমি কার থেকে ভীত হবে? কেন ভয় পাবে? তুমি পাপের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নির্মমভাবে সংগ্রাম করে চলো৷ জয় তোমারই হবে৷ মনে রাখবে ‘সঙেঘ শক্তিঃ কলৌ যুগে’৷