আমি ইতোপূর্বেই বলেছি যে মানুষের মধ্যে যতটা সামর্থ্য রয়েছে মানুষ তার খুব অল্প অংশই কাজে লাগায়৷ লতে গেলে তার সামর্থ্যের শতকরা এক ভাগও প্রয়োগ করে না৷ আর সমাজ যাদের মহাপুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, দেখা যায় তারাও বড় জোর শতকরা দশভাগ সামর্থ্যের উপযোগ নেয় আর বাকী শতকরা নববই ভাগ অব্যবহৃত থেকেই যায়৷ সাধারণ ভাবে লতে গেলে, মানুষ তার সামর্থ্যের নববই ভাগই কাজে লাগায় না৷ স্থূল ব্যষ্টি যারা তারা তো তাদের অন্তর্নিহিত সামর্থ্যের অর্ধেকটা কেবল শুয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়৷ বাকি সামর্থ্যের খুব অল্প ভাগই সে প্রকৃত কাজে লাগায়৷
স্থূল শরীর মানে দৈহিক সামর্থ্যযুক্ত এই কাঠামোটা৷ আর মানসিক ও আধ্যাত্মিক সামর্থ্য তো অব্যবহৃত থেকেই যায়৷ এই যে সামর্থ্যের পুরোপুরি প্রয়োগ হচ্ছে না---এর পেছনে কারণগুলো কী কী? একটা হচ্ছে---মানুষের ঠিক পথটা জানা নেই৷ কী করা উচিত, কী ভাবে করা উচিত---এসব বিষয়ে ঠিক জ্ঞানের অভাবই হ’ল মুখ্য কারণ৷ গৌণ কারণটা হচ্ছে---মানুষের স্বভাবগত আলস্য৷ মানসিক সামর্থ্যের প্রয়োগের ক্ষেত্রে মানসিক আলস্য ও আধ্যাত্মিক সামর্থ্যের প্রয়োগের ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক আলস্য লক্ষ্য করা যায়৷
লক্ষ্য করা গেছে, বহু লোক খুব অল্প বয়সেই, এমন কি তার-চউদ্দ বছর বয়সেই ভাবতে শুরু করে দেয়, কীভাবে তাদের মানসিক সামর্থ্যের ষোল আনা উপযোগ হওয়া উচিত৷ তারা কম বয়সেই ভাবতে থাকে যে আধ্যাত্মিক সাধনা করা উচিত৷ কিন্তু আলস্যবশতঃ তারা তা করে না৷ এই অলসতাবশতঃ মানুষের সে সামর্থ্য potentiality) সেটা অব্যবহৃত থেকে যায়৷ পরে তাতে মর্চে ধরে যায়৷
এই পৃথিবীর যারা বড় বড় মহাত্মা ব্যষ্টি, বৌদ্ধিক তথা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তাঁরাও তাঁদের সামর্থ্যের শতকরা মাত্র দশভাগ কাজে লাগান৷ এটা বড়ই দুঃখের ব্যাপার৷ আবার এর চেয়েও অধিকতর দুঃখপ্রদ হচ্ছে এই যে, এমন কিছু লোক রয়েছে যারা মানুষের সমগ্র সামর্থ্যের পূর্ণ উপযোগ চায় না৷ এটা শুধু লজ্জার কথা নয়, অত্যন্ত নিন্দার কথা যে মানুষটা নিজে তো কিছু করবেই না, উপরন্তু অপরকে কোনো কিছু করতে দেবেও না৷ ওরা চায় না যে অপর কেউ উন্নতি করে৷ আমি যেহেতু এগিয়ে চলছি না, তাই অন্যেও যেন এগিয়ে না যায়---এই যে মানসপ্রবণতা এটা অবশ্যই নিন্দনীয়, বিপজ্জনকও৷ তারা কেমন করে এটা করে তা তোমরা অবশ্যই দেখেছ জেনেছ৷ ধরো, একটা লোক দেখতে খুবই কালো৷ ওর সঙ্গীসাথীরা,এমন কি ওর সুকলের শিক্ষক পর্যন্ত ওকে কেলো ভূত লে নিন্দে করে৷ এতে ওর মন অবদমিত হয়ে পড়ে, সামর্থ্যও রুদ্ধ হয়ে যায়৷ সে ভাবতে শুরু করে---আমি ছোট, আমি নীচ, আমি তো কুশ্রী ইত্যাদি৷
কারো হয়তো তথাকথিত নীচ বংশে জন্ম হ’ল তো লোকেরা তারে জাত-পাত তুলে বলবে---আরে! ওর আবার কী লেখাপড়া হবে! এর ফলে যার বিরুদ্ধে এই ধরণের নিন্দা বা কটুক্তি করা হয় তার মন কুণ্ঠিত হয়ে পড়ে, তার অগ্রগতিও রুদ্ধ হয়ে পড়ে৷ ঠিক তেমনি যে লোকটা গরীব, যার একেবারে টাকা-পয়সা নেই, সেই লোকটাকে অন্যে তার আর্থিক দুর্গতির সুযোগ নিয়ে অবদমিত করে রাখার চেষ্টা করে৷ হয়তো কোনো একটা গরীব মেধাবী ছেলে বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে লেখাপড়া করে এগিয়ে যাচ্ছে৷ ঈর্ষাপরায়ণ নিন্দুক ব্যষ্টিরা কটূক্তি করে বলে---চাকর-বাকরের কাজ-টাজ ধরো, লেখা-পড়া শিখে কী আর হবে! এর ফলে অনেক ভাল ভাল দ্ধিমান, প্রতিভাবান মানুষের সামর্থ্য নষ্ট হয়ে যায়৷ এটা শুধু দুঃখ বা লজ্জার কথাই নয়, এটা হ’ল মানুষকে দমন (oppression), অবদমন, (suppression), প্রদমন (repression), আর শোষণ (exploitation) করা৷ এর ফলে বহু মানুষের প্রতিভা স্ফূরণের পথটাই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে৷ একেই দর্শনে লা হয়ে থাকে বৌদ্ধিক শোষণ intellectual exploitation)৷ তোমরা এর বিরুদ্ধাচরণ করবে৷
লা হয়ে থাকে যে স্বাভাবিক সামর্থ্যের পুরো উপযোগ তো হয়-ই না, কেউ যদি কেবল শতকরা দশ ভাগ সামর্থ্যের উপযোগ করলেন তো তাঁকে সমাজে মহান ব্যষ্টি লে গণ্য করা হয়৷ এখন কেউ যদি সামর্থ্যের শতকরা এক শ’ ভাগই প্রয়োগ করলেন তাহলে না জানি কী হয়ে যাবে৷ এর পেছনে কারণটা হ’ল ঠিক পথ সম্বন্ধে অজ্ঞতা৷ দ্বিতীয় কারণ ঃ অলসতা৷ তৃতীয় হ’ল ঃ ঠিক পথের খোঁজ পেলেও আর অলস না হ’লেও যদি কারুর ওপর স্বাভাবিক চাপ অথবা বৌদ্ধিক চাপ অথবা কোন সামাজিক চাপ থাকে, তাহলেও বড় বড় প্রতিভার স্ফূরণ হয় না, তার বিকাশ ব্যাহত হয়ে পড়ে৷ তাই তিন নম্বর কারণটা হ’ল খুবই ক্ষতিকারক৷
তোমরা এই ধরণের সামাজিক-বৌদ্ধিক শোষণ socio-intellectual exploitation) হতে দিও না৷ দেখবে, সমাজে এমনও মানুষ পাবে যারা নিম্ন শ্রেণীর ছোট ছোট পাপ কাজ করে থাকে৷ এখন এই রকম লোকদের তুমি যদি বার বার পাপী লে সম্বোধন কর, তা’হলে তার মনে এই ধারণাই বদ্ধমূল হবে যে আমি পাপী, আমি হীন, আমি নীচ ব্যষ্টি, আমার কোন ভবিষ্যৎ নেই৷ তোমরা এমনটা করবে না৷ ওর মধ্যে কী কী সদ্গুণ রয়েছে সেগুলো খুঁজে বের করবার চেষ্টা করবে ও সেই সদ্গুণগুলোর প্রশংসা করবে৷ তার ফলে সে তখন ভালো পথে চলা শুরু করে দেবে, ভাবতে শুরু করে দেবে, তা হলে এই পৃথিবীতে আমারও প্রশংসা করার লোক আছে৷ সে তখন উৎসাহিত হয়ে আরো বেশী করে এই দিকটারই অনুশীলন করবে৷ তার মধ্যে যে যে সদ্গুণ রয়েছে সেই সেই দিকে বেশী করে নজর দেওয়ার মধ্যে যে পাপ ছিল, দোষ ছিল সেগুলো ক্রমশঃ কমে আসতে থাকবে৷ আর কিছুদিন পরে ওই মানুষটাই পাপ কাজ করা এর্কোরে বন্ধ করে দেবে৷ তার মন কেবল ভালো কাজেই ব্যস্ত থাকবে৷ তাই লি, মানুষের সদ্গুণের প্রশংসা করেই উৎসাহ যোগাও৷ তথাকথিত পাপী-তাপীদের চারিত্রিক সংশোধনের অন্যতম উপায় হ’ল প্রশংসা করা৷ পাপীকে পাপী লে অবজ্ঞা করলে তার প্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায়৷ তাতে সে অধিকতর পাপী হয়ে যাবে৷ তথাকথিত পাপীকে বার বার পাপী ললে ও তাকে সামাজিক শাস্তি দিলে তার পাপ-প্রবণতা আরও বেড়ে যায়৷ ধরো, কোন মানুষ পাপের পথে এগোচ্ছিল৷ মনের পুরো শক্তি নিয়েই পাপপথে এগিয়ে চলছিল৷ অবশ্য তার মধ্যে দু’-চারটা সদ্গুণও ছিল৷ এখন তুমি যদি সেই গুণগুলোর প্রশংসা করে দিলে তো সে তখন পাপের পথে না গিয়ে তার বিরুদ্ধে চলা শুরু করে দেবে, অর্থাৎ তার অস্তিত্বে বড় রকমের একটা দিক-পরিবর্তন ঘটে গেল৷ এটাই হ’ল ঠিক পথ৷ তা না করে বার বার তাকে কেবল পাপী লে অবজ্ঞা করলে সে তখন তার অন্তর্নিহিত সদ্গুণের চর্চা তো করবেই না, বরং সে পাপের পথকে এত জোরে আঁকড়ে ধরবে যে একদিন সে সমাজের একটা মস্ত বড় বোঝায় পরিণত হবে৷ মানুষ মানুষের এই মনস্তত্ত্বটা না জানায় তাকে একটা বিরাট সামাজিক বোঝায় পরিণত করে৷
অবজ্ঞাত, অবহেলিত মানব আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে মনে মনে ভাবতে শুরু করে---আমি যখন একবার পাপের পথে নেবেছি, আমি যখন পতিত হয়েছি তখন একেবারে নরক পর্যন্ত দেখে তবে ছাড়বে৷ এইজন্যে দেখো, তোমাদের অজান্তে যেন এই ধরণের মনস্তত্ত্ববিরোধী কাজ না হয়ে যায়৷ আর তোমরা এটাও দেখবে যে সমাজে যেন অন্যান্য লোকেরাও এই ধরণের অপকর্ম করার সুযোগ না পায়৷ কেন না পাপীকে তিরস্কার করলে সে ভালো মানুষ হয় না৷ তাই পরোক্ষভাবে চাপ দিয়ে ও বাহ্যিক আকর্ষণের দ্বারা, পরমপুরুষের প্রতি আকর্ষণের দ্বারা খারাপ মানুষও ভাল মানুষে পরিণত হয়৷ দুষ্টকে ধর্মপথে নিয়ে এসো৷ দেখবে সে তখন পরমপুরুষের আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করেছে আর সঙ্গে সঙ্গে ওই মানুষটির মধ্যে যে যে সদ্গুণ নিহিত রয়েছে সেগুলো প্রোৎসাহিত করো৷ এটাই ঠিক মনস্তাত্ত্বিক উপায়, সত্যিকারের সংশোধনের রাস্তা৷
তা হলে এখানে দু’টো কথা এসে পড়ছে৷ এক, হতের আকর্ষণ দুই, সামাজিক চাপ৷ হতের আকর্ষণের ফলে সে ধর্মপথে চলতে শুরু করে দেবে৷ আর সামাজিক চাপের ফলে তার অভ্যন্তরীণ সদ্গুণগুলো বাহ্যিক স্ফূরণের সুযোগ পাবে৷ সামাজিক চাপ মানে কাউকে সমাজচ্যুত করা নয়, কাউকে সমাজ থেকে বার করে দেওয়া নয়, তাকে জল, আগুন ইত্যাদির সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া নয়---এগুলো ঠিক সামাজিক চাপ নয়৷ এপথে কোন লাভ হয় না, কোন কাজই হয় না৷ বরং তাতে প্রতিপক্ষের জিদ্ আরো বেড়ে যায়৷ তাহলে সামাজিক চাপ লতে ঠিক কী বোঝায়---না, সেই লোকটার ভালো দিকটাকে তার সদ্গুণগুলোকে প্রোৎসাহিত করে, তার অস্তিত্বের দিক পরিবর্তনে সহায়তা করা৷ মানুষের কাজ একটাই৷ যা ক্ষতিকরর, যা খারাপ---সেগুলো সরিয়ে দাও৷ যে বা যারা সমাজের স্বার্থবিরোধী কাজ করবে তোমরা তার বিরোধিতা করবে৷ চলার পথে তোমাদের এই শ্লোগান হোক---মানুষকে আর শোষণ করা চলবে না, শোষণ করা চলবে না৷ Human exploitation—no more, no more৷