শোষণ-যন্ত্রের কি নামান্তর গণতন্ত্র

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

রাষ্ট্রযন্ত্রকে সুচারুরূপে পরিচালনার নিমিত্ত এ যাবৎ মানুষ যা কিছু প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছে, সেগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রকেই অধিকাংশ রাষ্ট্র-বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদগণ সর্বসেরা বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন৷ গণতন্ত্রকে বলা হয়েছে ‘জনগণের নিমিত্ত ‘জন-প্রতিনিধিত্বের দ্বারা’ জনস্বার্থে জনগণের শাসন’৷ অর্থাৎ, মানুষ বাঁচার ও বিকাশের পথ ধরে এগিয়ে চলার উদ্দেশ্যে যে সমাজ-রচনার প্রয়োজন বোধ করেছিল পরবর্তী সময়ে সেই সমাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যেই অনুভব করতে পেরেছিল উপযুক্ত শাসন প্রক্রিয়ার৷ তারপরে ধাপে ধাপে শাসন-কার্যের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরীক্ষালব্ধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই একদিন উপলদ্ধি করতেও সক্ষম হয়েছিল--- গণতন্ত্রই হল সব প্রক্রিয়ার সেরা প্রক্রিয়া, কেননা যে সমাজ-ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয়-পরিচালনাতন্ত্র, দেশ-শাসন ইত্যাদি যা-ই বলা হোক না কেন--- এতসব কিছুর মূলে তো একটাই উদ্দেশ্য আর যে উদ্দেশ্যটা হচ্ছে জনকল্যাণ ও জনস্বার্থ অক্ষুণ্ণ্ রাখা, যেহেতু সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র হচ্ছে  সব কিছুরই কেন্দ্র-বিন্দুতে জনগণ অর্র্থৎ মানুষ৷ আর জনগণ নিয়ে যেহেতু জনস্বার্থ অর্থাৎ জনস্বার্থ কথাটির তাৎপর্যেই সমষ্টিগত স্বার্থ রয়েছে, দেশ, যে-কোন শব্দেই সমষ্টি-স্বার্থটাই সামনে চলে আসছে সেজন্যে ব্যষ্টিস্বার্থটা এখানে গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সেজন্যেই রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, স্বৈরাচার তথা অটোক্র্যাসী, সামন্ততন্ত্র বা ফিউডালিজম, জমিদারী-প্রথা, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ--- এগুলো মানুষের সুস্থ -মস্তিষ্কের চিন্তাধারায় ‘‘বর্জনীয়’’ বলে পরিত্যক্ত হয়ে এ যুগে ‘গণতন্ত্র’ বা ডেমোক্র্যাসী’-র সপক্ষে বলিষ্ঠ জনমত তৈরী হয়েছে৷ সুস্থ মানসিকতার বিচারেই সামরিকতন্ত্রের বাক্‌সে বোট কম পড়েছে৷ এমনকি কম্যুনিজম তথা মার্কনিজমও যেহেতু ব্যষ্টি-স্বার্থকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা বা  অস্বীকার করেছে অথচ সমষ্টিস্বার্থকে সর্বদা গুরুত্ব দিতে গিয়ে৷ আবার গোটা সমাজকেই দ্বিধা বিভক্ত করে বুর্র্জেয়াদের অর্থাৎ ‘হ্যাভস্‌’-দের  (ধনীদের) কথা অস্বীকার করে গিয়ে প্রলেতারিয়েতদের মাথায় মুকুট পরাবে বলেও কার্যক্ষেত্রে পেশী-শক্তিতে বা মস্তিষ্ক শক্তিতে বলশালীদেরই  প্রকারান্তরে প্রাধান্য দিতে গিয়ে, কপটচারিতার আশ্রয় নেবার কৌশল রয়েছে৷ মূলতঃ সে কারণেই কম্যুনিষ্ট শাসন-ব্যবস্থা কালের বিচারে টিকে থাকতে পারেনি৷ তাই দেখি,  পুঁজিবাদে অর্থাগম ঘটিয়ে, অন্যদের বঞ্চিত রেখে অবাধ সঞ্চয়ের ছাড়পত্র দেওয়া রয়েছে, তদ্রুপ কম্যুনিজ্‌মে তথা মার্কসীয় সমাজতন্ত্রেও গোষ্ঠীস্বার্থে অর্থাৎ পলিটব্যুরোর হাতে ধনসঞ্চয়ের কোষাগার-রক্ষার দায়িত্ব তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে৷ সেজন্যেই কিন্তু সাম্যবাদ তথা মার্কসবাদকে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ৷ এককথায়, অ্যাডাম স্মিথের পুঁজিবাদ বা ক্যাপিটালিম যেক্ষেত্রে ব্যষ্টি-স্বাতন্ত্রবাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পুঁজিবাদ, কার্লমার্কসের থিওরিও হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ তথা স্টেট্‌ ক্যাপিটালিজম৷ আশা করি এই ব্যাখ্যাটির  চাক্ষুষ প্রতিফলন বর্তমান চীন, রাশিয়া, কোরিয়া, বিয়েটনাম, পোল্যাণ্ড, রুমানিয়া,--- এসব রাষ্ট্রদের প্রতি একবার মাত্র চোখ বুলিয়ে নিলেই যে -কেউ বুঝে নিতে পারবেন৷ আর, তা সব ছেঁকে মেপেই বলা হয়েছে যে, এ যাবৎ গণতন্ত্রই হচ্ছে সর্বসেরা শাসন প্রক্রিয়া৷

তবে, প্রশ্ণটা হচ্ছে আসলেও  কি তাই কিনা৷ কারণ, অ্যাডাম স্মিথের পুঁজিবাদকে খাড়া রেখে অথবা পুঁজিবাদের খাদের ওপরে তথাকথিত সমাজবাদের বার্নিশ ঘষে নিয়ে, মিনে -করা পালিশ করা আধুনিক গণতন্ত্রের মূর্ত্তি বানিয়ে আজ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ঘটা করে পূজো অর্চনা করা হচ্ছে৷ তাতে কিন্তু--- বাঙালীদের লক্ষ্মী দেবীর সঙ্গে প্যাঁচা, মহারাষ্ট্রের কিংবা গণেশভক্তদের গণপতির সঙ্গে ইঁদুর, গঙ্গাদেবীর সঙ্গে মাছ-শিকারী উদ্‌, রামভক্তদের উপাশ্যদেব শ্রীরামচন্দ্রে সঙ্গে হনুমানজী, শ্রীদূর্র্গর সঙ্গে মহিষাসুর, চণ্ডীদেবীর সঙ্গে চণ্ডাসুর, কালীদেবীর সঙ্গে ডাকিনী--- যোগিনী, শিবের সঙ্গে বাহন বৃষ অর্থাৎ ভগবানের সঙ্গে শয়তানের উপাসনা করা হচ্ছে--- ভোগ-নৈবেদ্য দিয়ে প্রসাদ গ্রহণও করা হচ্ছে৷ তাই, বাধ্য হয়েই বলতে হচ্ছে যে দেব বা দেবীকে আরাধনা করা হচ্ছে সুফলটুকু পেতে, অথচ গোড়াতেই  বুদ্ধি বিভ্রাটগত কারণে ত্রুটিমুক্ত ব্যবস্থা না রাখার কারণেই অনিবার্যরূপে শয়তান,অসুর ও অশুভদায়ক শক্তিকে মান্যতা দেখাবার ফলেই অবশ্যম্ভাবী কুফলটুকুও মাথা নুইয়ে গ্রহণ করে নিতে হচ্ছে৷ আর তদ্রূপ বুদ্ধিবিভ্রমগত কারণেই আমাদের বৈশ্যতান্ত্রিক তথা পুঁজিবাদী সমাজ-ব্যবস্থায় শোষকশ্রেণীর অর্থাৎ বিত্তশালী মুনাফাখোর -মজুতদার, পুঁজিপতি করপোরেট সংস্থা বা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, মিলেনিয়ার-বিলেনিয়ার-ত্রিলেনিয়ার মিল-মালিক আর সুবিধাবাদী, সাম্রাজ্যবাদী (ভূমিলোভী, ক্ষমতালোভী, অর্থলোভী যা-ই হোক না কেন) ঔপনিবেশিক, বর্ণচোরা ফ্যাসিস্ট মুখোশপরা দুর্বৃত্ত তথা দুর্র্যেধন-দুঃশাসন আর তাদেরই আমলাচক্র বা তাঁবেদার ও মোসাহেবরা গণতন্ত্রের ঝাঁ চকচকে রূপালি বা সোনালী প্রতিমূর্ত্তিটা সামনে খাড়া করিয়ে রেখে, মাইকে বা মিডিয়ার সাহায্যে গণতন্ত্রের, জনহিতের, মানব-কল্যাণের, দেশপ্রেমের, তথাকথিত বিপ্লবের নতুবা পরিবর্তনের,জাতীয়তাবাদ বা ন্যাশনালিটির, এমনকি আন্তর্জাতিকতাবাদের  স্লোগানগুলো তাদের মন্ত্রপাঠ - স্বরূপ আওড়ে আওড়ে প্রকারান্তরে গণতন্ত্রের নামে শোষণের হাঁড়িকাঠে ফেলে জনসাধারণকেই বলি চড়িয়ে যাচ্ছে--- একথা বলাটাই বাহুল্য নয় কি? মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, আমাদের  গণদেবতারা অর্থাৎ জনসাধারণ (ছাপোষা আম-আদমীই হোন বা শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিত বা নাদুশ-নুদুস অথবা ছিপছিপে  চাকচিক্যপূর্ণ আর স্মার্ট-লুকিং আধুনিক ভদ্র সাজ-পোশাক পরিহিত) অধিকাংশরাই প্রথমতঃ এসব  ফাঁকফোকড় বুঝতেই অক্ষম দ্বিতীয়ত যাঁরা কিঞ্চিৎ বুঝতে  সক্ষম তাঁরা না--- বোঝার ভান করে গা-ঢাকা দিতে অধিক পছন্দ করে তৃতীয়তঃ যাঁরা সম্যক বুঝে নিতে সক্ষম তাঁরা অতি সন্তর্পণে স্পীকিং-নট্‌ হয়ে অর্থাৎ তাদের ওষ্ঠে-অধরে অদৃশ্য বা মানসিক সেলোটেপ লাগিয়ে এ যুগের ইনটেলেকচুয়াল সেজেও  আরোও বেশী সমাজের অনিষ্টের  ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে, শাসক-শ্রেণীর নীরব -সমর্থক, তল্পিবাহক, দালাল, ক্রীতদাস বা দলদাসের খাতায় নাম লিখিয়ে তথাকথিত শান্তিকামীর বাহবা কুড়িয়ে রক্তচোষা জলৌকাবৃত্তি নিয়ে জীবনধারণে ওস্তাদিপণা দেখাতে ব্যস্ত রয়েছেন৷ বস্তুতঃ এ শ্রেণীর লোকেদের কোন যুক্তিতে বিশ্বস্রষ্ঠার ‘‘সর্বশ্রেষ্ঠ জীব’’ বলে অভিহিত করা চলে, তা’ আমার জানা নেই৷ (ক্রমশঃ)