দুটি অঞ্চল উন্নয়নের প্রায় সমস্তরে এসে পৌঁছলে তাদের পক্ষে এক–সঙ্গে মিলিত হয়ে বৃহত্তর সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে’ তোলা সম্ভব৷
দুই বা ততোধিক সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল একসঙ্গে মিলিত হতে পারে যদি কয়েকটি শর্ত পূরণ হয়৷ শর্তগুলি হ’ল–
- সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলির অর্থনৈতিক বৈষম্যের ক্রমাবসান৷
- বিজ্ঞান ও যোগাযোগের উন্নতি ৷
- প্রশাসনিক যোগ্যতা৷
- সামাজিক–সাংস্কৃতিক মেলামেশা৷
এই শর্তগুলি পূরণ হলে ওই অঞ্চলগুলির মধ্যে উচ্চপর্যায়ের সামাজিক–অর্থনৈতিক সমতা আসবে৷ তখন তাদের পক্ষে মৈত্রীপূর্ণ সহযোগিতা স্বাভাবিক ও সহজ হবে৷ এই অবস্থায় ওই অঞ্চলগুলি তাদের অধিকতর সামাজিক–অর্থনৈতিক বিকাশের জন্যে তথা ওই এলাকাগুলির সমস্ত মানুষের কল্যাণে একত্রিত হয়ে একটি অভিন্ন সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হতে পারে৷
এভাবেই ক্রমে ক্রমে সমগ্র ভারতবর্ষ পরিণত হবে একটি মাত্র সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে৷ শুধু ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতেই নয়, সমগ্র বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করতে হবে৷ পরবর্ত্তী পর্যায়ে বিরামহীন বিকাশ ও উন্নয়নের মাধ্যমে সমগ্র দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া একটি অভিন্ন সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হবে৷ এমনি করে’ এক সময় সারা পৃথিবী একটি সুসংহত সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে কাজ করতে পারে৷ এই অবস্থাতে সম্ভব হবে প্রকৃত বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা৷
এই পর্যায়ে পৌঁছানোর পর প্রাউটের গণ আন্দোলন এক সার্বিক সুসন্তুলিত সংরচনা তথা ‘প্রমা’–র equilibrium and equipoise প্রতিষ্ঠা করবে৷
প্রত্যেক সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলকে যদি সর্বানুস্যুত ভাবাদর্শের দ্বারা ও বিশ্বৈকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা অনুপ্রাণিত করা হয় তাহলে মানবসমাজ সমুন্নত আদর্শের অভিমুখে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলবে৷
প্রাউট বলে, যে কোন সামাজিক–অর্থনৈতিক আন্দোলনের সফলতার জন্যে প্রথমেই চাই একটা সুসংহত পূর্ণ আদর্শ৷ প্রাউটের এই সামাজিক–অর্থনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি নব্যমানবতাবাদ৷ এই নব্যমানবতাবাদ সমস্ত মানুষকে ঐক্যের সূত্রে বেঁধে বিশ্বৈকতাবাদ–ভিত্তি সমাজের প্রতিষ্ঠা করবে৷ তবে এটা সত্য পৃথিবীতে রাতারাতি বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা হবে না৷ তা বাস্তবায়িত হবে ধাপে ধাপে৷
প্রাউটের নীতির বৈশিষ্ট্য হ’ল, আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে’ বিশ্বৈকতাবাদের Universal in Spirit but Regional in Approach৷
শাশ্বত শোষণ–মুক্ত বিশ্ব
সমাজ থেকে আমরা শোষণ যদি তুলে দিই তখন শোষক আর শোষিতও থাকবে না৷ মূল ব্যাধিটা শোষণ৷ শোষণ দূর করতে পারলেই শোষক–শোষিতের ভেদরেখা থাকবে না৷ যারা মানুষের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করে’ চলেছে, তারা আর ভেদ সৃষ্টি করবার কোনো অবকাশ পাবে না, সুযোগ পাবে না৷ তাই বুদ্ধিমান মানুষেরা যাঁরা মানুষ সমাজের কল্যাণ চান তাঁরা মানুষ–সমাজ থেকে এই শোষণ জিনিসটাই তুলে দেবেন৷ তার ফলে শোষক–শোষিতের যে সংঘাত, সেটাও শেষ হয়ে যাবে৷ মানুষ মানুষ ভাই–ভাই, যা পরম সত্য সেইটাই মানুষ অহর্নিশ উপলব্ধি করবে, অনুভব করবে৷১৪
এখন প্রশ্ণ–সারা পৃথিবীতে স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হবার পর কী ভাবে ভবিষ্যতে শোষণের সম্ভাবনাকে দূর করা যাবে? প্রাউটের মতে, যদি নিম্নলিখিত ৪টি উপাদান সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে তাহলে যাবতীয় শোষণ থেকে মানুষকে রক্ষা করা যাবে৷
এই উপাদানগুলি হ’ল ঃ–
- পূর্ণাঙ্গ আদর্শ
- বিজ্ঞান–সম্মত আধ্যাত্মিক ভিত্তি
- আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত কর্মীদল
- উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান
পূর্ণাঙ্গ আদর্শ ঃ একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শের বিভিন্ন দিক রয়েছে৷ প্রথমতঃ, এই পূর্ণাঙ্গ আদর্শই হবে সামাজিক–অর্থনৈতিক সমস্যার যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ, ও এই সব সমস্যার সার্বিক সমাধানের ভিত্তিভূমি৷ দ্বিতীয়তঃ, মানুষের মানসিক বিস্তার ও আধ্যাত্মিক পরাগতিকে অবহেলা করা চলবে না৷ তৃতীয়তঃ, আদর্শের সঙ্গে গতিশীলতা ও প্রাণোচ্ছ্বলতাকে সমন্বিত করতে হবে, যাতে করে’ তা মানবতাকে সর্বাত্মক প্রগতির অভিমুখে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে৷
বিজ্ঞান সম্মত আধ্যাত্মিক ভিত্তি ঃ বিজ্ঞানসম্মত আধ্যাত্মিক ভিত্তি সমাজ থেকে সর্বপ্রকার ভেদ–ভাবনা, ও মানসিক সংকীর্ণতা সৃষ্টিকারী সমস্ত প্রকার গোষ্ঠী–মতবাদ থেকে মানুষকে রক্ষা করবে৷ বিজ্ঞান–সম্মত আধ্যাত্মিকতা মানুষের মধ্যে কোন কৃত্রিম ভেদকে স্বীকার করে না৷ কুসংস্কার ও হতাশা নয়–ক্রমবিকাশ ও আত্মোন্নতিই আধ্যাত্মিকতার মূল কথা৷
আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত কর্মীদল ঃ আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত কর্মীদল সর্বপ্রকার শোষণ থেকে সমাজকে রক্ষা করবার নৈতিক পটভূমিকা রচনা করবে, ও ‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায়চ’ এই আদর্শের ভিত্তিতে সমগ্র মানব সমাজে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শের প্রচার চালিয়ে যাবে৷
উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান ঃ সর্বশেষে, উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান মানুষের আশা–আকাঙক্ষা, অভাব অভিযোগ নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করবে, ও মানব কল্যাণের জন্যে সততঃ কাজ করে’ যাবে৷ বিশ্বরাষ্ট্রের প্রয়োজন অনেকেই আজ উপলব্ধি করছে, অদূর ভবিষ্যতে এই বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর এর ক্ষমতাকে প্রগতিশীলভাবে বৃদ্ধি করে’ যেতে হবে৷
এই বিশ্বরাষ্ট্রের সংরচনার মধ্যে প্রতিটি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলই তার সার্বিক বিকাশের পূর্ণ সুযোগ লাভ করবে৷ প্রাউটের সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল রচনার এই নীতি সমাজের সর্বপ্রকার সামাজিক–অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের এক ব্যাপক ও সুসংহত প্রয়াস৷ জনসাধারণ এই নীতি গ্রহণ করলে সমাজ সর্বপ্রকার বাধা–বন্ধনকে অতিক্রম করে’ ক্রমবর্ধমান গতিতে প্রগতির যথার্থ পথ ধরে’ এগিয়ে চলতে সক্ষম হবে৷ মানব সমাজে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হবে৷