প্রাউট অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী৷ তাই একস্থানের উন্নতি না করে’ সর্বত্র যাতে সমানভাবে প্রগতি হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে স্থানীয় সম্পদ ও শক্তি সামর্থ্যকে প্রথমে নিয়োগ করার পরিকল্পনা নিতে হবে৷ স্থানীয় এলাকায় কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতা, ও ওই এলাকার মানুষদের ভোগ্যপণ্যের প্রয়োজন অনুসারে সর্বাধিক শিল্প বিকাশ প্রয়োজন৷ এই নীতি বহিরাগতদের হাত থেকে অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের হাতে তুলে দেবে৷ এইভাবে ওই সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার প্রভূত বিকাশ সম্ভব হবে৷ প্রাউটের অর্থনীতি অনুসারে কৃষির মত অধিকাংশ শিল্পই উৎপাদক–সমবায় ও উপভোক্তা–সমবায়ের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত৷ এর ফলে এক নোতুন ধরণের সামবায়িক চেতনা বা সামবায়িক শক্তির সৃষ্টি হবে৷ এতে পুঁজিপতিদের হাত থেকে অর্থনৈতিক ক্ষমতা তাদের হাতে চলে আসবে, যারা ওই শিল্পে কায়িক বা বৌদ্ধিক শ্রমে রত রয়েছে৷
এই নীতি থেকে অনেকগুলি অনুসিদ্ধান্ত এসে যায়৷ প্রথমতঃ, শিল্পগুলি যে সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত তার বাইরে থেকে কাঁচামাল না এনে, স্থানীয় কাঁচামালের ব্যবহার করা উচিত৷ কেন শিল্পগুলিতে স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করা উচিত–তার অনেক কারণ আছে৷ উদ্ভিজ্জাত কাঁচামালের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি বিভিন্ন অঞ্চল স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন ভিন্ন কাঁচামাল উৎপাদনের পক্ষে অনুকূল৷ যে সব শিল্প স্থানীয় কাঁচামালের ভিত্তিতে গড়ে’ ওঠে তা সস্তায় পণ্য উৎপাদন করতে পারে৷ তাছাড়া কাঁচামালের উৎসের সন্নিকটে অবস্থিত হওয়ার জন্যে ওই শিল্প সব সময়ই কাঁচামালের যোগান পাবে৷ এতে এগুলি সহজে স্ব–নির্ভর হয়ে উঠবে৷ যেখানে বাইরের থেকে কাঁচামাল আনতে হয়, সেখানে ওই সব সুবিধা নেই৷ দ্বিতীয়তঃ, কাঁচামালের উৎপাদকেরা, বিশেষ করে’ উৎপাদক–সমবায়গু হাতের কাছে তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের তৈরী বাজার পাওয়ায় বিশেষভাবে লাভবান হয়৷ তৃতীয়তঃ, শিল্পগুলির হাতের কাছে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পাওয়ায় এগুলির নিরাপত্তার নিশ্চিততা আসে, ও ভালভাবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেওয়া সম্ভব হয়৷ কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতা স্থানীয় শিল্পগুলিকে দীর্ঘকাল টিঁকিয়ে রাখতে পারবে৷ চতুর্থতঃ, অনেক বড় বড় পুঁজিপতি স্থানীয় কাঁচামালভিত্তিক শিল্প–বিকাশকে বাধা প্রদান করে’ ওই এলাকার অর্থনীতি ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করে৷ তারা স্থানীয় কাঁচামালভিত্তিক শিল্পপণ্য ওই অঞ্চলের বাজারে বিক্রয় করে’ ওখানকার জনসাধারণের ওপর শোষণ চালায়৷ যেমন অষ্ট্রেলিয়া জাপান থেকে এমন বহু শিল্প–উৎপাদিত পণ্য আমদানি করে, যে সমস্ত শিল্পজাত পণ্যের কাঁচামাল অষ্ট্রেলিয়াতেই রয়েছে৷ স্থানীয় কাঁচামালের ভিত্তিতে শিল্প–বিকাশকে উৎসাহিত করলে স্থানীয় বাজারের ওপর পুঁজিপতিদের ব্যষ্টিগত বা গোষ্ঠীগত আধিপত্যের অবসান হবে৷ এতে ওই এলাকার অর্থনৈতিক বিকাশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ মূলধনের বহিঃস্রোতও বন্ধ হয়ে যাবে৷
আলোচ্য নীতিটির দ্বিতীয় অনুসিদ্ধান্ত হ’ল স্থানীয় কাঁচামাল রপ্তানী মোটেই উচিত নয়–রপ্তানী করা উচিত কেবল শিল্পজাত পণ্য৷ স্থানীয় কাঁচামালের দাম রপ্তানী বাজারে দারুণ ওঠানামা করে–কারণ স্বার্থান্বেষী পুঁজিপতি বা ফাটকা কারবারীরা অবাধ মুনাফা লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে ওই সব কাঁচামালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে৷
তৃতীয় অনুসিদ্ধান্ত হ’ল স্থানীয় এলাকায় কোন শিল্পজাত–পণ্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সম্ভাবনা না থাকলে তবে ওই শিল্পজাত পণ্যকে বাইরে থেকে আমদানি করতে দেওয়া যেতে পারে৷ বাইরে থেকে শিল্পজাত পণ্য আমদানি করা মানেই স্থানীয় মূলধন অন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়া৷ যে কোন সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশের পক্ষে মূলধনের বহিঃস্রোত সব সময়ই ক্ষতিকর৷ তাই অপ্রয়োজনীয় আমদানিকে সর্বদা নিরুৎসাহিত করা উচিত৷ বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পারস্পরিক পণ্য–বিনিময় পদ্ধতিই (Barter System) উৎকৃষ্ট৷ কারণ এই পদ্ধতিতে কোন পক্ষেরই ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না৷
বহির্পণ্যের আমদানি এড়িয়ে চলা
যে সমস্ত পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা যেতে পারে, সেগুলো বাইরে থেকে আমদানি করা উচিত নয়৷ এর অর্থ হ’ল স্থানীয় জনসাধারণের উচিত স্থানীয় শিল্পজাত–পণ্য ক্রয় করে’ ওই শিল্পকে সহায়তা করা৷ এমন কি প্রথম অবস্থায় অন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য অপেক্ষা স্থানীয় শিল্পজাত পণ্য অপেক্ষাকৃত কম গুণমানসম্পন্ন হলেও তা ক্রয় করা উচিত৷ তাহলে ওই শিল্পের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত হবে৷ স্থানীয় জনসাধারণের ক্রমাগত সহায়তার ফলে এমন একদিন আসবে, যখন শিল্প অপেক্ষাকৃত অধিক গুণমানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হবে৷ কিন্তু জনগণ যদি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানস-অর্থনৈতিক শোষণের বলি হয়ে স্থানীয় পণ্য অপেক্ষা অন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের পণ্য ক্রয়ে বেশী আগ্রহী হয়, তবে স্থানীয় শিল্পগুলি পরিস্থিতির চাপে পড়ে’ বন্ধ হয়ে যাবে৷ পরিণতিতে দেখা দেবে বেকার সমস্যা সহ নানান্ ধরণের সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা৷ সুতরাং যতদূর সম্ভব জনগণ যাতে বাইরের শিল্পজাত–পণ্য অপেক্ষা স্থানীয় পণ্য ক্রয়ে অধিক আগ্রহী হয় তার জন্যে ব্যাপক জনমত গড়ে’ তুলতে হবে৷ এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে ব্যাপক গণ–আন্দোলন এমন ভাবে গড়ে’ তুলতে হবে, যাতে স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়৷