শাস্ত্রীয় নির্র্দেশ অনুযায়ী মানুষের উন্নতির জন্যে তিনটি তত্ত্ব আবশ্যক৷ তিনটি তত্ত্ব কী?–না, শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন৷ প্রথমে দেখা যাক্–শাস্ত্র বলতে কী ৰোঝায়? ‘‘শাসনাৎ তারয়েৎ যস্তু সঃ শাস্ত্রঃ পরিকীর্ত্তিতাঃ৷ ’’এখানে ‘শাসন’ মানে হচ্ছে–অনুশাসন৷ শাসন ও অনুশাসন একই জিনিস৷ ইংরেজীতে ‘অনুশাসন’ বলতে ৰোঝায়–Discipline, Code of discipline. কিন্তু সংস্কৃতে ‘অনুশাসন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে–‘‘হিতার্থে শাসনম্ ইতি অনুশাসনম্’’৷ যখন তুমি কারোর হিতের জন্যে শাসন কর, তখন তাকে বলা হয় অনুশাসন৷ কিন্তু যখন হিতের ভাবনা থাকবে না, তখন তাকে অনুশাসন বলব না৷ এতে শাসন থাকতে পারে, কিন্তু তাতে হিতের ভাবনা নেই–তাই তা অনুশাসন পদবাচ্য নয়৷ ‘‘হিতার্থে অর্থাৎ কল্যাণার্থে শাসনম্ ইতি অনুশাসনম্৷’’ তাহলে শাসনের দ্বারা অর্থাৎ অনুশাসনের দ্বারা যা জীবকে ত্রাণের রাস্তা দেখিয়ে দেয়, তাকেই শাস্ত্র বলে৷ শাস + ত্রৈ + ড–প্রথমার একবচনে হয় ‘শাস্ত্র’৷
তাহলে শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন কথাটিতে শ্রবণ মানে শোণা৷ আমি আমার কাণকে এমনভাবে তৈরী করব যে কাণ সদা পরমপুরুষের কথা শুণবে৷ আর তাঁর কথা শুণলে কী হবে? পরমপুরুষের কথা যদি মানুষ শুণতে থাকে তবে সেই শব্দতরঙ্গ কাণ পর্যন্ত পৌঁছে যায়৷ কাণ থেকে স্নায়ুতন্তু ন্দ্বব্জ্লন্দ্ব ন্দ্রন্ত্ব্ব্জন্দ্বব্দগ্গ ও সেখান থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত ঙ্মত্ব্ব্জ্ত্রনু ন্তুন্দ্বপ্তপ্তব্দৰ পৌঁছে যায়৷ মস্তিষ্কে পৌঁছে গেলে, তা একইভাবে মস্তিষ্কে শব্দতরঙ্গ উৎপন্ন করে৷ আর এইভাবে তা মনেও পৌঁছে যায়৷ সেই শব্দ যখন মনে পৌঁছে যায়, মন তখন ধীরে ধীরে পরমপুরুষের দিকে চলতে শুরু করে দেয়৷ এই হ’ল শ্রবণ৷... ‘শ্রবণ’ শব্দটা রাখা হয়েছে ধর্মপ্রচারের জন্যে৷ ধর্মৈষণার জন্যে৷ বিশ্ববাসীর মনে সাত্ত্বিক ভাব জাগাবার জন্যে শ্রবণের প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি৷ তুমি যখন কীর্ত্তন কর তখন তুমিই শুধু আনন্দ পাও–তা তো হয় না৷ তোমার মুখ থেকে যে কীর্ত্তন হচ্ছে সেটা যার কানে পৌঁছচ্ছে তাদের সকলেরই প্রগতি হবে৷ তাদেরও উন্নতি হবে৷ তাদেরও কল্যাণ হবে৷ এজন্যে ‘শ্রবণ’ শব্দকে রাখা হয়েছে৷...
তুমি বলতে পার–অনেক দুষ্ট লোক আছে যারা অনেক অনুচিত কথা আমাকে বলতে পারে৷ তারা পরমপুরুষের নাম নেয় না, তারা পরমপুরুষের চর্চা করে না৷ কিন্তু তারা যদি আমাকে অনুচিত বাক্য বলে? তার জন্যেও উপায় আছে৷ কেউ অনুচিত কথা বললে তৎক্ষণাৎ গুরুমন্ত্রের ব্যবহারের দ্বারা তাকে শুভ চিন্তায়, তাঁকে পরমপুরুষের ভাবে রূপান্তরিত করে নিতে পার৷ এই জন্যে যখনই অনুচিত কথা শুণবে, মনে মনে পরমপুরুষের জপ করতে থাকবে৷ তখন ওই অশুভ শব্দ শুভ শব্দে রূপান্তরিত হয়ে যাবে৷ এই হ’ল মনন৷
‘‘মনসা সংবরো সাধু, সাধু সব্বত্থ সংবরো৷’’ এইভাবে করলে মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ এসে যাবে৷ কারণ সেই অবস্থায় মন এক বিশেষ পথ (line) অনুসারে চলা শুরু করে দেয়৷ এক বিশেষ পথ ধরে চললেই তুমি মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে৷ এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই৷
তাহলে এক শ্রবণ, দ্বিতীয় হ’ল মনন৷ ‘মনন’ মানে মনে মনে চিন্তা করা৷ মনের এটাই হ’ল প্রধান কাজ৷ আসলে মনের দু’টি কাজ আছে–এক চিন্তা করা (চিন্তন), আর দ্বিতীয় স্মরণে রাখা (Remember)৷ সুতরাং চাইলেই মন সর্বদা মনন–ক্রিয়া তথা পরমপুরুষের ধ্যানে রত থাকতে পারে৷ মনে অনেক কিছু জমা থাকে, জগতের অনেক কথা মনে জমা থেকে যায়–যা পরিণামে অনেক সমস্যা তৈরী করে দেয়৷ ধর, কারো সাথে বিশ বছর আগে ঝগড়া হয়েছিল–সেকথা মনে রাখলে কী হবে?–না, মনের শান্তি নষ্ট হয়ে যাবে৷ তা ভুলে যাওয়াই ভাল৷ ‘ক্ষমা করো ও ভুলে যাও’–এই নীতিই সবচেয়ে উপযুক্ত৷ কিন্তু যেখানে পরমাত্মা বা পরমপুরুষের নাম মনন করার ব্যাপার আছে সেখানে মনন মানে বারে বারে পরমপুরুষের কথা চিন্তা করা৷ এক্ষেত্রে স্মরণে রাখাটা ৰড় কথা নয়, বারংবার তাঁর কথা চিন্তা করাই হচ্ছে যথার্থ মনন৷
‘‘মননাৎ তারয়েৎ যস্তু সঃ মন্ত্রঃ পরিকীর্তিতঃ৷’’ যে শব্দ মনন করলে, বারবার চিন্তা করলে মানুষের মুক্তি ঘটে, তাকেই ‘মন্ত্র’ বলা হয়৷ মন ত্র ঘএ–প্রথমার একবচনে হয় মন্ত্র৷ পৃথিবীতে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ অগুনতি শব্দ আছে–যা মন্ত্র নয়৷ যে শব্দের মনন করলেই মন পরমপুরুষের দিকে ছন্দায়িত গতিতে চলতে শুরু করে দেয়–তাকেই মন্ত্র বলে৷ প্রত্যেক সাধকের নিজ নিজ মন্ত্র আছে, নিজ নিজ ইষ্টমন্ত্র আছে৷ গুরুমন্ত্রের দ্বারা অশুভ শব্দ শুভে পরিণত করব ও ইষ্টমন্ত্রের দ্বারা তাঁর মনন করতে করতে এগিয়ে যাব–এই হ’ল মনন৷
মনন করতে করতে কী হয়? মনের দ্বিতীয় গুণ হ’ল–মনে রাখা, স্মরণ করা (Remember)৷ মনন করতে করতে এমন হয়ে যায় যে মানুষ আর তাঁকে ভোলে না৷ যখন তুমি ঘুমিয়ে আছ, তখনও মনে বিনা চেষ্টাতেই জপ চলতে থাকে৷ যখন বিনা প্রয়াসে আপনা থেকেই জপক্রিয়া চলতে থাকে, তখন শাস্ত্রে তাকে বলা হয়–‘অজপাজপ’ বা ‘অজপাগায়ত্ত্রী’৷ অজপাগায়ত্ত্রী কী?–না, জপসিদ্ধি৷ জপে যখন সিদ্ধি এসে গেল, মনন করতে করতে যখন শেষ পর্যন্ত পূর্ণরূপে তা (ইষ্টমন্ত্র) মনে থেকে গেল, তখন তাকে বলব–অজপাগায়ত্ত্রী, অজপাজপ৷ তারই নাম–‘ধর্মমেঘ সমাধি’৷ এই অবস্থায় সাধক কোন কিছুই ভোলে না৷
শ্রবণম্, মননম্, নিদিধ্যাসনম্৷ এই নিদিধ্যাসনম্ শব্দের অনেক অর্থ আছে৷ তবে এর একটি মুখ্য অর্থ হ’ল মনের একতানতা অর্থাৎ আমি চলছি কেবলমাত্র তাঁকে পাবার জন্যে, তাঁরই পেছনে, আমার সমস্ত ভালবাসা কেবল তাঁকে কেন্দ্র করেই৷ এখানে আছে ষোল আনা অকটপতা (sincerity), ষোল আনা আন্তরিকতা৷...