একটি শ্লোকে আছে,
‘‘তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা৷
অমানীনং মানদেন কীর্ত্তনিয়ঃ সদা হরিঃ৷৷’’
তুমি আধ্যাত্মিক সাধক৷ উপরি-উক্ত শ্লোকে লা হয়েছে---‘‘তোমাকে ঠিক একটা তরুর মত সহিষ্ণু হবার গুণ অর্জন করতে হবে আর ঘাসের একটি পাতার থেকেও বেশী বিনীত ভাব(modesty) থাকতে হবে৷’’ তোমরা জান, এই জগতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা অন্যের কাছ থেকে নূ্যনতম সম্মান পায় না---আমি সেই পদদলিত, অর্ধ-ভুক্ত, অর্ধ-উলঙ্গ মানবতার কথা লছি৷ ওইসব পদদলিত মানুষদের প্রতি তোমাদের সম্মান প্রদর্শন করতে হবে৷ তোমরা তাদের মানোন্নয়ন করবে, তাদের সামাজিক-আর্থিক-সাংসৃকতিক উন্নয়ন ঘটাবে৷ যদি তুমি তাদের সম্মান না দাও, তাহলে তুমি তাদের সেবা করবে কীভাবে? সেই পদদলিত মানুষদের ওপর ঈশ্বরত্ব আরোপ করে তুমি তাদের সেবা করবে৷
আর অন্তিম তথা গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা হচ্ছে এই যে, মন কখনই খালি থাকতে পারে না, মন কর্মহীন হয়ে থাকতে পারে না৷ তুমি তোমার মনকে এমন আভোগ দেবে, অর্থাৎ তোমার মনের আভোগ, তোমার মানসিক আভোগ হয় কোন কিছু মানসিক হবে অথবা কোন কিছু মানসাধ্যাত্মিক হবে অথবা একেবারে বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক প্রকৃতির হবে৷ এটা অবশ্যই মানস-দৈহিক অথবা বিশুদ্ধ দৈহিক অথবা জাগতিক হবে না৷ আমি এখনই তোমাদের ললুম মন খালি থাকতে পারে না৷ যখন তোমার সামনে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকবে না, তখন অলস চিন্তায় সময় নষ্ট কোর না, কেননা অলস চিন্তার অর্থ হচ্ছে মানসিক অধঃপতন৷ তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কোন ভাল কাজে লাগাও, কোন ভাল চিন্তায় ব্যস্ত রাখো৷ যখন তুমি দৈহিকভাবে কোন ভাল কিছু কাজ করতে পারছ না তখন মানসিকভাবে ভাল কিছু করো৷ আর সর্বশ্রেষ্ঠ মানসিক কর্ম, সর্বোত্তম মানসিক আভোগ হচ্ছে ‘‘কীর্ত্তনীয়ঃ সদা হরিঃ’’---সর্বদা পরমপুরুষের কীর্ত্তন করো৷
সংসৃকতে পরমপুরুষের একটি নাম হরি৷ হরি মানে যিনি হরণ করেন, যিনি তোমাকে জানতে না দিয়ে তোমার সমস্ত পাপ হরণ করে নেন৷ সংসৃকতে মূল ধাতু ‘হৃ’ এর অর্থ চুরি করা৷ ভগবান আর ভক্তের মধ্যে খুব মধুর সম্পর্ক, আর এই সম্পর্ক একেবারে সম্পূর্ণভাবে ব্যষ্টিগত৷ পরমপুরুষ ভক্তকে ভালবাসেন, আর ভক্তও ভগবানকে ভালবাসে৷ এখন ভক্তের মধ্যে সঞ্চিত পাপের যে পাহাড় প্রমাণ ভার আছে তা ভগবানের কাছে অসহ্য৷ তাই তিনি ভক্তের মধ্যে এই পাপের পাহাড়কে সরিয়ে দিতে চান৷ তিনি ভক্তকে লতে পারেন ঃ---‘‘হে ভক্ত, তোমার পাপ সব আমাকে দিয়ে দাও৷’’ ভক্ত লবে---‘‘না ভগবান, আমি তোমাকে সবকিছু দিতে রাজী আছি, আমি তোমাকে আমার আত্মা, আমার ভাবসম্পদ, আমার সবকিছু দিতে রাজী আছি, কিন্তু কী করে আমি আমার পাপ তোমাকে দিতে পারি? তাই পাপ আমি দোব না৷’’ কিন্তু পরমপুরুষ তো তাঁর ভক্তকে ভালাবাসেন৷ তাই ভক্তকে জানতে না দিয়েই তিনি তার সমস্ত পাপ নিয়ে নেন৷ এখন কারোর কাছ থেকে তাকে না জানিয়ে কোন কিছু নিয়ে নেওয়াকে বলে চুরি করা৷ তাই পরমপুরুষ চুরি করেন৷ অর্থাৎ তিনি ভক্তের কাছ থেকে তার পাপকে হরণ করে নেন৷ আর সেইজন্যেই তাঁকে লা হয় হরি৷ হরি মানে যিনি পাপ হরণ করেন৷
তাই ‘‘কীর্ত্তনীয়ঃ সদাহরিঃ’’---অর্থাৎ তুমি মনকে কোনপ্রকার জাগতিক-মানসিক অথবা জাগতিক আভোগে নিয়োজিত রাখবে না৷ তোমার সময়কে, তোমার অস্তিত্বের প্রতিটি মুহূর্তকে পরমপুরুষের কীর্ত্তনে নিয়োজিত করো৷ তোমরা এখন কীর্ত্তন করো৷
২৮ মে ১৯৮৮, প্রাতঃকালীন দর্শন, আনন্দনগর