‘‘মোক্ষকারণসমগ্র্যাং ভক্তিরেব গরিয়সী৷’’ মোক্ষ কাকে লে? মোক্ষ হচ্ছে, প্রথমে নিজের দেহবোধকে স্থূল মনে এক করা, স্থূল মনকে সূক্ষ্ম মনে মিলিয়ে দেওয়া, সূক্ষ্ম মনকে বিশুদ্ধ ‘‘আমি’’-বোধে মিলিয়ে দেওয়া---আর শেষ পর্যন্ত ‘‘আমি’’-বোধকে আত্মায় সমাহিত করে দেওয়া৷ যখন ‘‘আমি’’-বোধ বিশুদ্ধ চৈতন্যের আওতার মধ্যে আসে, সেই অবস্থাকে লে মোক্ষ৷ মোক্ষপ্রাপ্তির জন্যে সাধককে নির্দিষ্ট উপায় অবলম্বন করতে হবে৷ সাধক লছে, বিভিন্ন উপায় বা পদ্ধতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে ভক্তি, অর্থাৎ স্থূলতর সত্তাকে একমাত্র ভক্তির মাধ্যমে সূক্ষ্মতর সত্তায় এক করে দেওয়া সম্ভব৷ তাই ভক্তি হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়৷ শ্রুতিতে লা হয়েছে,
‘‘যচ্ছেদ্ বাঙমানসি প্রাজ্ঞস্তদ্ যচ্ছেজ্জ জ্ঞানমাত্মনি৷
জ্ঞানমাত্মনি মহতি নিযচ্ছেৎ তদ্ যচ্ছেচ্ছান্ত আত্মনি৷৷’’
এই শ্লোকের অর্থ---যত্নবান ও দ্ধিমান সাধক প্রথমে তার ইন্দ্রিয়র্োধকে স্থূল মনে সমাহিত করর্ে স্থূল মনকে নিয়ে যার্ে, চালিত করর্ে সূক্ষ্ম মনের দিকে, অর্থাৎ কর্মরত মন, নিজের অহং বোধের মধ্যে সমাহিত করর্ে অহং বোধকে চালিত করর্ে বিশুদ্ধ ‘‘আমি’’-বোধের দিকে আর বিশুদ্ধ ‘‘আমি’’-বোধকে বিশুদ্ধ চৈতন্যের মধ্যে মিলিয়ে এক করে দের্ে৷ এই মিলিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির মাধ্যমেই রূপায়িত হওয়া সম্ভব৷
প্রথম স্তরে সাধককে জানতে হয় কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, কেন করতে হবে৷ এই যে কী-কীভাবে-কেন, এসবের উত্তর পাওয়াই হ’ল জ্ঞানসাধনা৷ এটাই হচ্ছে জ্ঞান৷ এইভাবে প্রারম্ভিক জ্ঞানার্জনের পরে তোমাকে কী করতে হবে? তোমরা জান, জ্ঞানের দু’টি প্রকার আছে৷ একটি জ্ঞান আর অন্যটি বিজ্ঞান৷ জ্ঞানম্ আর বিজ্ঞানম্৷ জাগতিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান---ইঞ্জিনিয়ারিং, চিকিৎসাবিজ্ঞান, শিল্পকলা, স্থাপত্যবিদ্যা, সাহিত্য---এইসব হচ্ছে জাগতিক জ্ঞান৷ এই ধরণের জ্ঞানকে লা হয় জ্ঞানম্ আর অধ্যাত্মবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানকে লে বিজ্ঞানম্৷
এখন জ্ঞানার্জনের পরে একজনকে সেই অনুসারে কিছু করতে হবে, তাকে বাস্তবে কিছু করতে হবে৷ এই যে বাস্তবে কিছু করা, এটাই হচ্ছে কর্মসাধনা৷ তাই জ্ঞানার্জনের পরে কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, এসব জানার পরে সাধককে সেই অনুসারে বাস্তবে কিছু করতে হবে৷ এই করাটাই কর্মসাধনা৷ জ্ঞানসাধনা আর কর্মসাধনার ফলশ্রুতি হচ্ছে ভক্তি৷ তাই ভক্তি কোন সাধনা নয়, কোন অভ্যাস নয়৷ ভক্তি হচ্ছে জ্ঞান আর কর্ম এই দুই-এর ফলশ্রুতি৷
সুতরাং মৌলিক স্তরে, প্রারম্ভিক স্তরে সাধকের কাছে জ্ঞানের যথেষ্ট মূল্য আছে৷ পরবর্তী স্তরে ভক্তিরও নিশ্চিত মূল্য আছে৷ কিন্তু শেষ স্তরে ভক্তিই হচ্ছে একমাত্র নির্দেশক তত্ত্ব৷
এইমাত্র আমি ললুম ভক্তি হচ্ছে জ্ঞান ও কর্মের ফলশ্রুতি৷ কিন্তু এমনও হতে পারে যে একটি ছোট ছেলে, পাঁচ-ছয় বছরের একটি ছোট ছেলের মধ্যে ভক্তি জেগে গেছে কিন্তু সে জ্ঞানও অর্জন করেনি বা কোন কর্মও করেনি৷ তাহলে এটা কীকরে সম্ভব? এটা সম্ভবপর এইজন্যে যে ভক্তি হচ্ছে জ্ঞানসাধনা ও কর্মসাধনার ফলশ্রুতি৷ সে বালকটি পূর্ব জীবনে জ্ঞান সাধনা ও কর্ম সাধনা করেছে৷ সেইজন্যে এই জীবনে, বর্তমান জীবনে তার মধ্যে বাল্যকাল থেকেই ভক্তি জেগে গেছে৷
এখন শ্লোকটিতে লা হয়েছে, ‘‘মোক্ষকারণসমগ্র্যাং ভক্তিরেব গরিয়সী’’৷ মোক্ষপ্রাপ্তির জন্যে তিনটি প্রয়োজনীয় তত্ত্ব আছে---জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি৷ কিন্তু লা হয়েছে ‘‘ভক্তিরেব গরিয়সী’’---অর্থাৎ ভক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ, কেননা এটা হচ্ছে চরম, এটা হচ্ছে সূক্ষ্ম-তম তত্ত্ব৷ তোমরা সাধকেরা এই তিনটি তত্ত্ব, এই তিনটি বিষয়কে অবশ্যই মনে রাখর্ে৷ এখানে তোমাদের কর্মসাধনা, তোমাদের জ্ঞানসাধনাকে শেষ পর্যন্ত ভক্তিসাধনায় বিন্দুস্থ করতে হবে৷ ভক্তি বিনা পরমপুরুষের সংস্পর্শে আসা সম্ভবপর নয়৷ আমি আবার লছি যে তোমরা অবশ্যই মনে রাখর্ে যে ভক্তি কোন সাধনা নয়, কোন অভ্যাস নয় ভক্তি হচ্ছে দু’টি অভ্যাস অর্থাৎ জ্ঞান ও কর্মের ফলশ্রুতি৷ তাই ভক্তিমান হও আর পরমপুরুষের পরম আনন্দকে অনুভব করো৷