যত কিছু বস্তু আছে সবই মরণধর্মী, মরণশীল৷ চার বছরের ছেলে যখন চব্বিশ বছরের যুবক হয় তখন চার বছরের ছেলেটা মরে যায়৷ তাকে তুমি আর কোথাও পাবে না৷ সে মরে গেছে৷ কিন্তু চার বছরের ছেলের যে আধার আর চব্বিশ বছরের ছেলের যা আধার– দু’টো আধার একই সত্তার৷ অর্থাৎ ব্যষ্টি অপরিবর্তিত থাকে৷ শ্রীরমেশ চার বছরের ছেলের মধ্যেও ছিল, চব্বিশ বছরের যুবকের শরীরের মধ্যেও ছিল, আর এখন ওই রমেশ আশি বছরের বুড়োর মধ্যেও আছে৷ তারপর একদিন শরীরটা জ্বলে গেল৷ এটাও একটা পরিবর্তন হ’ল৷ তারপর আবার একদিনের এক শিশুর মধ্যে সেই রমেশ জন্ম নিল৷ কিন্তু রমেশের বর্তমান পরিবারের লোকে তো আর পূর্বের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত ছিল না, তাই তারা তার নাম দিলেন নরেশ৷ রমেশের কী হ’ল? এক্ষেত্রে বিচার–শৃঙ্খলার যে তরঙ্গ ছিল তা ছিঁড়ে গেল৷ কারণ একটা মস্তিষ্কের বদলে আর একটা মস্তিষ্কে আসতে হ’ল৷ মানসিক শক্তি যা ছিল– প্রতিক্রিয়াত্মক পরিণাম যা ছিল, তাকে এক মস্তিষ্ক ছেড়ে অন্য মস্তিষ্কে আসতে হ’ল৷
তাই কিছুদিন পর্যন্ত পুরাতন স্মৃতি, পুরাতন কথা মনে থাকে৷ তারপর নোতুন মস্তিষ্ক যখন নোতুন পৃথিবীর সম্পর্কে অধিক এসে যায় তখন পুরাতন কথা সে ভুলে যায়৷ তাই চার–পাঁচ বছর পর্যন্ত পুরাতন কথা কিছু কিছু মনে থাকে৷ তারপর ভুলে যায়৷ শিশু কখনো কখনো আপন মনে হাসেও৷ পৃথিবীটা তখন তার কাছে গ্রীনল্যাণ্ড– কল্পনালোক বলে মনে হয়৷ ভারতবর্ষে আমাদের নিয়ম আছে চার–পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুরা যদি কোনো অপরাধও করে, আমরা বলি, ‘‘আরে শিশু, ছেড়ে দাও’’৷ শিশুদের লোকে ভগবানের মত মনে করে আদর করে, কারণ তারা নিষ্পাপ, তারা তো কিছু করেও না৷ যাই হোক, আমাদের মূল বিষয় হ’ল ‘সৎ’ অর্থাৎ যে সত্তা অপরিবর্তনীয় তা সৎ৷ মানুষের সাধনা হ’ল এই যে পরিবর্তনশীল ‘অসৎ’ জগত, একে অপরিবর্তনশীল জগতের দিকে নিয়ে যাওয়া৷
ত্রুটিপূর্ণ সাধনার দ্বারা কিন্তু কিছু হবার নয়৷ ‘প্রমাদ’ মানে যার আদিতে ভ্রান্তি ন্প্তপ্তব্ভব্দন্প্সুগ্গ, মধ্যে ভ্রান্তি, আর অন্তেও ভ্রান্তি৷ যে কর্ম প্রমাদপূর্ণ তা থেকে কিছু লাভ হয় না৷ যে ৰোঝে ‘পরমপিতা’ আমার পিতা, আর তাঁকে পাওয়ার জন্যে যে যত্নবান হয়, সে–ই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে৷ অন্য কেউ পারে না৷ মাঘ মাসের ঠাণ্ডায় গলাজলে স্নান করে, ভাবে রাহু চন্দ্রকে গ্রাস করছে৷ চাঁদকে যারা দেবতা বলে মনে করে, কিছুদিন পরে যখন চাঁদে কলোনি বসে যাবে তখন কী হবে? তাই, এসব হ’ল প্রমাদযুক্ত সাধনা৷
আর, এই যে ভক্তিমূলক সাধনা যাতে ‘আমি’ আর আমার ‘ঈশ্বর’ রয়েছেন, ও আমাকে চলতে হবে পরমপিতার দিকে – এই যে উপাসনা – এটাই প্রকৃত পথ৷ এই পথে যিনি এগিয়ে যাবেন তিনি অবশ্যই পরমপুরুষকে পাবেন৷
‘‘প্রণবো ধনুঃ শরোহ্যাত্মা ৰ্রহ্ম তল্লক্ষ্যমুচ্যতে৷
অপ্রমত্তেন বেদ্ধব্যং শরবত্তন্ময়ো ভবেত৷৷’’
তোমার ইষ্টমন্ত্র হ’ল ধনুক, আর তুমি নিজে হলে শর বা তির৷ তোমার তিরকে পঁৌছাতে হবে পরমপুরুষের কাছে৷ তির চালাবে কে?– যে মন প্রমাদযুক্ত নয়৷ এটাই ধর্ম৷ কারণ পরমপুরুষ তো মনের ভিতরেই আছেন৷ তাহলে তির কোন্ দিকে চালাতে হবে? ভিতরের দিকে না বাইরের দিকে? ভিতরের দিকে– ভিতরে, আরও ভিতরে, আরও ভিতরের দিকে যাও৷ ‘আত্মানং ৰিদ্ধি’– মনের মধ্যে যে ময়লা আছে সরিয়ে দাও৷ মনের ভিতরে যে ময়লা, যে অপবিত্রতা আছে তাকে সরিয়ে দিলে কী থেকে যাবে? থেকে যাবেন পরমপুরুষ৷ ময়লা সরিয়ে দিলে তিনি কি আর লুকিয়ে থাকতে পারবেন? পারবেন না৷ কেমন করে কোথায় তিনি লুকিয়ে আছেন?
‘‘তিলেষু তৈলং দধিনীব সর্পিরাপ স্রোতঃস্বসরনিষু চাগ্ণিঃ৷
এবমাত্মনিগ্রহ্যতেসো সত্যেনৈনং তপসা যো নুপশ্যতি৷৷’’
তিলে তেল হয়৷ তবে তিলের দিকে তাকালেই তেল পাওয়া যায় না৷ তেলের জন্যে তাকে পিষতে হয়৷ ভালো করে পিষলে তবে তিল থেকে খোল আলাদা হয়ে যায়, তেল আলাদা হয়ে যায়৷ ‘দধিনীব সর্পিঃ’– দইতে ঘি থাকে৷ কিন্তু ঘি পেতে গেলে দইকে মন্থন করতে হয়৷ তবে না একদিকে ঘোল আর একদিকে মাখন আলাদা হয়ে যায়৷ ‘স্রোতঃ সু আপঃ’– গরমের সময় দেখবে নদীতে জল থাকে না, কেবল বালি৷ না, শুধু বালি নয়, বালিকে হাত দিয়ে সরিয়ে দাও, দেখবে নীচে জল– অন্তর্নিহিত জলধারা৷ ‘অরণিষু অগ্ণি’– কাঠে আগুন দেখা যায় না, কিন্তু দু’টো কাঠকে ঘর্ষণ করলে আগুন দেখতে পাবে৷ ঠিক তেমনি তোমার ভিতরেও পরমাত্মা লুকিয়ে আছেন৷ তোমার মনরূপী তিলকে পেষণ করে খোল আলাদা করে দাও, তেল পেয়ে যাবে৷ তোমার মনরূপী দইকে মন্থন করলে ঘোল আর মাখন আলাদা হয়ে যাবে৷ মনরূপী নদীর বালি সরিয়ে দিলে জল বেরিয়ে পড়বে৷ তোমার মনে যে অপবিত্রতা আছে, পাপ আছে, মলিনতা আছে– যে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা আছে তা সরিয়ে দাও– পরমপুরুষ খুশি হয়ে যাবেন৷ এ কাজ কে করতে পারে? এ কাজ সেই করতে পারে যে বাহাদুর, যে বীর, যে সংগ্রামী৷ আর এই বাহাদুরীর কাজ, যে বীর তার কাজ সংগ্রামের কাজ কেবল ভক্তই করতে পারে৷ একটা কথা মনে রেখ, যে ভক্ত হয়, সে সাহসী ও বাহাদুর হয়৷ সাহসের সঙ্গে ভক্তির খুব নিকট সম্পর্ক৷ আর পাপী মাত্রেই ভীতু হয়৷
তোমরা সাধক, তোমরা ভক্ত হও৷ ভক্তিবলে মনের কালিমা সরিয়ে দাও, পরমপুরুষকে পেয়ে যাবে৷ পরমপুরুষ তোমার, আর তুমি তাঁর ছেলে, তাঁর মেয়ে৷ পরমপুরুষের কাছে পঁৌছনো তোমার কর্ত্তব্য, আর একটু চেষ্টা করলেই তুমি সহজেই তাঁর কাছে পঁৌছে যাবে৷ তোমার কাছে এটা কোনো বড় কথা নয়৷ নিজের পিতার কাছে পঁৌছনোটাই তো স্বাভাবিক৷ নিজেকে কখনও ছোট ভাববে না, নীচ ভাববে না৷ অন্য কেউ তোমাকে নীচ ভাবলেও মনে রেখ, পরমপুরুষের কাছে তুমি নীচ নও, ছোট নও৷ তুমি তাঁরই ছেলে, তাঁরই মেয়ে, এই ভেবে আদর্শকে সামনে রেখে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চল– জয় অবশ্যই হবে৷ তোমরা ষোড়শ বিধিতে দৃঢ় হও৷ আমার ছেলেরা, আমার মেয়েরা, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি৷