আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে৷
আনন্দেন জাতানি জীবন্তি৷
আনন্দং প্রয়ন্ত্যভি সংবিশন্তীতি৷৷’
অণু–ভূমা যা কিছুই উদ্ভূত বা সৃষ্ট হোক না কেন, সবই উৎসারিত হয়ে আসছে সেই এক আনন্দঘন সত্তা থেকে৷ ‘আনন্দেন জাতানি জীবন্তি৷’ সেই আনন্দঘন সত্তা রয়েছে বলেই বিশ্বের আর সব সত্তা পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়৷ জীবিত সত্তাসমূহ যে জগতে বেঁচে থাকার, দীর্ঘ জীবন লাভের ইচ্ছা পোষণ করে তার কারণ এই আনন্দঘন সত্তার প্রেরণা ও প্রেষণা৷ ‘আনন্দং প্রয়ন্ত্যভি সংবিশন্তীতি*৷ অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত সবাই সেই পরম আনন্দঘন সত্তায় ফিরে যেতে চায়৷ তাতেই মিলে মিশে এক হয়ে যেতে চায়৷ এই বিশ্বে চরম ও পরম সত্য হ’ল সেই পরম আনন্দঘন সত্তা৷ ‘সত্য’ কাকে বলব? অবিকারী বা অপরিণামী সত্তা সৎ যখন চরম প্রতিষ্ঠা পায়, যখন অপরিণামিত্বের সিদ্ধিতে চরম ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, তাকেই বলব সত্য৷ তাই মানুষকে সত্যের পথ ধরে এগিয়ে চলতে হবে, সত্যকে জীবনের চরম লক্ষ্য করে নিতে হবে৷ এটাই একমাত্র পথ, এটাই অভীঃ হবার পথ৷ মানুষের এতে ভয় পাবার কিছু নেই৷ যজুর্বেদ বলছেন ঃ
‘সত্যমেব জয়তে নানৃতং
সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ৷
যেনাক্রমন্তৃ্যষয়ো হ্যাপ্তকামা
যত্র তৎ সত্যস্য পরমং নিধানম্৷৷’
সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত সত্যেরই জয় হয়৷ শুধু সংগ্রামেই নয়, প্রতিটি ছোটখাট ব্যাপারে নিত্যনৈমিত্তিক কাজে সত্যই শেষ অবধি জয়যুক্ত হয়৷
‘সত্যমেব জয়তে নানৃতং৷ সত্যের জয় হয়, মিথ্যার নয়৷ অনৃত বা মিথ্যা কখনও জয়ী হয় না৷ ‘সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ৷’ অর্থাৎ দেবত্বের পথ এই সত্যের দ্বারাই প্রশস্ত হয়৷ অর্থাৎ এই সত্যাচরণের দ্বারা মানুষের চলার পথ এত প্রশস্ত ও মসৃণ হয় যে মানুষ সেই পথ ধরে ক্রমশঃ দেবত্বে উন্নীত হয়৷
পরমপুরুষের নির্দেশনা হ’ল আপ্তবাক্য আর জাগতিক কর্ত্তৃপক্ষের আদেশ বা নির্দেশ হ’ল প্রাপ্তবাক্য৷ এই অর্থে পুঁথিপত্র বা মনুষ্যসৃষ্ট যাবতীয় দলিল–দস্তাবেজ হ’ল প্রাপ্তবাক্য৷
পরমপুরুষের নিবিড় সান্নিধ্যে আসার পর যে মানুষের আশা–আকাঙক্ষার পূর্ণ পরিসমাপ্তি ঘটে তাকে বলা হয় আপ্তকাম৷ অতীতে সত্যের পথ ধরেই এই আপ্তকাম ঋষিরা চলতেন বলেই তাঁরা পরম নিধান পরমপুরুষের নিক্ষিড় সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন৷
‘যত্র তৎ সত্যস্য পরমং নিধানম্৷* কথাটার মানে হ’ল, তাঁরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিলেন যা হচ্ছে কিনা সত্যের পরম ধাম৷ তাই ঋষিরা বলতেন ঃ
‘সত্যব্রতং সত্যপরং
ত্রিসত্যং সত্যস্য যোনিং নিহিতং সত্যে৷
সত্যস্য সত্যমমৃতং সত্যনেত্রং
সত্যাত্মকং তং শরণং প্রপন্নঃ৷’
সেই সত্যস্বরূপ পরমপুরুষ বা আনন্দঘন সত্তার মূল বৈশিষ্ট্য কী?
‘বৃহচ্চ তদ্দিব্যমচিন্ত্য
রূপং সূক্ষ্মাচ্চ তৎ সূক্ষ্মতরং বিভাতি৷
দূরাৎ সুদূরে তদিহান্তিকে চ
পশ্যৎস্বিহৈব নিহিতং গুহায়াম৷৷’
‘বৃহচ্চ তদ্দিব্যমচিন্ত্যরূপ’৷
তিনি বিশাল....বিরাট....বৃহৎ....অতি বৃহৎ৷ এত বৃহৎ যে মানুষ চোখ দিয়ে তাঁকে দেখতে পায় না৷ মানুষের দৃষ্টি–সামর্থ্য অত্যন্ত সীমিত৷ একটা বিশেষ দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ থেকে অপর একটা দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ পর্যন্তই তার গ্রহণসামর্থ্য সীমিত৷ কিন্তু পরমপুরুষ মানুষের দৃষ্টিসামর্থ্যের অনেক অনেক বাইরে৷ আবার তিনি যে শুধু মানুষের দৃষ্টিশক্তির বাইরে শুধু তা–ই নয়, তিনি ‘অচিন্ত্যরূপম্’ অর্থাৎ তিনি অণুমানসের স্পান্দনিক গ্রহণ–সামর্থ্যেরও বাইরে৷ সোজা কথায় বলতে গেলে এই পরমপুরুষ মানুষের জ্ঞানেন্দ্রিয় তথা মনের ধরা ছোঁয়ারও বাইরে৷ এই সত্তার দৈবী জ্যোতিঃতরঙ্গ মানুষ তার সীমিত ইন্দ্রিয়শক্তি ও মনঃশক্তি দিয়ে ধরতে পারে না৷
‘সূক্ষ্মাচ্চ তৎ সূক্ষ্মতরং বিভাতি*৷ অর্থাৎ সেই পরম সত্তা কেবল যে অতি বিরাট তা–ই নয়, তিনি এত ক্ষুদ্র, এত সূক্ষ্ম যে ইন্দ্রিয়গুলো তাঁকে দেখতে পায় না, অনুভব করতে পারে না৷ এমনকি মন তাঁকে ছুঁতেও পারে না৷ আগেই বলেছি, এই সত্তাটা ছোট হতে পারে কিন্তু অত্যুজ্জ্বল সত্তা৷ দেবযোনি প্রসঙ্গে ইতোপূর্বে একবার বলেছি, এরা আকারে ক্ষুদ্র কিন্তু জ্যোতির্ময়৷
‘দূরাৎ সুদূরে তদিহান্তিকে চ*৷ ‘দূর’ মানে এখান থেকে ববহু মাইল ব্যবধানের পথ আর ‘সুদূর’ মানে ববহু দূরের ব্যবধান৷ কখনো কখনো তোমরা ভাবতে পার, হয়তো তোমার কথাগুলো, তোমার অভিব্যক্তিগুলো পরমপুরুষ শুণতে বা জানতে পারছেন না৷ যদি এমনটা ভেবে থেকে থাক তাহলে বলব তোমার যাবতীয় প্রয়াস, তোমার মান্ত্রিক অভিব্যক্তি, তোমার যাবতীয় মানসিক প্রয়াসশীলতা সব বিফলে যাবে৷ কেননা যদি ভাব যে তিনি তোমার থেকে অনেক দূরে, হতে পারে তুমি যতটা দূরত্বের কথা ভাবছ তিনি তার চেয়েও ববহু গুণ দূরে রয়েছেন৷ হয়তো তিনি এতখানি নিকটে যে তুমি যতটা নিকট ভাবছ তার চেয়েও ববহু নিকটে রয়েছেন৷ তিনি এত নিকট সত্তা যা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না৷
যাঁরা সাধনার দ্বারা অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছেন তাঁরা অনুভব করেন পরমপুরুষ তাঁদের আমিত্বের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছেন৷ আর যখন তিনি তোমার আমিত্ব–ক্ষোধের মধ্যে নিহিত রয়েছেন তখন তাঁকে জানবার জন্যে এখানে সেখানে যাবার প্রয়োজন কী? যেমন কোন রাজার রাজকোষে যাবতীয় ধন–সম্পদ মজুদ থাকা সত্ত্বেও যদি তিনি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়ান, সেটা যেমন হাস্যকর তেমনি নিজের আমিত্বের মধ্যে পরমপুরুষকে খোঁজ না করে বহির্জগতে খোঁজ করা একেবারেই নিরর্থক৷
তোমার ভেতরে তাঁর খোঁজ কর, আর খোঁজ কর চরম ঐকান্তিকতার সঙ্গে, পরম নিষ্ঠার সঙ্গে, পরম ভক্তির সঙ্গে৷ তবেই সেই চিরভাস্বর সত্তা তোমার হূদাকাশে চরম দ্যুতি নিয়ে ফুটে উঠবেন৷
(পটনা, ২০শে সেপ্ঢেম্বর, ১৯৭৮)