প্রথমেই কোন এলাকায় স্থানীয় জনসাধারণের শতকরা একশ’ ভাগের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকা উচিত৷ সমস্ত মানুষের ন্যূনতম চাহিদা, অর্থাৎ অন্ততপক্ষে উপযুক্ত খাদ্য, বস্ত্র, আবাস, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত হওয়া উচিত৷ জনগণের ১০০ শতাংশের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমেই তাদের এই মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে–দান–খয়রাতির মাধ্যমে নয়৷ আজকের দুনিয়ায় বেকারত্ব এক জটিল সমস্যা আর স্থানীয় মানুষের ১০০ শতাংশের কর্মসংস্থানের নীতিই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ৷ স্থানীয় জনসাধারণের শতকরা একশ’ ভাগের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে প্রাউট স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় বিশ্বাসী৷ স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনায় ন্যূনতম চাহিদার ভিত্তিতে অবিলম্বে শ্রম–নিবিড় শিল্প (labour-intensive industry) গড়ে’ তোলা উচিত৷ যেখানে যে ধরণের শিল্প রয়েছে সেগুলিকে আরও উৎপাদনক্ষম করে’ গড়ে’ তোলা উচিত৷ এইসব শিল্প অবশ্যই হওয়া উচিত ভোগভিত্তিক (consumption motive)৷ এই জাতীয় শিল্পকে দেওয়া উচিত যুক্তিসঙ্গত মুনাফা অর্জনের সুযোগ–যাতে করে’ এই সব শিল্পে নিয়োজিত কর্মীরা ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করতে পারে, তথা তাদের অস্তিত্ব ও বিকাশ সুনিশ্চিত করতে পারে৷ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় মূলধন–নিবিড়–শিল্প্ (Capital intensive industry) বিকাশ ঘটানো উচিত৷ ওই সামাজিক–অর্থনৈতিক এলাকার উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে এটা প্রয়োজন৷ ক্রমান্বয়ে নোতুন নোতুন শিল্পের সৃষ্টি, নোতুন নোতুন পণ্য উৎপাদন, ও সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভিত্তিতে নোতুন নোতুন প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতির প্রাণশক্তি বৃদ্ধি করা যায়৷ দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অঙ্গরূপে পরিপূর্ণ কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে দৈনিক কাজের সময়ও প্রগতিশীলভাবে হ্রাস করা যেতে পারে৷২৩
বেকার সমস্যার সমাধানে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত ও ঘাটতি, কায়িক ও বৌদ্ধিক–শ্রমের ব্যাপারটাও ভালভাবে বুঝতে হবে৷ যেমন, ভারতবর্ষের উত্তর–বিহারে, যেখানে অর্থনীতি পুরোপুরি কৃষি–নির্ভর, সেখানে কায়িক–শ্রম উদ্বৃত্ত হয়ে যায়৷ আবার কলকাতাতে উদ্বৃত্ত হয় বৌদ্ধিক–শ্রম৷ উভয় স্থনেই বেকারের সংখ্যা অত্যধিক৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই, যেখানে বেকারত্ব খুব বেশী, সেই সব অঞ্চলে কায়িক–শ্রম উদ্বৃত্ত হয়ে যায়৷ তাই ওই সব স্থানে অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্যে শ্রম–নিবিড়–শিল্প (labour-intensive industry) গড়া উচিত৷ কোন বিকাশশীল শিল্পে যখন শ্রম–ঘাটতি দেখা দেয় তখন শ্রমিকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করিয়ে ওই কর্মে নিয়োগ করা যেতে পারে৷১৩
কোন একটি অঞ্চলের উন্নতি সুনিশ্চিত করতে হলে আরও কতকগুলি সমস্যার কথা মাথায় রাখতে হবে৷ প্রথম সমস্যা তাদের নিয়ে যাদের জীবিকার জন্যে অন্য অঞ্চলে যেতে হয়, ও তজ্জনিত অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়৷ যেহেতু প্রত্যেক অঞ্চলেই কর্ম সংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, সেহেতু জীবিকার জন্যে কাউকেই নিজের অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই৷ অধিকন্তু, জীবিকার জন্যে অন্য অঞ্চলে যাওয়ার অর্থ অযথা দুটো সংসারের বোঝা মাথায় নেওয়া৷
যেখানে উপযুক্ত অর্থনৈতিক বিকাশের সুযোগ করে’ দেওয়া হয়নি, সেখানে শ্রম উদ্বৃত্ত হয়ে যায়৷ সেই সব শ্রম অন্যত্র চলে যাবার মানেই হ’ল সে অঞ্চল সব সময়ের জন্যে অনুন্নত করে’ রাখা৷ তাই যেখানে যেখানে উদ্বৃত্ত–শ্রম অঞ্চল রয়েছে সেখানে অতি শীঘ্র স্থানীয় শ্রমিকদের চাকুরির বন্দোবস্ত করে’ দিতে হবে৷ যদি তা না করে’ স্থানীয় শ্রমকে অন্যত্র বেরিয়ে যেতে দেওয়া হয়, ও মার্কসবাদীদের “He who sows shall reap” এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়, তবে যে সমস্ত চা–বাগান বা কয়লা–খনি অঞ্চল রয়েছে তার মালিক হয়ে বসবে বাইরের থেকে আগত শ্রমিকবৃন্দ, আর স্থানীয় লোক সুযোগ পাবে না৷ এতে অতীব বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে৷ তাই প্রাউটের অভিমত হ’ল–স্থানীয় লোককে প্রথমে সুযোগ দেওয়া উচিত৷ যতক্ষণ না স্থানীয় লোকদের পুরোপুরি নিয়োগ করা যাচ্ছে, ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷ পরে মজুরীর চাহিদা না আসা পর্যন্ত নোতুন কোন উন্নতি–মূলক কর্মসূচী নেওয়া হবে না৷
চাকরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয় লোককে অগ্রাধিকার দিতেই হবে, ও সমস্ত স্থানীয় লোক স্থানীয়ভাবে নিয়োজিত হবে৷ এই নীতি মেনে চললে স্থানীয় লোকদের মধ্যে ঘাটতি–শ্রম ও উদ্বৃত্ত–শ্রমের সমস্যা থাকবে না৷
পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর চাকরী প্রাপ্তি ও তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির উদ্দেশ্যে কিছু কিছু দেশে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু আছে৷ প্রাউট–আদর্শ অনুসারে অবশ্যই সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকা উচিত নয়৷ যখন প্রাউট–ব্যবস্থার প্রবর্ত্তন হবে, তখন যেহেতু সকলের প্রগতিই সুনিশ্চিত হবে, সেহেতু কেউই চাকরীতে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে না৷
যাইহোক, বর্তমান সামাজিক–অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের দুর্দশা মোচনের উদ্দেশ্যে তাৎক্ষণিকভাবে নিম্নলিখিত অগ্রাধিকার ব্যবস্থা চালু করা যায়–
প্ত জন্মসূত্র যাই হোক না কেন, পিছিয়ে পড়া, গরিব পরিবারের সদস্য চাকরী ও শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম অগ্রাধিকার পাবে৷
প্ত গরিব, কিন্তু পিছিয়ে পড়া নয়, এমন পরিবারের সদস্য দ্বিতীয় অগ্রাধিকার পাবে৷
প্ত গরিব নয়, কিন্তু পিছিয়ে পড়া পরিবারের সদস্য তৃতীয় অগ্রাধিকার পাবে৷
প্ত সবশেষে সুযোগ পাবে গরিবও নয়, পিছিয়ে পড়াও নয়, এমন পরিবারের সদস্য৷
এখানে ‘পিছিয়ে পড়া পরিবার’ বলতে বোঝাবে যে পরিবারের সদস্য অতীতে কোন চাকরী বা শিক্ষার সুযোগ পায়নি৷ যতক্ষণ না দেশ দারিদ্র্য মুক্ত হয়, অর্থাৎ যতক্ষণ না সকলের ন্যূনতম প্রয়োজন প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হয় ততক্ষণ এই পরিবারগুলি এই সুবিধা পেতে থাকবে৷