সৎসঙ্গেন ভবেন্মুক্তি

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

                ভগবান শংকরাচার্য বলেছিলেন–

                ‘‘ত্যজ দুর্জনসংসর্গং ভজ সাধু সমাগমম্৷

                কুরুপুণ্যম্ অহোরাত্রম্ স্মরনিত্যম্ অনিত্যতাম্৷৷’’

পৃথিবীতে সব জীবই আসে, থাকে, চলে যায়৷ ‘যঃ আগচ্ছতি সঃ গচ্ছতি’ – এই হ’ল জগতের ধর্ম৷ কিন্তু কিছু জীব আছে, আসে, খায়, মরে যায় কারণ তারা অস্তিত্বের মূল্যটা ৰোঝে না৷ যে জীব অস্তিত্বের মূল্যটা ৰোঝে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মূল্যটা ৰোঝে সেই মন প্রধান৷ এটা মানতেই হবে যে তার মন উন্নত, তাই না সে ৰোঝে৷ এই মনপ্রধান জীবকে বলা হয় মানুষ৷ মানুষ কেবল আসে, খায় মরে যায়, তা নয় এসে সে এমন কিছু করে যায় যাতে পৃথিবীতে তার একটা ছাপ থেকে যায়৷ বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘জন্মেছি যখন একটা দাগ রেখে যেতে হবে, একটা ছাপ রেখে যেতে হবে’৷ সব মানুষের গুণ সমান নয়, যোগ্যতা সমান নয়, সমান অভিরুচিও নয়৷ মানুষ নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী, অভিরুচি অনুযায়ী একটা কিছু বড় কাজ, পৃথিবীর জন্যে করে রেখে যায় সেইটাই তার দাগ রেখে যাওয়া, ছাপ রেখে যাওয়া৷ দাগ শব্দটা হ’ল ফারসি, ছাপ শব্দটা হ’ল পর্তুগীজ৷ তা পৃথিবীতে মানুষ থাকবে কিভাবে? তাকে যদি কিছু কাজের কাজ করতে হয়, তাকে কি ভাবে থাকতে হয় সেটাও তাকে ৰুঝতে হবে৷ কারণ এমন ভাবে তাকে থাকতে হবে যাতে সে কাজের কাজ করে যেতে পারে৷ এ ব্যাপারে শংকরাচার্য বলছেন ‘ত্যজ দুর্জন সংসর্গম’, দুর্জনের থেকে দূরে থাকবে৷ দুর্জন কাকে বলে? এটা একটা Relative term, আপেক্ষিক তত্ত্ব৷ একজনের কাছে যে খারাপ অপরজনের কাছে সে ভালও হতে পারে৷ একজন হয়তো দুর্দান্ত ডাকাত, সবাই তাকে ভয় পাচ্ছে, সবাইকার কাছে সে খারাপ আর তার ছোট্ট মেয়েটির কাছে তার বাবাটি বড়ই ভাল৷ সে কত আদর করে তার ছোট্ট মেয়েটিকে, সেই ছোট্ট মেয়েটির কাছে তার বাবা আবার দুর্জন নয়৷

এখন দুর্জন–সুজনের ব্যাখ্যা হচ্ছে এই ,যার সংস্পর্শে এলে তুমি ব্যষ্টিগত জীবনে বা সামূহিক জীবনে লাভবান হবে, উন্নত হবে, তোমার শারীরিক মানসিক, আধ্যাত্মিক কল্যাণ হবে, সেই ব্যষ্টিটি তোমার কাছে সুজন বা সজ্জন৷ অনেক সময় লোকে কী করে –– সভার শ্রোতাদের সন্তুষ্ট করবার জন্যে বলে, ‘পেয়ারে সজ্জনোঁ’, কিন্তু এই যাদের উদ্দেশ্যে করে ‘পেয়ারে সজ্জনোঁ’ বলা হ’ল তাদের অনেকেই হয়তো সজ্জন নয়৷ তা সজ্জন নয়৷ তাই সজ্জন তারাই যাদের সংস্পর্শে এসে তোমার আধিভৌতিক, আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়৷ আর যার সংস্পর্শে এসে অধোগতি হয় তাকেই বলা হয় দুর্জন, কাজেই এটা একটা আপেক্ষিক তত্ত্ব৷ একজন মহাপুরুষের কাছে, একজন বড় সন্ন্যাসীর কাছে একজন চোর হয়তো দুর্জন নয় কারণ সেই চোরের সংস্পর্শে এসে সাধুর অধোগতি হচ্ছে না, কিন্তু একজন সাধারণ লোকের কাছে সে চোরটা দুর্জন৷ ব্যাপারটা এই রকম৷ মানুষকে সব সময় সঙ্গবিচার করে চলতে হবে৷ সৎসঙ্গের ফলটা হয় কি? – না, মনের ওপর তার গভীর রেখাপাত হয়, একটা ভাল লোকের সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকলে মানুষের মনে ইচ্ছা যায় যে আমিও ভাল হব৷ আবার একজন মাতালের সঙ্গে থাকলে ইচ্ছে যায় মদ যদি খেলুম ক্ষতিটা কী? এই রকমের মানসিকতা পেয়ে বসে৷ চুরি যদি করলামই, ক্ষতিটা কী? চোরের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে চুরির ইচ্ছে যায়৷

ছোট্ট একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি৷ যেমন, চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে চায়ের গন্ধটা যখন বাতাসে ভেসে আসে তখন মন বলে ওঠে, ‘ইধার ভি এক পেয়ালা জী’৷ দেখ কাণ্ড, এই গন্ধটার প্রভাব পড়ে গেল৷ আর যদি ওই দোকানের কাছে না থাকতে, গন্ধটা নাকে না আসতো তাহলে হয় তো সে দু’তিন দিন চা খেতই না৷ এ হ’ল সঙ্গে প্রভাব৷ তা মানুষকে সবসময়ে সঙ্গনির্বাচন ঠিক ভাবে করতে হবে৷ আর এ ব্যাপারে ভুল হলে গোটা জীবনটা পস্তাতে হয়৷ এমন কি, যে অভিভাবকরা ৰোঝেন যে তাঁরা ভাল নন তাদের উচিত তাঁদের সন্তানকে ভাল হোষ্টেলে রাখা বা অন্য কোন ভাল আত্মীয়ের কাছে রাখা, যাতে তাঁদের প্রভাবে সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত না হয়৷ এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে চলতে হয়৷ তন্ত্রে বলা হয়েছে ঃ–

‘‘সৎসঙ্গেন ভবেন্মুক্তিরসৎসঙ্গ্ বন্ধনম্৷

অসৎসঙ্গমুদ্রণম্ যা সা মুদ্রা পরিকীর্ত্তিতা৷৷’’

তন্ত্রে মুদ্রা সাধনা বলে একটা জিনিস আছে৷ তার মানে হচ্ছে যে সৎসঙ্গে মানুষ মুক্তিলাভ করে৷ এখানে মনে রাখবে, মুক্তি মানে যে কেবল আধ্যাত্মিক মুক্তি তা নয়, মুক্তি হ’ল জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তি৷ Salvation in all spheres of life, salvation in all strata of life.  জীবনকা হর পহলু মে মুক্তি৷ তা এভাবে সামাজিক–র্থনৈতিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তির সংগ্রাম করতে হয়৷ যেখানে অন্ন নেই, সেখানে অন্ন পাবার সংগ্রাম৷ বস্ত্র নেই, তো বস্ত্র পাবার সংগ্রাম সেচ ব্যবস্থা নেই, তো সেচ ব্যবস্থা পাবার সংগ্রাম৷ গৃহ নেই, গৃহ পাবার সংগ্রাম৷ আর আত্মার সবচেয়ে বড় মুক্তি হ’ল, আত্মাকে ৰন্ধন থেকে মুক্ত করা, সেইটাই যথার্থ মুক্তি৷ আধ্যাত্মিক মুক্তিই যথার্থ মুক্তি, বাকী মুক্তি যথার্থ মুক্তি নয় এই কারণে যে আজ ৰন্ধন থেকে মুক্ত হলাম, কালকে আবার সেই ৰন্ধন আসতে পারে৷ যেমন ক্ষুধার ৰন্ধন৷ ক্ষুধার ৰন্ধন থেকে মানুষ আজ মুক্তি পেল, কালকে আবার ক্ষুধা পাবে৷ কিন্তু আধ্যাত্মিক মুক্তি হ’ল স্থায়ী মুক্তি, আত্যন্তিকী নিবৃত্তি৷