সৃষ্টিরহস্যের মূলে পৌঁছোবার জন্যে মানুষের যে এষণা তার থেকেই জন্ম হয়েছিল অধ্যাত্মবাদের৷ প্রকৃতির জগতে একদিকে বিভীষিকা আবার অন্যদিকে অনুপম সৌন্দর্য, তার পেছনে মূল কারণটা কী? তা জানার জন্যে মানুষের প্রয়াস শুরু হয়েছিল৷ চারিপাশে বিস্তারিত নদীনালা, সুবিশাল পর্বতশ্রেণী, বজ্র–বিদ্যুতের ঝলকানি, আবার ভীষণাকার পশুদের রক্ত হিমকরা গর্জন৷ এসব দেখেশুণে তাদের উৎস সম্বন্ধে মানুষের মনে নানা প্রশ্ণের উদয় হ’ল৷ নিজের ভেতরে এইসব চিরন্তন প্রশ্ণের উত্তর খুঁজে পাবার যে প্রচেষ্টা, তাই হ’ল তন্ত্র৷ বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ব্যষ্টিদের দ্বারা এই প্রচেষ্টা চলেছিল৷ এই কারণেই তান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যে আমরা অল্পবিস্তর পার্থক্য দেখতে পাই৷
এই তন্ত্রের চর্চা সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়৷ অষ্ট্রিক ও মঙ্গোলিয়ান বর্গভুক্ত মানুষদের মধ্যেই এর প্রচলন ছিল৷ এদের মধ্যে কেউ ছিল প্রাগ্রসর আর কেউ অনগ্রসর৷ অপেক্ষাকৃত উন্নত তন্ত্র অনুযায়ী সংকীর্ণ ভাবনাকে বর্জন করে তান্ত্রিককে ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গী নিতে হত৷ এই ধরনের তান্ত্রিকেরা জনকল্যাণের কাজে নিজেদের সর্বদা নিয়োজিত রাখত, আর এইভাবে সেবামূলক কাজের সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণা, লজ্জা ইত্যাদি পাশকে জয় করবার চেষ্টা করত৷ কিন্তু যারা অবনত স্তরের তান্ত্রিক তারা এসবের বিপরীত আচরণ করত৷ তারা অন্য গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি ঘৃণা, দ্বেষ পোষণ করত৷
স্থূল জাগতিক ৰন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়াই হচ্ছে সত্যিকারের প্রগতি৷ তন্ত্রের মাধ্যমেই এই স্থূলতা তথা জড়তা থেকে ত্রাণ বা পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব৷ তাই তন্ত্রসাধনাই হচ্ছে সর্বোচ্চ স্তরের সাধনা৷ সদাশিব ছিলেন তন্ত্রের আদিপুরুষ৷ তিনি এক দৃঢ় নিয়মৰদ্ধতার মধ্যে তন্ত্রের সমস্ত অঙ্গকে এনে ফেলে তাকে এক পূর্ণ রূপ দিলেন৷ তিনি তন্ত্রের বহিরঙ্গিক দিক ও অন্তর্মুখী সাধনা–এ দু’য়েরই প্রয়োজনীয় অংশকে সংগ্রথিত করে তন্ত্রসাধনাকে শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে উন্নীত করলেন৷ যেমন কপাল সাধনা বা শ্মশান সাধনাকে বহিরঙ্গিক সাধনা আর যোগসাধনাকে বলা হত তন্ত্রের সূক্ষ্মতর অন্তর্মুখী সাধনা৷ এইভাবে এই দুইয়ের সমন্বয়ে সংঘটিত তন্ত্রসাধনার মাধ্যমেই মানুষ আধ্যাত্মিকতার চরম সার্থকতায় পৌঁছোতে পারে৷
প্রকৃতিকে খোশামোদ করে মানুষ ৰন্ধন থেকে মুক্তি পেতে পারে না৷ কেননা যাকে খোশামোদ করা হচ্ছে সেও তো অহঙ্কারী হয়ে উঠবে৷ জড়ের দাসে পরিণত না হয়ে বরং জড়কে উপেক্ষা করে মানুষ পরমপুরুষের সাধনা করবে৷ তাহলে উল্টে প্রকৃতিই সাধককে অনুরোধ–উপরোধ করা শুরু করবে৷
আসলে পৃথিবীতে অলৌকিক নামে কোন জিনিস নেই৷ মানুষের মধ্যেই সমস্ত শক্তি নিহিত আছে যার অভিপ্রকাশ কখনোও কখনোও তার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়৷ পরিমার্জিত ভাষায় তাকেই ৰুদ্ধি তথা ৰোধি বলা হয়৷ এসবের উপযুক্ত বিকাশ হলে মানুষ অসাধারণ শক্তির অধিকারী হয়৷ অন্যের দৃষ্টিতে হয়তো তা অস্বাভাবিক লাগে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা স্বাভাবিক৷ সাধারণ ব্যষ্টি এরকমটা করতে পারে না৷ সেজন্যে তারা সেই শক্তিকে অস্বাভাবিক বলে ধরে নেয়৷ এইভাবে তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে সাধক অসাধারণ শক্তি অর্জন করতে পারে৷
তন্ত্রসাধনায় অল্প সময়ের মধ্যে মনের ওপর থেকে পাশের ৰন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়৷ যতক্ষণ পর্যন্ত মন ৰন্ধনযুক্ত অবস্থায় থাকে তার গতি থাকে জড় বস্তুর প্রতি, মন জড়কে অবলম্বন করেই তার অস্তিত্ব বজায় রাখে৷ কিন্তু তন্ত্রসাধনার ফলস্বরূপ মন স্থূলতা থেকে সরে যায়৷ এইভাবে মানুষ ক্রমোন্নতির পথে এগিয়ে চলে৷ এই ভাবেই বিকাশোন্মুখ মন শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রগতির পথে অগ্রসর হয়৷ মানসাধ্যাত্মিক প্রগতির কারণে মানুষের মধ্যে অসাধারণ ৰুদ্ধি জেগে ওঠে৷ আর তখনই একজন সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হন৷ রিপু হ’ল মানুষের অভ্যন্তরীণ শত্রু৷ এর ওপর বিজয়লাভ মানে হচ্ছে রিপু মানুষের বশীভূত হয়ে যায়৷ ওই অবস্থায় জড়তত্ত্বের ওপর সাধকের অধিকতর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়৷ অন্যের দৃষ্টিতে সেটাই এক অদ্ভূত শক্তি বলে বিবেচিত হয়৷ একেই বলে অলৌকিক শক্তি৷
তন্ত্রের বিধি অনুযায়ী জড়তত্ত্বের ওপর বাহ্যিক ভাবে জয় পাওয়ার চেষ্টাকে অবিদ্যা সাধনা বলে৷ আর আত্মজ্ঞান লাভের জন্যে যে সাধনার অনুশীলন করা হয় তা হ’ল বিদ্যা সাধনা৷ কিন্তু যা বিদ্যা বা অবিদ্যার মধ্যে পড়ে না তা হচ্ছে উপবিদ্যা৷ মানুষের পক্ষে বিদ্যা সাধনাই কল্যাণকর বা শ্রেয়স্কর৷ বাকি দুই সাধনা কেবল সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই নয়৷ মারণ, উচ্চাটন, সম্মোহন ইত্যাদি অবিদ্যা সাধনা করার ফলশ্রুতি হচ্ছে অধোগতি প্রাপ্তি৷ আদিগুরু সদাশিব সব কিছুকে সংগ্রথিত করেছেন৷ কিন্তু এই অবিদ্যা ও উপবিদ্যার সাধনাকে মোটেই প্রোৎসাহিত করেন নি৷ কেননা এইগুলি নিম্নস্তরের সাধনা৷ অলৌকিক শক্তিলাভের যে সাধনা তা মনকে জড়াভিমুখী করবেই৷ তাই এ থেকে সাময়িকভাবে প্রাপ্ত শক্তি অবিদ্যা সাধক সমাজে নিজের প্রতিষ্ঠা লাভ আর বিদ্বেষ ভাবনা চরিতার্থ করবার জন্যে ব্যবহার করবে৷ গত ১২০০ বছর ধরে বিদ্যা সাধনা প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল৷ আর অবিদ্যা সাধনা যারা করত তার মধ্যে দু’একজন ছাড়া বাকি সব ছিল কপটাচারী, অন্যকে ঠকানোই হ’ল তাদের পেশা৷ মৃত্যুর পরে এই ধরনের মানুষেরা ঘৃণ্য কীট হয়েই জন্মাবে৷
মানুষ সাধনা করবে ব্রহ্মসম্প্রাপ্তির জন্যে, পিশাচ হবার জন্যে নয়৷ এই মহত্তম লক্ষ্যপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে মানুষকে করতে হবে বিদ্যাতন্ত্রের সাধনা, অবিদ্যাতন্ত্রের পথ তাকে বর্জন করে চলতে হবে৷ এই দুই প্রকার সাধনার দ্বারাই পাশরিপুর* ৰন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব৷ এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তফাৎ হচ্ছে এই যে, বিদ্যাতন্ত্রের সাধক তার সাধনালব্ধ শক্তিকে পুরোপুরি প্রধাবিত করে দেয় পরমাত্মার প্রতি৷ আর অবিদ্যা তান্ত্রিকেরা সেই শক্তিকে নিজেদের জাগতিক স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগায়৷ একজন যেখানে অর্জিত শক্তি ব্যয়িত করবে মানুষ বা অন্য জীবকে বশীভূত করবার জন্যে সেখানে বিদ্যাতন্ত্রের সাধক সেই শক্তি দিয়ে পরমপুরুষকে ৰাঁধবে, তাঁকে আরও আপন করে পাবার জন্যে, কেননা পরমপুরুষই তার একমাত্র ধ্যেয়৷ তাঁর সাথে একাত্ম হওয়ার জন্যেই সমস্ত শক্তিকে সে নিয়োজিত করবে৷
চিকিৎসা বিদ্যার দিক থেকেও তন্ত্রসাধনার গুরুত্ব আছে৷ প্রাচীনকালে বৈদিক আয়ুর্বেদাচার্যরা তান্ত্রিক না হবার কারণে সঠিকভাবে রোগের চিকিৎসা করতে পারতেন না৷ তাঁরা ঘৃণা, স্পৃশ্য–অস্পৃশ্য ৰোধ, জাতিভেদমূলক ভাবনা ইত্যাদির দ্বারা গ্রস্ত থাকার কারণে অন্যের শরীর স্পর্শ করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হতেন৷ কিন্তু তান্ত্রিক পথাবলম্বী বৈদ্যেরা ঘৃণা–লজ্জা–ভয়কে জয় করে ঠিকভাবে জনসেবা করতে পারতেন৷ শব ব্যবচ্ছেদ, শল্য চিকিৎসা এসব তান্ত্রিক বৈদ্যেরাই করতেন৷
জুন ১৯৬২, মুজফফরপুর