সভ্যতার ঊষালগ্ণ থেকেই ত্রিপুরা ৰাঙলার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ প্রাচীনত্বের দিক থেকে রাঢ়ের পরেই এর স্থান৷ গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত একই মাটি, একই জল, একই মানুষ, ও একই ভাষা নিয়ে ৰাঙালীরা এখানে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বসবাস করে আসছেন৷ পাঁচশ বছর আগেও ত্রিপুরার নাম ছিল ‘শ্রীভূম’৷ ত্রিপুরা নাম খুব বেশী দিনের পুরনো নয়৷ বর্তমান ত্রিপুরা, নোয়াখালী, পার্বত্য ত্রিপুরা, কাছাড়, মণিপুর, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আরাকান রাজ্যের কিয়দংশ নিয়ে ছিল ‘শ্রীভূম’৷ ভারতীয় প্রাচীন নথিপত্রে শ্রীভূমকে ‘উপৰঙ্গ’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে৷ শ্রীভূম বা উপৰঙ্গের আদিম অধিবাসী সবই ৰাঙালী৷ ব্যতিক্রম শুধু টিপ্রা–রা৷ প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর আগে মু–চাং–ফার নেতৃত্বে সুদূর ক্ষ্রহ্মদেশ থেকে আগত টিপ্রা–উপজাতিরা শ্রীভূমে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল৷ পরে তারা স্থানীয় হিন্দু রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে আর ত্রিপুরা রাজ্যের পত্তন করে৷ সেই সময় থেকে মু–চাং–ফা–র অধীনস্থ শ্রীভূম ত্রিপুরা নামে অভিহিত হয়ে এসেছে৷ কেননা এই ত্রিপুরা তখন টিপ্রা শাসনাধীন ছিল৷ চৈতন্য মহাপ্রভু এই সময়ে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের জন্যে শ্রীভূমে যান৷ মু–চাং–ফা ও রাজপরিবারের সকলেই শ্রীচৈতন্যের কাছ থেকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন ও ৰাংলাভাষা ও সংসৃক্তিকে নিজের ভাষা ও সংসৃক্তি বলে গ্রহণ করেন, আর ব্যষ্টি নামগুলিও পালটে ৰাংলা নাম গ্রহণ করতে শুরু করেন৷ মু–চাং–ফা ৰাংলা জানতেন না কিন্তু রাজভাষা হিসেবে ৰাংলাকেই তিনি গ্রহণ করেন৷ শ্রীভূমের যে অংশটুকু মু–চাং–ফা দখল করেছিলেন সেই অংশ ছাড়া শ্রীভূমের অন্যান্য অংশগুলি মোগলযুগের শুরুতেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ টিপ্রা অধিকৃত অংশটুকুর সংশোধিত নামকরণ হয় ত্রিপুরা৷ টিপ্রা জাতির শাসনাধীন রাজ্য এই অর্থেই সংশোধিত নাম হল ত্রিপুরা৷
ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত ত্রিপুরার ভাষা ছিল ৰাংলা৷ টিপ্রাদের নিজস্ব ভাষা ‘কক বরক’৷ বলাবাহুল্য এই ভাষা বার্মা উপজাতীয় ভাষা, এই অর্থে বহিরাগত৷ স্থানীয় মাটি ও মানুষের সঙ্গে ‘কক বরক’ ভাষার কোনো যোগ নেই৷ স্বাধীনতার পরবর্ত্তী অধ্যায়ে ত্রিপুরা সরকারী ও বেসরকারি কাজকর্ম চালানোর ব্যাপারে ৰাংলাভাষাকে সরিয়ে বহিরাগত ইংরেজী, হিন্দীকেই স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর চাপানো হয়েছে৷ আর বামফ্রন্ট সরকার বিভেদপন্থী রাজনীতিকে ত্রিপুরার বুকে প্রয়োগ করার জন্যে ৭০ হাজার টিপ্রা–র কথ্য ভাষা–যে ভাষা বহিরাগত– সেই কক বরক’ ভাষাকে সাড়ে ১৭ লক্ষ ৰাঙালীর ওপর চাপিয়েছে৷ সভ্যতার ইতিহাসে এই বিভেদনীতির কোনো নজির নেই৷ দীর্ঘ শতাব্দী ধরে ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মে সংসৃক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গড়ে ওঠা যে ৰন্ধন, সেই মৈত্রী ও ঐক্যৰোধ, কলুষিত রাজনীতির কদর্য প্রয়োগে আজ দিগন্তে বিলীন হতে চলেছে–যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হ’ল ত্রিপুরার সার্বিক বিপর্যয়৷
প্রাচীন হিন্দু–ৰৌদ্ধ–পাঠান– এমনকি ব্রিটিশ আমলেও ত্রিপুরা ছিল অর্থনীতিতে স্বনির্ভর৷ ১৯৪৭ সালে ৰঙ্গ বিভাগের মাধ্যমে এই স্বনির্ভর অর্থনীতির মূলে কুঠারাঘাত করা হ’ল৷ র্যাড্ক্লিফ, রোয়েদাদ্ অনুযায়ী ত্রিপুরার কৃষিজ সমৃদ্ধ অঞ্চলটি পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হ’ল, আর জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্য অঞ্চলটুকু ভারত ইউনিয়নের জন্যে নির্দিষ্ট করা হ’ল৷ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোয় পার্বত্য ও অনুন্নত জঙ্গল অঞ্চল নিয়ে এখন ত্রিপুরা রাজ্যের পরিচিতি লাভ করেছে, যা আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত৷
স্বাধীনতার পরে ত্রিপুরা অবহেলা, বঞ্চনা আর শোষণের শিকার হয়েছে৷ ভারতের পঁুজিবাদীদের স্বার্থে, ত্রিপুরা কেন্দ্রীয় সরকারের করুণার দানের ওপর নির্ভর করে চলতে হয়, তাই তার অস্তিত্বই বাঁচিয়ে রাখা সমস্যা৷ এখন ত্রিপুরার প্রায় ১৭,৭৫,০০০ লোকের চরম দারিদ্র্য রাজ্যের রাজনৈতিক নেতাদের হাতে এক অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে তা ব্যবহার করে চলেছে৷ চরম আর্থিক অনিশ্চিততা আর রাজনৈতিক হিংসা ত্রিপুরায় জেনেৰুঝে প্রোৎসাহিত করা হয়েছে, ও তা করা হয়েছে সেখানকার মানুষদের জাগ্রত রাজনৈতিক চেতনাকে রুখতে৷ ত্রিপুরার মানুষদের অনেক গা শিউরে ওঠা ও হিংস্র ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, এর কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের ষড়যন্ত্র৷ তাছাড়া স্বশাসিত জেলাপরিষদ আইনের মাধ্যমে ৭,০০,০০০ উপজাতিদের মধ্যে ত্রিপুরার প্রায় ৭০ক্ম জমি বিতরণ করে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে ১৭,৭৫,০০০ ৰাঙালী বঞ্চিত হয়েছে৷ ত্রিপুরার আজকের যে পরিস্থিতি তা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের সুদূরপ্রসারী ৰাঙালী বিরোধী নীতি আর কম্যুনিষ্টদের রাষ্ট্রবিরোধী তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী ষড়যন্ত্রের পরিণতি৷
ত্রিপুরার বর্তমান আর্থিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চিততা সত্ত্বেও এই অঞ্চলের খুবই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে কেননা এ রাজ্য প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ৷ ত্রিপুরার ভূচিত্র ঠিক যেন একটা বড় গামলার মত– বাইরের সীমানা ভেতরের অংশ থেকে উঁচু৷ এদিক থেকে এর ভৌগোলিক চেহারা আয়ারল্যান্ডের মত৷ দু’য়ের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, ত্রিপুরার পাহাড় আর মাটির নীচেকার কঠিন ভূস্তর গ্রেনাইট দিয়ে তৈরী, তাই ত্রিপুরার জমি পাথুরে কিন্তু আয়ারল্যান্ড তা নয়৷ যদিও আয়ারল্যান্ড খুব উন্নত নয়, তবুও ত্রিপুরার সামাজিক–র্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা রচনা করতে হলে বহু ক্ষেত্রে এই আয়ারল্যান্ডের মডেলকেই অনুসরণ করা উচিত৷
প্রাচীনকালে ত্রিপুরার বিশাল জ৷লগুলিতে হাতি আর গণ্ডারে ভরা ছিল আর তা ছিল ত্রিপুরার মধ্যাংশে, রাজ্যের রাজধানী সহ অন্যান্য শহর আর কৃষিজমি ছিল জ৷লের চারিপাশে বাইরের সীমানায়৷ মধ্যাংশের মাটি কাজুবাদাম, আনারস আর কলা চাষের পক্ষে খুবই উপযোগী৷ সাধারণভাবে ত্রিপুরার সর্বত্র গ্রানাইট পাথরের সে৷ সংলগ্ণ মাটি এঁটুলে মাটি যা কৃষির পক্ষে আদর্শ, বিশেষ করে কমলানেবুর জন্যে৷ ত্রিপুরার সীমান্তে ৰাঙলাদেশ সংলগ্ণ অঞ্চল বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চল৷ তাই ত্রিপুরায় কৃষির উন্নতির সম্ভাবনা প্রচুর৷ যাই হোক্, গ্রানাইট পাথুরে জমির জন্যে এখানে আমন ধান খুব ভাল না হলেও আউশ ধান ভাল হবে৷ আউশ ধানের পরে জমিতে লঙ্কার চাষ করা উচিত যা একটি অর্থকরী ফসল, কেননা ৰাঙলাদেশে এর চাহিদা প্রচুর৷ আউশ ধান কাটার পরে যখন জমি ভিজে থাকে তখন শুকনো লঙ্কা বুনে দেওয়া যেতে পারে৷ শুকনো লঙ্কার চাষে গমের মতই জলসিঞ্চনের দরকার পড়ে৷ যেখানে জলাভাব আছে সেখানে ছোট দানার ছোলা হতে পারে৷ আয়ারল্যান্ডের মত প্রচুর লাল খোসার আলুর উৎপাদন হতে পারে আয়ারল্যান্ডের লোকেরা আলু আর পরিজ খেয়েই থাকে৷ ত্রিপুরায় এত আলুর উৎপাদন হতে পারে যা ত্রিপুরা ছাড়াও সমগ্র অসমকে খাওয়াতে পারে তাই ত্রিপুরায় আলুর প্রক্রিয়াকরণের জন্যে অনেক শিল্প গড়ে উঠতে পারে৷
উঁচু জমিতে যেমন আলু, আনারস আর কাজুবাদাম চাষ হতে পারে, তেমনি নীচের জমিতে কলার চাষ ভাল হবে৷ সব প্রকারের আদা –সাদা, হলুদ আর কালো – তার চাষও হতে পারে৷ বড় আকারের কচুও ভাল হতে পারে কিন্তু পূর্ণ অবস্থায় আসতে কচু প্রায় এক বছর সময় নেয়৷ মিজোরামের পরে বিশ্বে ত্রিপুরাতেই দ্বিতীয় উত্তম প্রজাতির বাঁশ উৎপাদিত হতে পারে৷ ফাঁপা বাঁশ কাগজ তৈরীর জন্যে সর্বোত্তম৷ তোমাদের বিভিন্ন প্রকার মিশ্র চাষ আর ঠিক কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে তা হতে পারে, সেটাও জানতে হবে৷ আখের চেয়ে সুগার বিটের চাষ বেশী করে করা উচিত কেননা বছরে যেখানে চারবার সুগার বিটের ফলন হয়, সেখানে আখ নেয় পুরো এক বছর৷ সুগার বিট থেকে চীনী পাওয়া যাবে কিন্তু গুড় নয়, আর সুগার বিট এক অর্থকরী ফসলও বটে৷ আখের থেকেই গুড় তৈরী করা হবে আর তার ছোব্রা কাগজ উৎপাদনের কাজে লাগানো যাবে৷ সুগার বিটের ক্ষীজ তৈরী করতে হবে ঠাণ্ডা অঞ্চলে যার জন্যে হিমাচল প্রদেশ আর কশ্মীর সবচেয়ে উত্তম৷ যাই হোক্ নিজস্ব স্থানেই এই ক্ষীজের উৎপাদন করাটাই সবচেয়ে ভাল৷ ত্রিপুরায় কৃষিভিত্তিক আর কৃষিনির্ভর দু’ধরনের শিল্পই গড়ে তোলা যেতে পারে৷
ত্রিপুরায় এ্যালকোহল, ওষুধপত্র, ঔষধীয় উদ্ভিজ্জ আর সিল্ক্ এ সবই উৎপাদিত হতে পারে, আর ত্রিপুরাতে নিকৃষ্ট মানের কয়লাও পাওয়া যায়৷ এককালে ত্রিপুরা সারগোসা সমুদ্রের অংশ ছিল, তাই সেখানে তেলও পাওয়া যেতে পারে৷
ত্রিপুরার উন্নতির জন্যে তোমাদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে সামূহিক জ্ঞান থাকতে হবে–মাটির অবস্থা, নদী ব্যবস্থা, কৃষি–ফলচাষ–শিল্প সম্ভাবনা, সেচ, শক্তি উৎপাদন ও সরবরাহ, খনিজ সম্পদ আর সংসৃক্তি৷ যদি ঠিকভাবে সামাজিক–র্থনৈতিক পরিকল্পনা রচিত হয় তাহলে ত্রিপুরার ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল৷