কোচ ঃ কুচ+ঘ=কোচ৷ ‘কুচ্’ ধাতুর অর্থ হ’ল আকর্ষণ করা, আশ্রয় দেওয়া, আশ্রয় দেওয়ার মত আকর্ষণ করা৷ যেমন শৈলোপকন্ঠ, যেমন সাগরবেলা , যেমন তরঙ্গ–কান্তার, যেমন হরিৎমেখলা৷ বরেন্দ্র রাঢ় তৈরী হবার বহু পরে হলেও অক্ষশিষ্ট বাঙলা যখন তৈরী হয়েছিল....সেও আজকের কথা নয়৷ সেও কয়েক লক্ষ বছর হয়ে গেছে৷ হয়তো সে সময়টা মানুষের আসার কিছুটা পরেই৷ তবে তা খুক্ষ বেশী পরে নয়৷ ওলিগোসিন ও মেসাজোয়িক এজের মধ্যবর্তী কোন একটা সময়ে নিশ্চয়ই ৷ পশ্চিম রাঢ়ের নদীগুলির দ্বারা বাহিত পলি বালিতে তৈরী হ’ল প্রথমে পূর্ব বরেন্দ্র রাঢ়, ও তার পরে পশ্চিম বরেন্দ্র রাঢ় ও পূর্ব রাঢ়ের নদীগুলির দ্বারা বাহিত পলি বালিতে দক্ষিণ দিক থেকে তৈরী হয়েছিল মেন সমতট তেমনই গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্রের পলিক্ষালিতে তৈরী হতে লাগল বরেন্দ্র (বরূ্র+ইন্দ্র=বরেন্দ্র)৷ শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে শ্রেষ্ঠের শ্রেষ্ঠ বা সেরার সেরা)৷ সবশেষে তৈরী হল শ্রীভূমি (শ্রীহট্ট) ও চট্টল ও উপবঙ্গ সহ সমগ্র বঙ্গ (ডবাক্) বা পূর্ববাঙলা৷ সমতট, বরেন্দ্র ও ক্ষঙ্গের মৃত্তিকা হ’ল অত্যুর্বর৷ অল্পকালই সেখানে গজিয়ে উঠেছিল সবুজ অরণ্যানী৷ রাঢ়ের মানুষ কোদাল কুড়ুল হাতে চলল পূর্ব দিকে.....সমতটে.....সমতট পেরিয়ে বঙ্গে৷ যখন সমতট ও বঙ্গে আর্য্য সভ্যতার পত্তন হ’ল তখন (রক্ত–বিচারে ও মৌলিক সংস্কৃতিতে বাঙালী আর্য নয়) বাঙালীর উপর এসেছিল আর্য সংস্কৃতির মুদ্রাবর্ণ (রঙের ছাপ)৷ কেবল বাঙালীই বা বলি কেন কাশীর পূর্বস্থিত সমগ্র ভারত সম্বন্ধেই এই কথাটা প্রযোজ্য৷ রাঢ়ের মানুষেরাই গঙ্গা পার হয়ে গেছল বরেন্দ্রে৷ তাই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মূলতঃ বরেন্দ্র রাঢ় থেকেই সমতটে ও বঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল৷৷ তোমরা একটু খোঁজ নিলেই জানবে সমতটে নিজস্ব কোন সারস্বত সমাজ •Intellectual Society— নেই৷ তা রাঢ়ের সংস্কৃতিরই পুনঃস্থাপন৷ বঙ্গে বঙ্গজ কায়স্থ ও বঙ্গজ বৈদ্য যাঁরা আছেন তাঁরাও যথাক্রমে হুগলী জেলার হরিপাল ও বর্ধমান জেলার শ্রীখণ্ড থেকে বঙ্গে গেছলেন৷ আর বঙ্গে যাঁরা ব্রাহ্মণ আছেন তাঁরা রাঢ়ের এত জায়গা থেকে গেছলেন যে এজন্যে কোন বিশেষ স্থানের নাম নেওয়া যায় না৷ তাই পূর্ব বাংলায় তথাকথিত বঙ্গজ ব্রাহ্মণ নেই৷ পুরুষানুক্রমে যাঁরা ক্ষাস করে আসছেন তাঁরা পরিচয় দেক্ষার সময় এখনও নিজেদের বরেন্দ্র রাঢ়ী ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দেন৷ এই জিনিসটাকে সমাজ শাস্ত্রের ভাষায় বলা হয় সাংস্কৃতিক অধ্যারোপণ •cultural trans-plantation—৷ বরেন্দ্রের ব্যাপারেও ঘটেছিল জিনিসটা কতকটা এই রকমই৷
রাঢ়ের মানুষ গঙ্গা বা পদ্মা পার হয়ে যখন পূর্বে না গিয়ে গেল উত্তরে......হাতে তাদের কোদাল কুড়ুল, সঙ্গে তাদের রাঢ়ের zebu বর্গীয় গোরু, কাঁধে লাঙল–জোয়াল, উত্তর থেকে তখন এসেছিল মঙ্গোলীয় সংস্কৃতির একটি উপধারা৷ এই বরেন্দ্র রাঢ়ীয় ও মঙ্গোলীয় তত্ত্বের মাধুর্য্যময় বিমিশ্রণে গড়ে উঠল বরেন্দ্রের বাঙালী সমাজ৷ বর্ণ তাদের বরেন্দ্র রাঢ়ী বাঙালীর চেয়ে কিছুটা ফ্যাকাশে, নাসা কিছুটা অবনত, মানুষ হিসেবে খুবই সভ্য, ভদ্র ও সরল৷ সেদিনই আমরা বাঙালী জাতির প্রাণীন সম্পদ হিসেবে পেলুম বরেন্দ্রভূমির জাত–বাঙালী কৈবর্ত্তদের৷ আমি অন্যত্র বলেছি বাঙালী মাত্রেই ছিল আদিতে এই কৈবর্ত্ত৷ এই কৈবর্ত্তরা যেমন বরেন্দ্র রাঢ় থেকে সমতটে গেছলেন তেমনই তাঁরা বরেন্দ্র রাঢ় থেকে উত্তরে বরেন্দ্রেও গেছলেন৷ মধ্যবঙ্গের নির্যাস–বাঙালী নমঃশূদ্ররা ওই কৈক্ষর্ত্তদেরই একটি অলঙ্করণ৷ বরেন্দ্রে মানুষও কৈবর্ত্তেরই অনুধৃতি৷ দক্ষিণ বাংলা বা মেদিনীপুরের মাহিষ্যদের সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক ফল্গুধারা একই প্রবাহে বিধৃত৷ অর্থাৎ রক্তে বয়ে চলেছে একই জাত–বাঙ্গালীর কোমল–কঠোর অনুরণন৷ বৌদ্ধযুগের শেষ চরণে বরেন্দ্রের এই কৈক্ষর্ত্তরাই রাজা দ্বিতীয় দেবপালের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখর হয়েছিলেন৷ পৃথিবীর ইতিহাসে এই ধরণের সুসংঘটিত গণ–ক্ষিদ্রোহ বাঙালী জাতির মধ্যে এনেছিল নবজাগরণ....এনেছিল নূতন ভাবের দিগ্বলয়কে চেনক্ষার উদগ্র চেতনা৷ এই কৈবর্ত্তরাই চললেন উত্তরদিকে ও উত্তর পশ্চিমে৷ যাঁরা উত্তর–পশ্চিমে গেলেন তাঁরা মিথিলায় নতুন জীবনধারার পত্তন করেন৷ আজও সেই মৌলিক কৈবর্ত্ত বাঙালীরা সহস্রে সহস্রে পূর্ণিয়া–সহর্ষা অঞ্চলে রয়ে গেছেন৷ যাঁরা উত্তর–পূর্ব দিকে চললেন তাঁরা সমগ্র বাংলায় এই পথেই এগিয়ে গেলেন৷ এই কৈবর্ত্ত সমাজে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা কিঞ্চিদধিক ছিল৷ যাঁরা উত্তর–পূর্ব কোণে গেলেন তাঁরা সমাজ সংরক্ষণের জন্যে বাধ্য হয়ে মঙ্গোলীয় নারীর পাণিগ্রহণ করলেন৷ এইভাবে তৈরী হ’ল বাঙালী প্রজন্মের নবতর শাখা৷ এঁরাই উত্তরে এগুতে এগুতে হিমালয়ের প্রান্তিক শিখর পর্যন্ত অগ্রসর ও অগ্রেসর হলেন৷ ভূটান থেকে উদ্ভুত সংকোচ নদীর উভয় তীরে তাঁরা বসবাস করতে শুরু করলেন৷ বাঙালীর এই নব প্রজন্ম সংকোচ নদীর নাম থেকেই ‘কোচ’ নামে অভিহিত হ’ল৷ দুঃখের দিনে বাঙালীর জীবনে বড়বড় উল্কাপাত ও উল্কাঘাতের দিনে এঁরাই ছিলেন বাঙলার সক্ষচেয়ে বড় আশ্রয় ও সম্পদ৷ এই কারণেই এঁদের বলা হত ‘কোচ’৷ অর্থাৎ কেবল সংকোচ নদীর জন্যেই নয় আশ্রয়–দাতৃ মনোভাবের জন্যেও এঁদের বলা হত কোচ৷ এই কোচ জাতির এক আদর্শক্ষাদী তরুণ যখন দেখলেন বাংলার সমাজ জীবন বিপর্যস্ত হতে চলেছে..........সাংস্কৃতিক জীবনে নেবে এসেছে অবক্ষয় তখন বাংলার জীবনকাঠির মূর্ত্ত প্রতীক হিসেবে তিনি এগিয়ে এলেন.....এই মেচ্ বংশীয় বাঙালী তরুণ (মতান্তরে মেচেরা তখন কোচের শাখা হিসেবে গণ্য হয়নি৷ একই জাতি হিসেবে গণ্য হত) মাত্র দুই শত নিষ্ঠাবান যুবকের সাহায্যে পত্তন করলেন সংকোচ উপত্যকায় কামতাপুর রাজ্য৷ ওই তরুণটির নাম ছিল হরিদাস মণ্ডল (এ ব্যাপারে কিছুটা মতভেদও অবশ্য আছে)৷
প্রাক–বৌদ্ধ যুগ থেকে বাংলা পাঁচটি ভাগে বিভক্ত ছিল ভৌগোলিক বিভিন্নতা তথা শাসনতান্ত্রিক সুবিধার জন্যে–১) ভাগীরথীর পশ্চিমে বরেন্দ্র রাঢ়, ২) ভাগীরথী ও মধুমতীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে সমতট (বাগড়ী), ৩) পদ্মার উত্তরে বরেন্দ্র, ৪) মধুমতীর পূর্বে ক্ষঙ্গ আর ৫) পদ্মার উত্তরে ও কোশী (কৌশিকী) নদীর পশ্চিমে মিথিলা৷ অন্যগুলির তুলনায় আয়তনে বরেন্দ্র রাঢ় ও বরেন্দ্র ছিল একটু বড়৷ তাই অন্যান্য অংশগুলি ছিল এক একটি ভুক্তি অর্থাৎ সমগ্র সমতট নিয়েই ছিল বাগড়ীভুক্তি৷ সমগ্র ক্ষঙ্গ এলাকা নিয়ে ছিল বঙ্গভূক্তি, সমগ্র মিথিলা নিয়ে ছিল তীরভুক্তি (তীরহৃত ঃ অবশ্য ‘ত্রি–হোতীয়’ থেকেও ‘তীরহৃত’ শব্দটি এসে থাকতে পারে)৷ কিন্তু বরেন্দ্র রাঢ় ও বরেন্দ্র অঞ্চল তুলনামূলক বিচারে কিছুটা বড় হওয়ায় এদের ছিল দুটি করে ভুক্তি৷ রাঢ়ের উত্তরাংশ (তৎকালীন দামোদর নদীর গতিধারার উত্তরে ঃ দামোদর আজকাল সে খাতে বয় না) অর্থাৎ বর্ত্তমান ধানক্ষাদ, বর্দ্ধমান, বীরভূম, দেওঘর, দুমকা, গোড্ডা, সাহেক্ষগঞ্জ ও বরেন্দ্র রাঢ়–মূর্শিদাবাদ নিয়ে ছিল বর্ধমান ভুক্তি (সেকালে হুগলী–হাওড়া বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত ছিল) আর মেদিনীপুর, বাঁকুড়া , মানভূম, পূর্বরাঁচী, সিংভূম ও ভঞ্জভূম নিয়ে ছিল দণ্ডভুক্তি (মেদিনীপুর)৷ ঠিক তেমনই বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণ অংশে ছিল পৌন্ড্রবর্ধন ভুক্তি আর উত্তরাংশ নিয়ে ছিল কামতাপুর ভুক্তি হরিদাস মণ্ডলকে সেকালে প্রাণরস–সিঞ্চিত বাঙালী কৈবর্তরা তাঁদের নেতারূপে নির্বাচন করেন ও সেই সঙ্গে তাঁকে করলেন কামতাপুরের রাজা৷ এই হরিদাস মণ্ডলের সময় থেকে এতদঞ্চলের কৈ্বর্ত্তরা ‘কোচ’ নামে অভিহিত হয়৷ কালক্রমে ও গুণগত বিচারে কোচেরা চারটি শাখায় বিভক্ত হয়–১) মেচ, ২) রাজক্ষংশী, ৩) রাজগুণ ও ৪) কোলিয়া (কোল্লিকা>কোলিয়া)৷ বলা বাহুল্য, মাত্র এই চারেরাই জাতবাঙালী ও বাঙালী সংস্কৃতির ধারকতা–বাহকতা ও পরিপোষকতার কাজটি জীবনের ধ্যেয়রূপে গ্রহণ করলেন ও বাঙালী–সংস্কৃতির আশ্রয় বা ‘কোচ’ হিসেবে নিজেদের নামের যোগ্যতার পরিচয় দিতে থাকলেন৷
পরবর্ত্তীকালে কামতাপুর ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে যায়–পূর্বাংশের নাম হয় বিজনী ও পশ্চিমাংশের নাম হয় কোচবিহার৷ এই কোচেরা প্রাচীনকাল থেকে ছিলেন শিবভক্ত৷ জৈন ও বৌদ্ধধর্ম্মের প্রভাব তাঁদের ওপরে মোটামুটি রকমের পড়লেও ব্যাপকভাবে পড়েনি৷ তবে বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণাংশে অর্থাৎ পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তিতে বৌদ্ধধর্ম্মের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল৷ পরবর্তীকালে পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির বৌদ্ধ প্রভাবিত মানুষেরা ইস্লাম ধর্ম্ম গ্রহণ করেন৷ কামতাপুর ভুক্তিতেও সেই ব্যাপারই ঘটেছিল তবে কামতাপুর ভুক্তির তুলনায় পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তিতে ইস্লাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা তুলনামূলক বিচারে বেশী৷ বাণেশ্বর, বাণগড়, জটেশ্বর, জল্পেশ্বর প্রভৃতি নামগুলি আজও এতদঞ্চলে শৈব প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়৷
বার্মা থেকে আগত অহমেরা ব্রহ্মপুত্র– উপত্যকার উজান অংশ দখল করেন, কিন্তু নিম্নাংশে অর্থাৎ বরেন্দ্রভূমিতে তাঁরা চরণ–চারণা করতে সক্ষম হননি৷ তাই অসমীয়া সংস্কৃতিতে অহম প্রভাব বিরাট ও ব্যাপক হলেও কামতাপুরে বা বরেন্দ্রে অহমে প্রভাব তিলমাত্র নেই৷ স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণে অসমীয়া ভাষায় অহোম প্রভাব সবাই স্বীকার করেন৷ কিন্তু বরেন্দ্রে সামান্যতম অহম প্রভাব–ও নেই৷ কামরূপ ও গোয়ালপাড়া জেলা দু’টির কথ্য ভাষার দিকে তাকালেই এই সত্য সূর্য্যলোকের মত স্পষ্ট হয়ে যায়৷ ইংরেজরা কামতাপুর রাজ্যের পূর্বাংশ অর্থাৎ বিজনিকে সম্পূর্ণভাবে নিজের দখলে নিয়ে নেন ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের •Permanent settlement—। আওতায় জমিদারিতে রূপান্তরিত করেন৷ পশ্চিমাংশ অর্থাৎ কোচবিহার রাজ্যের বৃহদংশ নিজেদের দখলে আনেন ও মাত্র আটটি থানাকে মহারাজার অধীনে দেশীয় রাজ্যরূপে থাকতে দেন৷ সুক্ষৃহৎ কামতাপুর রাজ্য শেষ পর্য্যন্ত কোচবিহার নাম দিয়ে মাত্র আটটি থানায় হ্রস্বায়িত হয়৷ এই আটটি থানা হচ্ছে– কোচবিহার, তুফানগঞ্জ, দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা, মেখলিগঞ্জ, সিতাই, শীতলকুচি ও হল্দিবাড়ী৷ ইংরেজরা কোচবিহারের ক্ষৃহদংশ নিজেদের দখলে আনেন৷ তার উত্তর–পশ্চিমাংশ অর্থাৎ ডালিমকোট এলাকাকে সিকিম থেকে প্রাপ্ত হিমালয়ের পার্ক্ষত্য অংশের সঙ্গে যুক্ত ক’রে দার্জিলিঙ জেলা তৈরী করেন৷ ডালিমকোট অংশের গোড়ার দিককার কর্মপীঠ ছিল ফাঁসিদেওয়া৷ পরে তা শিলিগুড়িতে স্থানান্তরিত হয়৷ দার্জিলিঙ জেলার সমতল অংশের বাসিন্দারা তখনও ছিলেন এখনও আছেন–কোচ–গোষ্ঠীভুক্ত বাঙালী৷ পার্বত্য অঞ্চলে অর্থাৎ দার্জিলিঙ, কালিম্পং ও খরষাণ (যাকে বিকৃত করে কার্সিয়াং বলা হয়)–এর অধিবাসীরা লেপচা ও ভূটিয়া (এরা ধর্মে লামাবাদী বৌদ্ধ)৷ ইংরেজ কর্তৃক বিজিত হবার পরে অর্থোপার্জনের জন্যে নেপাল থেকে বহু নেপালী এখানে আসেন৷ এই নেপালীরা ক্ষহু ভাষাভাষী ও বহু ধর্ম্মাবলম্বী (মুখ্যতঃ হিন্দু ও বৌদ্ধ)৷ অধিকাংশের ভাষা ‘রাই’ ভাষা৷ এছাড়া গুরুং, মগর, নেওয়ারী, লিম্বু, লিম্পো, থারু, কিরাত, শেরপা প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকেরাও এঁদের মধ্যে রয়েছেন৷ নেপালের বর্তমান রাজভাষা গোর্খালী৷ নেপালে কিন্তু গোর্খারা সংখ্যাগুরু নয়৷ তারা ছিল শাসক৷ তাই তাদের ভাষা গোর্খালী আজ নেপালের রাজভাষা (ভুল করে লোকে আজও ওই গোর্খালী ভাষাকে নেপালী ভাষা বলে থাকেন)৷ গোর্খাদের পূর্বে নেপালের রাজা ছিলেন নেওয়ারী৷ সে সময়ে মৈথিল অক্ষরে (বাংলা অক্ষর) মৈথিলী ভাষাই ছিল নেপালের রাজভাষা৷
যাই হোক, দার্জিলিঙ–এর পার্বত্য অঞ্চলের খুব কম লোকের ভাষাই এই গোর্খালী (যাকে ভুল করে নেপালী ভাষা বলা হয়)৷ একটু আগেই বললুম যে ডালিমকোট এখন শিলিগুড়ি নামে পরিচিত৷ ডালিমকোট ্বাদে কোচবিহারের যে ক্ষৃহদংশ ইংরেজরা দখলে আনেন, তাঁরা তার নাম রাখেন রংপুর জেলা৷ জেলাসদর (কর্বট) হয় রংপুর৷ রংপুর জেলাটি আয়তনে অতি ক্ষৃহৎ হওয়ায় পরবর্ত্তীকালে ইংরেজরা জেলাটিকে ভেঙ্গে তিন টুকরো করে দেন–দক্ষিণাংশের নাম রংপুরই থেকে যায়–সদর থেকে যায় রংপুরেই৷ উত্তরাংশের নাম রাখা হয় জলপাইগুড়ি–সদর হয় জলপাইগুড়িতে৷ উত্তর–পূর্বাংশের নাম দেওয়া হয় উত্তর–পূর্ব রংপুর–সদর হয় ধুবড়িতে৷
১৯১২ সালে যখন অসম প্রদেশ তৈরী হয়, তখন দেখা যায় অসম প্রদেশের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়৷ কলকাতার পৌরসভার বার্ষিক আয়ের চেয়ে নবগঠিত অসমের বার্ষিক আয় কম৷ তাই এই নবগঠিত রাজ্যের আর্থিক অবস্থা দৃঢ় করার জন্যে বাংলার সিলেট, কাছাড় ও উত্তর–পূর্ব রংপুর জেলা তিনটিকে নবগঠিত অসম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়৷ রংপুর রইল বাঙলায়, আর উত্তর–পূর্ব রংপুর গেল অসমে৷ এটি একটি বিসদৃশ্য ব্যাপার৷ তাই ইংরেজরা উত্তর–পূর্ব রংপুর জেলার নাম পরিবর্ত্তন ক’রে নূতন নাম দেন গোয়ালপাড়া৷ তবে জেলাসদর থেকে যায় ধুবড়িতেই৷ সম্প্রতি গোয়ালপাড়া জেলাটি ত্রিধাবিভক্ত হয়েছে–১) ধুবড়ি, ২) কোকরাঝাড় ও ৩) গোয়ালপাড়া৷
বর্ত্তমান কামরূপ জেলার পশ্চিমাংশ এককালে কামতাপুর রাজ্যের অধীনে ছিল৷ কামরূপ জেলার কামাখ্যা পাহাড়টি দীর্ঘকাল ধরে কামতাপুর রাজ্যের দখলে ছিল৷ কামখ্যা দেবীর মন্দিরটিও কামতাপুরের রাজারা তৈরী ক’রে দিয়েছিলেন ও কয়েকবার সারিয়েও দিয়েছিলেন৷ এ প্রসঙ্গে কামতাপুরের রাজা শুক্লধ্বজের নামটিও স্মর্ত্তব্য৷ যাঁরা অসমের শাক্তমৌয়াসারিয়া সংগ্রামের ইতিকথা জানেন একথাও তাঁরা নিশ্চয় জানেন৷
পরবর্ত্তীকালে কামরূপ অহম নৃপতিদের দখলে চলে যায়৷ দীর্ঘকাল অহম শাসনে থাকায় কামরূপের কথ্য ভাষায় ও উচ্চারণে (অসমীয়া ভাষার ভাটিয়া উপভাষা) স্বাভাবিক নিয়মে অহম–প্রভাব এসে পড়ে৷ কিন্তু গোয়ালপাড়ার কথ্য ভাষায় অহম–প্রভাব সঙ্গত কারণেই পড়েনি৷ গোয়ালপাড়ার সাংস্কৃতিক জীবন তাই বরেন্দ্রের সংস্কৃতিরই অনুরণন......গোয়ালপাড়ার ভিজে মাটিতে বরেন্দ্র জীবনেরই সোঁদাগন্ধ......আজও গোয়ালপাড়ার নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে রয়ে গেছে কোচ জনজীবনের উহাবোহের উষ্ণ প্রাণের সুমধুর নির্যাস৷
যাই হোক, তোমরা কোচেদের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানলে ও তা জেনে কোচদের নিয়ে বেশ গৌরব অনুভব করছ নিশ্চয়৷