(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
একটা গল্প আছে যে এক জ্ঞানী আর এক ভক্ত আমবাগানে গেল৷ জ্ঞানী পর্যবেক্ষণ করা শুরু করল–এগুলি ল্যাংড়া আম, না হিমসাগর, না অন্য কোনো প্রজাতির আম৷ পৃথিবীতে প্রায় পনেরশো প্রজাতির আম আছে৷ জ্ঞানী দেখতে শুরু করল যে বাগানে আরও কত রকমের আম গাছ আছে৷ এই বিশ্লেষণ অনেকক্ষণ পর্যন্ত চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত সূর্যাস্ত হ’ল আর আমের বাগানে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো৷ তখন জ্ঞানী তাড়াতাড়ি আবার কোন্ গাছে কত পাতা আছে, কত শাখা–প্রশাখা আছে, তা গুনতে শুরু করল৷ রাত বাড়তে থাকল৷ কিন্তু এর মধ্যে ভক্ত কী করল? সে সোজা আমগাছে চড়ে একের পর এক আম খেয়ে চলেছে৷ তাহলে দেখা গেল জ্ঞানীর চেয়ে ভক্ত বেশী বুদ্ধিমান৷ তারা সময়ের সদ্ব্যবহার করে, আর তোমরা জান যারা তা করে, অন্যের চেয়ে তারা বেশী বুদ্ধিমান হবেই৷
এখন দেখা যাক্, ভক্তের আচারণটি ঠিক কী রকমের? ভক্ত প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী থাকে যে পরমপুরুষই তারই৷ কোনো বস্তু যদি একজনের হয় তাহলে সেই মানুষটির আর ওই বস্তুটির মধ্যে কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা থাকে না৷ ধর, একটি ছেলে, সে বলছে–‘‘আমার বাবা’’৷ সেই ছেলেটি পণ্ডিত বা মূর্খ হতে পারে, সে ধনী বা দরিদ্র হতে পারে, কিন্তু তার বাবাতো তার নিজের, আর সে অতি সহজে বাবার কাছে চলে আসতে পারে, তার সেবা করতে পারে৷ সে সময় কোনো পিতা বলবেন না–‘‘তুমি মূর্খ, এখান থেকে চলে যাও৷’’ পিতা কখনও এমন কাজটি করবেন না৷
এইভাবে ভগবান আর ভক্তের সম্পর্ক পিতা–পুত্রের সম্পর্কের মত৷ এই পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তেই থাকে৷ এর ফলে (ভক্তের) আন্তরিক মনোভাব অত্যন্ত পবিত্র থাকবে৷ তাই মহান লোকেরা বলে থাকেন যে ভক্তি হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ৷ মনের বিস্তারের জন্যে এই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতি৷ আর তন্ত্রের সার কথাই যেহেতু বিস্তার ও তার ফলশ্রুতি জাগতিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাওয়া, তাই ভক্তিই হ’ল সর্বশ্রেষ্ঠ তন্ত্র৷ এই জন্যেই আমি বারংবার বলি যে তন্ত্র ও যোগ একে অন্যের থেকে পৃথক নয়৷ তারা প্রায় একই জিনিস৷*
ভক্ত আসন, প্রাণায়াম, ধারণা, ধ্যান ঙ্মতন্ত্র ও যোগের বিভিন্ন প্রক্রিয়া অভ্যাস করবে আর সে সময়ে তার মনে একটাই চিন্তাপ্রধান হয়ে থাকবে যে–সে যে সত্তার ভাবগ্রহণ করছে তিনি তার নিকটতম আপনজন, আর এত আপন অন্য কেউ নয়৷ এই চিন্তার ফলে ভক্তের মন অতি অল্প সময়ের মধ্যে অনেকখানি বিস্তারিত হয়ে যাবে৷
‘‘জীবাত্মা আর পরমাত্মার সংযোগই হচ্ছে যোগ৷ এই সংযুক্তি, এই সম্পূর্ণ একাত্মতা আসবে কী করে? বিস্তারের মাধ্যমেই তথা বন্ধন থেকে মুক্তির মাধ্যমেই তা সম্ভব, যার অর্থ তন্ত্রসাধনার নিরন্তর অনুশীলন করে চলা৷ অধ্যাত্ম–সাধনার এই বাস্তবমুখী কাল্ট একমাত্র তন্ত্রেই আছে৷ অন্য কিছুতে নেই৷... মহান লোকেরা বলে থাকেন যে ভক্তি ঙ্মযোগক্ষ হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ৷ মনের বিস্তারের জন্যে এই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতি৷ আর তন্ত্রের সার কথাই যেহেতু বিস্তার ও তার ফলশ্রুতি জাগতিক বন্ধন থেকে ছিন্ন হয়ে যাওয়া, তাই ভক্তিই হ’ল সর্বশ্রেষ্ঠ তন্ত্র৷’’
একজন কর্মীর জীবনের কীর্ত্তনে হয়তো বড় ভূমিকা নাও থাকতে পারে কিন্তু ভক্তের জীবনে কীর্ত্তন** হচ্ছে অপরিহার্য৷ আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় যে, ভক্ত কীর্ত্তন ছাড়া বাঁচতে পারে না৷ ঠিক যেমন তুমি জল থেকে মাছকে ডাঙায় তুললে মাছের যা অবস্থা হয়, বেশীক্ষণ ডাঙায় থাকলে মাছের মৃত্যু অনিবার্য৷ যদি ভক্তকে কীর্ত্তন করতে না দেওয়া হয়, তাহলে তারও মৃত্যু ঘটবেই৷
ভক্তের অন্তরের ভাব আর তার প্রকৃত রহস্য একমাত্র পরমপুরুষই জানেন৷ জামালপুরে আমি তোমাদের বলেছিলুম, পরমপুরুষ বৈকুণ্ঠে থাকেন না, কোনো স্বর্ণসিংহাসনেও উপবিষ্ট থাকেন না, যোগীদের হৃদয়েও তিনি বিরাজ করেন না৷ তার আবাসস্থল ভক্ত হৃদয়৷ ভক্ত অবশ্যই তার অন্তরে পরমপুরুষের কথাই ভেবে চলবে, কেননা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক যে ভালবাসা ও ভক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ তাই না পরমপুরুষ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করলেন–‘‘মদ্ভক্তা যত্র গায়ন্তি, তত্র তিষ্ঠামি নারদঃ’’–‘হে নারদ আমার ভক্তরা যেখানে আমার কীর্ত্তন করে, আমি সেখানেই অবস্থান করি’৷
দার্শনিকতার দিক থেকে পরমপুরুষ সর্বত্র বিরাজিত৷ কিন্তু কেন্দ্রবিন্দু তো একটি বিশেষ স্থানেই না থাকবে৷ সেই স্থানটি বৈকুণ্ঠ নয়, সেই বিশেষ স্থানটি হ’ল সেখানে যেখানে ভক্তরা তাঁরই গুণকীর্ত্তন করছে৷
তাই তোমরা দেখেছ যখন ভক্তরা গভীর ভালবাসা–ভরা আকুতি নিয়ে কীর্ত্তন করে তখন অতি শক্তিশালী আধ্যাত্মিক স্পন্দনের সৃষ্টি হয়৷ যারা যে সময়ে কীর্ত্তন করছে তারা সে সময় তাদের মনে, হৃদয়ে সর্বত্র সেই স্পন্দন অনুভব করে৷ তারা সেই অসীমিত আনন্দলহরীতে যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে৷ জ্ঞানী কিন্তু এই অভূতপূর্ব আনন্দের আস্বাদ পাবে না৷ জ্ঞানী একদিন পরমপুরুষকে পাবে কিনা সেটা অন্য কথা, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে সে এই অমৃত আনন্দের আস্বাদ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবে৷ কর্মীর ক্ষেত্রেও সেই একই কথা৷ ভক্তই একমাত্র এই অপার আনন্দের অধিকারী হবে–যেন একমাত্র ভক্তের কাছে এই পরম আনন্দের সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত আছে৷
*‘‘তন্ত্রে মূলতঃ দু’টি শাখা রয়েছে–একটি স্থূল, অপরটি সূক্ষ্ম৷ এই সূক্ষ্ম সাধনাকে যোগমার্গও বলা হয়৷ স্থূল–সূক্ষ্মের মধ্যবর্তী যে স্তর তা মধ্যম মার্গ (মঝ্ঝিমা মাগ্গ) রূপে স্বীকৃত৷ তন্ত্রের উভয় শাখারই (তন্ত্র ও যোগ) প্রবক্তা ছিলেন সদাশিব৷ তাই এতদুভয়ের মধ্যে কোনো বিরোধই থাকতে পারে না৷’’ ‘‘তন্ত্র ও সাধনা’’, –সুভাষিত সংগ্রহ, অষ্টম খণ্ড৷
**লেখক সাধনার সহায়ক হিসেবে ও অন্যান্য অনেক প্রভাবের কথা বিবেচনা করে সিদ্ধ কীর্ত্তন–মন্ত্র ও বিশেষ মুদ্রা ও নৃত্য–ভঙ্গিমা সহযোগে অখণ্ড কীর্ত্তন, কোনো আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেব কীর্ত্তন–এমনকি তাণ্ডব ও কৌশিকী নৃত্য সহযোগে কীর্ত্তনের বিধি প্রবর্ত্তন করেছেন৷ এ সম্পর্কে লেখকের লিখিত পুস্তকটির নাম ‘‘ভক্তিরস ও কীর্ত্তন মহিমা’’৷ –সম্পাদক৷