যোগদিবস ও যোগসাধনা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্যমন্ডিত মৈত্রী, সম্প্রীতি, শান্তি ও মিলনের ক্ষেত্র আমাদের দেশ এই ভারতবর্ষ যোগসাধনার পীঠস্থান হিসেবে সমগ্র বিশ্বে  স্বীকৃত ও বন্দিত৷ অতিপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষের মুনিঋষিগণ  বহু সাধনার মাধ্যমে মানুষের শারীরিক,  মানসিক ও  আধ্যাত্মিক স্তরের সর্বাত্মক উন্নতিকল্পে নানাবিধ প্রক্রিয়া-পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন ও গুরু-শিষ্য পরম্পরায় সেই শিক্ষা কালক্রমে সাধারণ মানুষের কল্যাণে প্রসারিত হয়েছে৷ সুদীর্ঘ সাধনার অভিজ্ঞতায় তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন যে আধ্যাত্মিক সাধনার পথে অগ্রগতি আনতে হলে শারীরিক সুস্থতা ও মানসিক স্বচ্ছতা একান্ত প্রয়োজন৷ মানুষের শরীরে যে সকল গ্রন্থি-উপগ্রন্থি রয়েছে সেগুলি থেকে অজস্র গ্রন্থিরস নিঃসৃত হয়৷   ওই গ্রন্থিরস গুলির ক্ষরণের মাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে শারীরিক সক্ষমতা, সুস্থতা  ও বিভিন্ন মানসিক বৃত্তিগুলির ক্রিয়াশীলতারও হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে৷ অতীতের মনীষীগণ  দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলে গ্রন্থিরসগুলির ক্ষরণের মাত্রা ও কার্য্যকারিতা নিয়ন্ত্রণের জন্যে বিভিন্ন কৌশল ও পন্থা আবিষ্কার করে’শিষ্যদের মাধ্যমে জনসাধারণের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন৷ বাহ্যিক অঙ্গসৌষ্ঠব নয়, আভ্যন্তরীণ সুস্থতা ও মানসিক শান্তি প্রদান ক’রে আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনই ছিল সেই সব কৌশলের মূল লক্ষ্য৷ এই কৌশলগুলি যোগ সাধনা নামে সমধিক পরিচিত৷ বর্তমানে  ভারতবর্ষের বিভিন্ন যোগগুরু বা যোগাচার্য্যগণ দেশে  ও বিদেশে অসংখ্য যোগকেন্দ্রে সাধারণ মানুষদের  যোগ শিক্ষা প্রদান করছেন৷ অবশ্য ওই সব যোগকেন্দ্রে যোগাসনকে আধ্যাত্মিকতার অঙ্গ হিসেবে নয়, মূলতঃ রোগ নিরাময়ের নিদান ও অর্র্থেপার্জনের উপায় হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে--- আর এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে বহু অর্থব্যয়ে চটকদারী বিজ্ঞাপনও প্রকাশিত হচ্ছে৷ এছাড়া যোগাসনের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্যে গত কয়েক বছর ধরে ২১শে জুন তারিখটি ‘‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’’রূপে পালিত হয়ে চলেছে৷ যোগদিবসে সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যাপকস্তরে যোগচর্র্চ, যোগশিক্ষা, যোগসংক্রান্ত আলোচনা ও মানব কল্যাণে যোগাভ্যাসের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ের নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷ এটি একটি সাধু উদ্যোগ৷

এখন আলোচনা করা যাক--- ‘যোগ’ কী? যোগ বলতে আমরা সাধারণ অর্থে বুঝি যুক্ত করা বা মিলিয়ে দেওয়া৷ সংসৃকতে ‘যোগ’ শব্দটি দুইভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে ৷ প্রথমটি, যুজ্ ধাতুর সঙ্গে  ঘঞ প্রত্যয় যুক্ত করে (যুজ+ ঘঞ) ‘যোগ’ শব্দ পাওয়া গেল--- যার অর্থ হল  একটির সঙ্গে অপর একটি বস্তু বা অন্য কিছু যুক্ত হয়েছে৷ আর সেই যোগের পরেও উভয়ের অস্তিত্ব বজায় থাকছে ৷ যেমন একটি কলার সঙ্গে আরেকটি কলা যোগ করে দুইটি কলা পাওয়া গেল৷ দ্বিতীয়টি, যুন্জ্ ধাতুর সঙ্গে ঘঞ্ প্রত্যয় যুক্ত করেও (যুন্জ্+ ঘঞ্)  ‘যোগ’ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে--- যার অর্থ হল মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া৷ এই  যোগের পরে সাধারণ অবস্থায় উভয়ের অস্তিত্ব প্রকটিত হয় না৷ যেমন জলে চিনি বা লবণ মিশিয়ে দিলে দ্রবণ সৃষ্টি হবে আর সেখানে চিনি বা লবণকে পৃথকভাবে দেখা যাবে না---অর্থাৎ সাধারণভাবে মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া৷ সাধারণতঃ ‘যোগ’ সম্পর্কে মোটামুটিভাবে তিনটি সংজ্ঞা পাওয়া যায়---

১) যোগশ্চিত্ত বৃত্তিঃ নিরোধঃ৷

২) সর্বচিন্তা পরিত্যাগো নিশ্চিন্তো যোগ উচ্যতে৷

৩) সংযোগো যোগো ইত্যুক্ত জীবাত্মা পরমাত্মনঃ৷

উপর্যুক্ত তিনটি সংজ্ঞার মধ্যে তৃতীয়টি  সর্বাপেক্ষা যুক্তিসম্মত কারণ এখানে  দুটি সত্তাকে পাওয়া যাচ্ছে  যারা সংযুক্ত হচ্ছে৷  বিশেষ প্রক্রিয়ার দ্বারা জীবাত্মা  যখন পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে, মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, তাকেই বলা হচ্ছে যোগ৷ আধ্যাত্মিকতার বিচারে প্রতিটি  জীবাত্মাই পরমাত্মার প্রতিফলন মাত্র৷ আর যোগসাধনার মাধ্যমে যখন এই জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায় তখন জীবাত্মা পরমাত্মাতেই পরিণত হয়ে যায় ও জীবাত্মার কোন পৃথক অস্তিত্ব থাকে না৷ বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির জল সমুদ্রে মিশে সমুদ্রেই পরিণত হয়ে যায় ---সেই বারিবিন্দুগুলিকে পৃথকভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না৷ এই  জীবাত্মা-পরমাত্মার মহামিলনেই  ‘যোগ’ শব্দটির প্রকৃত সার্থকতা ও মাহাত্ম্য পরিস্ফূট হয়৷

ভারতবর্ষের ঐতিহ্যানুসারে ‘যোগ’ শুধু মাত্র  শারীরিক কসরত, হঠযোগ বা প্রাণায়াম প্রক্রিয়াই নয়, যোগাভ্যাস হচ্ছে  এক নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা যার সুদীর্ঘ অনুশীলনের দ্বারা মানসিক ও আত্মিক স্তরে ক্রমোন্নতির ফলে মানব শরীরেই পশুত্ব থেকে মানবত্বে ও পরবর্তী ধাপে মানবত্ব থেকে দেবত্বে উন্নীত হওয়া ---আর সবশেষে পরমাত্মার সঙ্গে মহামিলনের পরমানন্দে চিরস্থিতি লাভ করা৷ সেই কারণেই যোগাভ্যাসকে ভারতবর্ষে যোগসাধনা নামে অভিহিত করা হয়৷ মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম  শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী প্রবর্তিত আনন্দমার্গের সাধনা পদ্ধতি  অষ্টাঙ্গিক যোগসাধনা নামে পরিচিত যার আটটি ধাপ  যথাক্রমে যম,নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার,ধারণা, ধ্যান ও সমাধি৷ যোগ সাধনায় প্রতিটি সাধককে এই আটটি পর্র্যয়ে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালনের দ্বারা নিরন্তর আধ্যাত্মিক সাধনার অনুশীলন করতে হয়৷ কোন পর্যায়েই যেকোনো শৈথিল্যের কারণে সাধকের পতনের সমূহ সম্ভাবনা থাকে--- তাই অত্যন্ত নিষ্ঠাসহকারে যোগাভ্যাসের নিয়মাবলী পালন করা বাধ্যতামূলক৷ খাদ্যাভ্যাস ও উপবাস বিধি এক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি , তার সার অংশ  আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে প্রবাহিত হয়৷ সাত্ত্বিক খাদ্য দেহের                                সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্তরে সাত্ত্বিকভাব বহন করে--- ফলে সাত্ত্বিকাহারীদের যোগসাধনায় উন্নতি অবশ্যম্ভাবী৷ একইভাবে তামসিক খাদ্য দেহের কোষে কোষে তামসিকভাব প্রসারিত করার ফলে যোগসাধনার ক্ষেত্রে অগ্রগতি ব্যাহত হয়৷ প্রকৃত যোগসাধনার দ্বারা  মানুষের মধ্যে  ব্রহ্মভাবের অভ্যুদয় ঘটে যার ফলশ্রুতিতে সমগ্র বিশ্বই তার সম্মুখে পরমব্রহ্মের লীলায়িত রূপ হিসেবে প্রকট হয়ে ওঠে ও  জীব,জড়, উদ্ভিদসহ সমগ্র সৃষ্টির মাঝেই তিনিই পরমাত্মার উপস্থিতি অবলোকন করেন৷ এরফলেই হয় সত্যিকারের নব্যমানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা৷ মানুষ নব্যমানবতাবাদের আদর্শে সকলের সেবায় হয় তৎপর৷ সাধনা,সেবা ও ভক্তির দ্বারা পরম পুরুষের লীলানন্দে ভাসতে ভাসতে  মানুষ কোন এক শুভমুহূর্ত্তে সেই পরমাত্মার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়--- আর তখনই হয়  যোগ সাধনার চরম ও পরম সার্থক রূপায়ণ৷

সুতরাং শুধুমাত্র বছরের একটা দিন ‘যোগদিবস’ পালন করার বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান বা সংবাদ মাধ্যম, সামাজিক মাধ্যমগুলিতে দেখনদারী যোগচর্র্চর ফাঁকিবাজিতে সীমাবদ্ধ না থেকে  যোগসাধনাকে  প্রতিনিয়ত  অনুশীলন  ও জীবনের প্রতিটিক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক চেতনাকে প্রসারিত করে এই ধূলার ধরণীকে  পরমব্রহ্মের পবিত্র লীলাক্ষেত্রে পরিণত করাতেই মানবজীবনের সার্থকতা৷ জাত -পাত-বর্ণ-ধর্মমতগত হাজারো রকমের বিভাজন, হিংসা-সন্ত্রাস, দুর্নীতি, শোষণকে দূর করে   বর্তমান পৃথিবীকে নব্যমানবতাবাদের মহামিলনক্ষেত্র হিসেবে প্রকৃত মানবসমাজ, দুর্নীতিমুক্ত শোষণহীন ‘নোতুন পৃথিবী’ ও মহাবিশ্ব রচনা করতে হলে প্রতিটি মানুষকেই আনন্দমার্গের অষ্টাঙ্গিক যোগসাধনা অনুশীলনের মাধ্যমে সত্যিকারের মানুষরূপে গড়ে তুলতে হবে৷ আর এই মহৎ উদ্দেশ্যে, জগতকল্যাণে সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে  অনতিবিলম্বে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতেই হবে --- নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়৷