যোগঃ মানুষের বৈয়ষ্টিক ও সামূহিক জীবনের কল্যাণের চাবিকাঠি

লেখক
আচার্য পরাবিদ্যানন্দ অবধূত

পূর্ব প্রকাশিতের পর ঃ

যোগ সম্পর্কে আগের সংখ্যাতে যা বলেছি তা বিশেষ করে যোগের আধ্যাত্মিক দিক নিয়ে৷ এখন আমি আলোচনা করব প্রধানতঃ যোগাসন নিয়ে৷ প্রথমে আমি এর ইতিহাস ও বর্তমান সম্পর্কে কিছু বলতে চাই৷  ইতিহাসের আগে একটু বর্তমান সম্পর্কে বলব৷ যোগাসন নিয়ে বর্তমানে বিশ্ব তোলপাড়৷  যোগাসন দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যহ অনুশীলন করতে হলে আপনাকে অবশ্যই উপযুক্ত শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে৷ তা কিন্তু খুব একটা কেউ করছেন না৷ এই না করার ফল অত্যন্ত ক্ষতিকারক৷  উদাহরণস্বরূপ শীর্ষাসন ও সর্বাঙ্গাসনের কথা আমি এর আগেই বলেছি৷

এখন ইতিহাসের সম্বন্ধে বলি৷ প্রাচীনকালের যোগীরা মানুষের দেহমনের পারস্পরিক সম্পর্ক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন৷ তাঁরা দৈহিক সুস্থতার জন্যেই কিছু কিছু পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যার দ্বারা মানুষের বিভিন্ন গ্রন্থি-উপগ্রন্থি glands and sub glands-এর ওপর প্রয়োজনমত চাপ সৃষ্টি করে বা চাপ বিমোচন করে তাদের সক্রিয় করতেন৷

হাজার হাজার বছর আগে ভারতের নির্জন অরণ্যে বাস করতেন অনেক যোগী-ঋষি৷ দেহ ও মনের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্যে তাদের প্রচেষ্টার বিরাম ছিল না৷ শান্তিময় পরিবেশে তারা তাদের একাকিত্বের সঙ্গী বিভিন্ন পশুপাখীর আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করতেন৷ তারা কিভাবে বিচরণ করে, কিভাবে বিশ্রাম নেয়, অসুস্থ হলে কী করে, খাদ্য হজম করার জন্যে কী করে, কীভাবে তারা সহজাত আচরণের দ্বারা নিজেদের সুস্থ করে তোলে, সব কিছু দেখতেন৷ পশুপক্ষীর দেহভঙ্গী তাঁরা নিজেদের শরীরে ফুটিয়ে তুলতে তুলতে লক্ষ্য করেছিলেন দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও গ্রন্থিগুলিতে তা কেমন সূক্ষ্ম প্রভাব বিস্তার করতে পারে৷ হাজার হাজার বছরের বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে  তারা পশুপাখীর অঙ্গভঙ্গিমা অনুসরণ করে শারীরিক অভ্যাসের কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যার নাম আসন৷

এই আসনগুলির নাম বিভিন্ন ভাবে রাখা হ’ত৷ যেমন (১) যেসব জীবজন্তুর দেহভঙ্গিমা কোনও বিশেষ বিশেষ আসনের জন্ম দিয়েছিল তার নামকরণও হয়েছিল সেই জীবের নামে৷ যেমন ভুজঙ্গাসন, শশঙ্গাসন, উড্ডয়ন, কুর্মাসন, মর্কটাসন, ময়ূরাসন ইত্যাদি৷ (২) কিছু আসন কিছু প্রাণীর বৈশিষ্ট্য বা স্বভাবের সমান৷ যেমন কুর্মকাসন, শলভাসন (পঙ্গপাল)৷ (৩) কিছু আসন বিশেষ বিশেষ গুণসম্পন্ন---সর্বাঙ্গাসন, যার দ্বারা সম্পূর্ণ দেহযন্ত্র উপকৃত হয়৷

(৪) আবার কিছু আসন যিনি প্রথম আবিষ্কার করেন তাঁর নামে রাখা হয়েছিল---যেমন মৎসেন্দ্রাসন (যোগী মৎসেন্দ্র্যনাথ কর্তৃক আবিষৃকত), এই আসনটি সম্পূর্ণ দেহযন্ত্রকে প্রভাবিত করে৷

আসন দুই প্রকার (১) স্বাস্থ্যাসন, (২) ধ্যানাসন৷ স্বাস্থ্যাসন বলতে বোঝায় সেই সমস্ত আসন যা প্রধানতঃ আমাদের স্বাস্থ্যরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত আর ধ্যানাসন হ’ল যেগুলি প্রধানত মনের একাগ্রতা ও সাধনার সহায়ক৷ এখন প্রশ্ণ আমরা কেন আসন অভ্যাস করব? আসন --- (১) বিভিন্ন রোগের নিরাময় ঘটিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে, (২) দেহের নমনীয়তা বাড়ায়, (৩) দেহমনের সামঞ্জস্য রক্ষা করে৷ (৪) অবাঞ্ছনীয় চিন্তা মনে আসতে দেয় না৷ (৫) সূক্ষ্মতর ও উচ্চতর সাধনার জন্যে মনকে প্রস্তুত ও সাহায্য করে, (৬) গ্রন্থিগত ত্রুটি দূর করে আর গ্রন্থিরস ক্ষরণে সামঞ্জস্য আনে৷ এইভাবে আসনের মাধ্যমে মানুষের বৃত্তির নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়৷

মার্গগুরু শ্রীশ্রীীআনন্দমূর্ত্তিজ্  আসন অভ্যাসের ক্ষেত্রে কেবল আসনে সীমাবদ্ধ থাকেননি নি---আসনের সঙ্গে মুদ্রা, বন্ধ ও বেধকেও যুক্ত করেছেন৷ আসনের মাধ্যমে গ্রন্থি, স্নায়ু, পেশী, টিসু অর্থাৎ শরীরের সকল অংশের ব্যায়াম সংসাধিত হয়৷ আসনের দ্বারা শারীরিক সুখ বিধান ও মানসিক শান্তি দুইই লাভ হয়৷ এসব কারণে আসনের শারীরিক উপকারের কথা বলে শেষ করা যায় না৷ তাই বর্তমান বিশ্বে আজ আসন এত জনপ্রিয়৷ আসনের এই বিপুল জনপ্রিয়তা ও কার্যকারিতা সত্ত্বেও বলব এ সম্পর্কে উপযুক্ত ও নিঃস্বার্থ নির্দেশনার অভাব রয়েছে৷

এছাড়া দৈনন্দিন আসন অনুশীলন করবার ঠিক পূর্ব মুহূর্ত্তে কিছু আবশ্যিক নিয়ম আর আসন অভ্যাসের অব্যবহিত পরে অন্য আরও কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়৷ যা আমি পরে বলব৷ স্মৃতিশক্তি, মেধা ও চিন্তাশক্তি বাড়ানোর খুব সূক্ষ্ম অথচ কার্যকরী আসন আছে যা সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়৷ এই সকল কারণে উপযুক্ত অভিজ্ঞ আচার্যের তত্ত্বাবধান ছাড়া আসন অভ্যাস করা উচিত নয়৷

মুদ্রা ঃ মুদ্রা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে স্নায়ু ও পেশীকে৷ মুদ্রা আসনের মত শারীরিক মানসিক হলেও এর বেশী অংশ মানসিক৷ তাই অধিকাংশ মুদ্রা মনকে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে অভ্যাস করতে হয়৷ যেমন বায়বী মুদ্রা, আকাশী মুদ্রা, মানসী মুদ্রা ইত্যাদি৷ আবার কয়েকটি খুবই সূক্ষ্ম মুদ্রা আছে যা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উচ্চতর সাধনায় ব্যবহৃত হয়৷ আর কয়েকটি স্বাস্থ্য-মুদ্রা আছে যা মণিপুর চক্র ও স্বাধিষ্ঠান চক্র সংক্রান্ত রোগে দারুণভাবে কাজ করে৷ যেমন উড্ডয়ন অগ্ণিসার আগ্ণেয়ী মুদ্রা প্রভৃতি৷

বন্ধ ঃ বন্ধ একটি বিশেষ প্রকারের শারীরিক অবস্থান---যা স্নায়ু ব্যবস্থাকে প্রাণবন্ত করে তোলে৷ মুদ্রার মত এও বেশীরভাব মানসিক৷ তাই শরীর ও মনের ওপর এর সূক্ষ্ম প্রভাব আছে৷ জালন্ধর বন্ধ, মহাবন্ধ, মহাবেধ ও মহামুদ্রার অনুশীলন (বন্ধত্রয় যোগ) যুব বয়সীদের ও যোগ সাধকদের পরমবন্ধু৷ বন্ধ অভ্যাসের ফলে শরীরের বায়ুতত্ত্বও প্রভাবিত হয়৷

প্রাণায়াম ঃ পরমপুরুষের ভাবনা নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে প্রাণায়াম৷ মানসিক একাগ্রতা ও সাধনায় প্রাণায়াম খুবই সহায়ক৷ ‘‘প্রাণান্ যময়তি এষঃ প্রাণায়ামঃ’’ অর্থাৎ প্রাণায়াম হচ্ছে প্রাণবায়ুর নিয়ন্ত্রণ৷ সাধক প্রাণায়াম অভ্যাসের মাধ্যমে প্রাণেন্দ্রিয়কে (দশটি বায়ুর মিলিত নাম প্রাণেন্দ্রিয় এই দশটি বায়ু হ’ল প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, নাগ, কুর্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়) শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে৷

প্রাণায়াম দু’প্রকার---হঠযৌগিক প্রাণায়াম (যা গুরুরা সচরাচর শেখান) আর আধ্যাত্মিক প্রাণায়াম (যুধিষ্ঠির বিদ্যা)৷

হঠযোগিক প্রাণায়াম---মনকে কোনও বিশেষ বিন্দুতে একাগ্র না করে ও পরমপুরুষ বা ঈশ্বরের ভাবনা না নিয়ে এই প্রাণায়াম করা হয়৷ কিন্তু যখন মনকে নির্দিষ্ট বিন্দুতে বসিয়ে পরমপুরুষের (ঈশ্বরের) ভাবনা সহ প্রাণায়াম করা হয় তখন তা আধ্যাত্মিক পর্যায়ে পড়ে৷ প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠির এই পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন---তাই একে যুধিষ্ঠির বিদ্যা বা যুধিষ্ঠির প্রাণায়ামও বলা হয়৷ মন্ত্র ও নির্দিষ্ট চক্র ছাড়া যে প্রাণায়াম তা কিছু রোগের আরোগ্যের জন্যে ব্যবহৃত হয়৷ রোগটি ভাল হয়ে গেলে আর সেই প্রাণায়াম করা হয় না৷ হঠযৌগিক প্রাণায়ামের খারাপ দিক হ’ল তা ধীরে ধীরে মনকে জড়ত্বের দিকে নিয়ে যায়৷ ঠিক ঠিক পদ্ধতিতে আধ্যাত্মিক ভাবনা নিয়ে মনকে বিশেষ চক্রে বসিয়ে প্রাণায়াম করলে তা মনের বৃত্তি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভাবে উপযোগী হয়ে ওঠে৷ কারণ এই প্রাণায়ামের দ্বারা চক্রগুলি মজবুত হয় ও গ্রন্থিরসের ক্ষরণের মধ্যে সামঞ্জস্য আসে৷

নিয়ম নীতি ঃ (১) আসনের পূর্বে স্নান বা ব্যাপক শৌচ করতে হবে৷ (২) খোলা জায়গায় আসন করা চলবে না---আবার ঘরে যেন বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকে৷ (৩) ঘরে যেন ধোঁয়া না ঢোকে৷ (৪) পুরুষেরা কৌপীন পড়বে, আর খালি গায়ে করবে৷ নারীরা আঁটসাট জামাকাপড় পরবে৷ (৫) কম্বল বা শতরঞ্চির ওপর আসন করতে হবে৷ এমনই আরও কিছু নিয়ম রয়েছে যা যোগ প্রশিক্ষক আচার্য বা আচার্যার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে৷

আসন মুদ্রা ও বন্ধের দ্বারা শরীরকে ঠিক রাখতে পারবেন, কিন্তু মনকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ(control) করবেন?  মন সবসময় চঞ্চল থাকে, মনের চঞ্চলতা সম্পর্কে বলা হয়েছে ঃ একটি হনুমান বা বাঁদর তাকে মদ খাইয়ে দেওয়া হয়েছে আবার তাকে একটা কাঁকড়াবিছে কামড়েছে---তখন যে যেমন অস্থির বা চঞ্চল হয়ে ওঠে মন তেমনি চঞ্চল স্বভাবের৷ একে নিয়ন্ত্রণ করবেন কী করে? এর জন্যে দরকার বিশেষ মানসিক অনুশীলন (Mental exercise)৷ একেই বলা হয় ধ্যান (meditation) বা সাধনা৷ এই ধ্যান খুবই সূক্ষ্ম ব্যাপার যা অভিজ্ঞ আচার্য বা আচার্যার কাছ থেকে ব্যষ্টিগতভাবে শিখে দু’বেলা অভ্যাস করতে হয়৷

এককথায় যোগ সাধনা হ’ল শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক---এই তিনেরই উন্নতির যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি৷ এইভাবে যোগের সাহায্যে আদর্শ মানুষ তৈরী হয়৷ আদর্শ মানুষেরাই গড়ে তুলতে পারে আদর্শ সমাজ৷ তা-ই যোগ যথার্থই বৈয়ষ্টিক ও সামূহিক জীবনের কল্যাণ-সাধনের চাবিকাঠি৷