আসন
‘‘স্থিরসুখাসনম্ আসনম্’’–স্থির, শান্ত ও সহজ ভঙ্গিমায় তথা যথাযথ শ্বাস–প্রশ্বাস সহ যে শারীরিক–মানসিক বিভিন্ন অনুশীলন করা হয় তারই নাম আসন৷ মানব শরীরের প্রতিটি স্নায়ুকোষ ও স্নায়ুতন্তু, টিস্যু, পেশী, গ্রন্থি–উপগ্রন্থিসহ প্রতিটি অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের যথোপযুক্ত ব্যায়ামই আসন৷ আসনাভ্যাসকারী আসনের অনুশীলনের সময় অবশ্যই শারীরিক সুখবোধ ও আরাম তথা মানসিক প্রশান্তি অনুভব করেন৷ আসনের দৈনন্দিন অভ্যাস শরীরকে স্বাস্থ্যবান করে তোলে আর বিভিন্ন দৈহিক–মানসিক রোগের নিরাময় করে৷ আসন যেহেতু গ্রন্থি–উপগ্রন্থি তথা গ্রন্থিরস (hormones) নিঃসরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই আসনের মাধ্যমে মনের বৃত্তিগুলির নিয়ন্ত্রণ হয়ে যায়৷ তাই আসন সাধকের শারীরিক ভারসাম্য রক্ষা ও মনের একাগ্রতায় সাহায্য করে৷
বিভিন্ন কারণে আসনের অভ্যাস করা হয়৷ সেগুলি নিম্নরূপ ঃ
১) দেহের নমনীয়তা বাড়ায়৷
২) দেহের ও মনের সমতা রক্ষা করে
৩) অবাঞ্ছনীয় চিন্তা মনে আসতে দেয় না৷
৪) সূক্ষ্মতর ও উচ্চতর সাধনার জন্যে মনকে প্রস্তুত ও সাহায্য করে৷
৫) গ্রন্থিগত ত্রুটি দূর করে আর গ্রন্থিরস ক্ষরণে সমতা আনে, এইভাবে আসনের মাধ্যমে বৃত্তি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়৷
নিম্নোক্তভাবে আসনের নামকরণ করা হয় ঃ
ক) কিছু কিছু আসনের ভঙ্গিমা প্রাণীদেহের বিশেষ চলাফেরার মত, তাই তাদের নামকরণ সংশ্লিষ্ট প্রাণীটির নামানুসারে হয়েছে যেমন–মৎস্যমুদ্রা, গরুড়াসন ইত্যাদি৷
খ) কিছু আসন প্রাণী–সংরচনার বৈশিষ্ট্য বা স্বভাবের সমান, তাদের নামকরণ সেই অনুযায়ী হয়েছে, যেমন–কূর্মকাসন, শলভাসন (শলভা মানে পঙ্গপাল) ইত্যাদি৷
গ) কিছু আসন বিশেষ গুণসম্পন্ন হওয়ায় তাদের নামকরণ সেইরূপ হয়েছে৷ যেমন–সর্বাঙ্গাসন৷ এতে সমগ্র দেহযন্ত্র উপকৃত হয়৷
ঘ) আবার কিছু আসন পরবর্তীকালে যিনি প্রথম আবিষ্কার করেন তার নামানুসারে হয়েছে৷ যেমন–মৎস্যেন্দ্রাসন (যোগী মৎস্যেন্দ্রনাথ কর্ত্তৃক আবিষ্কৃত)৷ এই আসনটিও সমগ্র দেহযন্ত্রকে প্রভাবিত করে৷
আসন প্রধানতঃ দু’প্রকারের–স্বাস্থ্যাসন আর ধ্যানাসন৷ স্বাস্থ্যাসনের অভ্যাস করা হয় মুখ্যতঃ দৈহিক স্বাস্থ্যের জন্যে আর গৌণতঃ আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে৷ ধ্যানাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য হ’ল মনের একাগ্রতা আর সাধনা৷ ধ্যানাসনের উদাহরণ–পদ্মাসন, বদ্ধ পদ্মাসন, সিদ্ধাসন, বীরাসন৷
সর্বাঙ্গাসন আর বিপরীতকরণী মুদ্রায় তফাৎ হচ্ছে সর্বাঙ্গাসনে মনকে বসাতে হয় দুই পায়ের বৃহদাঙ্গুলীর মধ্যবর্ত্তী স্থানে, আর বিপরীতকরণী মুদ্রায় মনকে একাগ্র করতে হয় নাসিকাগ্রে বা নাভিচক্রে৷
মুদ্রা, বন্ধ, বেধ
মুদ্রার মাধ্যমে স্নায়ুতন্তু, গ্রন্থি আর পেশীসমূহের ব্যায়াম হয় (স্বাস্থ্য মুদ্রা)৷ আক্ষরিক অর্থে মুদ্রা কথাটির অর্থ–‘‘মনের অন্তর্নিহিত ভাবের বাহ্যিক প্রকাশ৷’’ কিছু আধ্যাত্মিক মুদ্রা (ধ্যানমুদ্রা) মুদ্রা আছে যাতে অন্তর্নিহিত ভাবের বহিঃপ্রকাশ করা হয় না৷
মুদ্রা অভ্যাসকারী শারীরিক আরাম বা মানসিক শান্তি পেতে পারে, নাও পারে৷ মুদ্রা অভ্যাসের সময় সেই ভঙ্গিমায় থাকার জন্যে সচেতন প্রয়াস বজায় রাখতে হয় কিন্তু আসনের ক্ষেত্রে সেটার প্রয়োজন হয় না৷ মুদ্রা স্নায়ু আর পেশীকে (muscles) প্রভাবিত করে৷
বন্ধও বিশেষ প্রকারের ভঙ্গিমা যার মাধ্যমে কেবল স্নায়ুতন্তুর ব্যায়াম হয়৷ মুদ্রার মত বন্ধ অভ্যাসকারী শারীরিক স্বস্তি ও মানসিক শান্তি পেতে পারে, নাও পারে৷ বন্ধেও নির্দিষ্ট অবস্থায় থাকার জন্যে সচেতন প্রয়াস চালিয়ে যেতে হয়৷ বন্ধ বায়ুসমূহকেও প্রভাবিত করে৷
বেধ বন্ধের মতই৷ বেধ কিছুটা হলেও স্নায়ু আর বায়ুগুলিকে প্রভাবিত করে৷ যেমন জালন্ধর বন্ধের মহাবেধ৷
প্রত্যাহার
প্রতি–আ + হূ + ঘঞ প্রত্যয় করে ‘প্রত্যাহার’ শব্দটি এসেছে৷ ‘আহার’ শব্দটির অর্থ ‘‘নিজের মধ্যে কোনো কিছুকে মিলিয়ে নেওয়া’’ (assimilating) বা ‘‘বাইরে থেকে কোনো কিছুকে ভিতরে নেওয়া৷’’ যোগসাধনের ক্ষেত্রে প্রত্যাহারের তাৎপর্য ‘‘বাহ্যিক জগৎ থেকে মনকে সরিয়ে নিয়ে সেই প্রত্যাহত মনকে পরমপুরুষের দিকে চালিত করা’’৷
প্রাণায়াম
‘তস্মিন সতি শ্বাসপ্রশ্বাসয়োঃ গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়াম’–এই হ’ল প্রাণায়াম৷ অর্থাৎ ‘‘পরমপুরুষের ভাবনা নিয়ে শ্বাস–প্রশ্বাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে প্রাণায়াম’’৷ মানসিক একাগ্রতা তথা সাধনায় প্রাণায়াম খুবই সহায়ক৷ প্রাণায়ামের মূল ভাবটি হ’ল ‘প্রাণান যময়তি এসঃ প্রাণায়ামঃ’–অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থে প্রাণায়াম হচ্ছে ‘‘প্রাণবায়ুর নিয়ন্ত্রণ’’৷ প্রাণায়ামের অভ্যাসের মানস–দার্শনিক দিকটা এই যে, সাধক এর মাধ্যমে প্রাণেন্দ্রিয়কে (দশটি বায়ুর মিলিত নাম) শ্বাস–প্রশ্বাসের মধ্যেকার বিরতি অবস্থায় রাখতে চেষ্টা করে যাতে সেই বিরামাবস্থায় থাকা মন চৈতন্য–সমুদ্রে মিলে একাত্ম হয়ে যেতে পারে৷
প্রাণায়াম দুই প্রকারের–হঠযৌগিক প্রাণায়াম আর যুধিষ্ঠির প্রাণায়াম৷ যখন মনকে কোনো বিশেষ বিন্দুতে একাগ্র না করে ও পরমপুরুষের ভাবনা না নিয়ে যে প্রাণায়াম করা হয় তা হচ্ছে হঠযৌগিক প্রাণায়াম৷ কিন্তু যখন মনকে নির্দিষ্ট বিন্দুতে বসিয়ে পরমপুরুষের ভাবনা সহ প্রাণায়াম করা হয় তা–ই যুধিষ্ঠির প্রাণায়াম (প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠির প্রথম এই পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তোলেন)৷
‘রেচক’ শব্দটির অর্থ ‘‘খালি করে দেওয়া’’৷ শ্বাস–প্রশ্বাস ক্রিয়ার সময় শ্বাসকে সম্পূর্ণ বের করে দেওয়াই রেচক৷ রেচক, পূরক আর কুম্ভকের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে রেচক মানে পূর্ণভাবে শ্বাস নেওয়া, আর তারপর শ্বাসকে বাইরে বেরোতে না দিয়ে দেহের মধ্যে তাকে ধরে রাখাই কুম্ভক৷
ধারণা
‘ধারণা’র ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘দেশবন্ধশ্চিত্তস্য ধারণা’৷ তাই আক্ষরিক অর্থে ধারণা মানে দেহেরই কোনো স্থানে বা অংশে মনকে ধরে রাখা৷ এতে দেহাভ্যন্তরে স্থিত পঞ্চতত্ত্বের নিয়ন্ত্রক বিন্দুগুলিতে মনকে একাগ্র করতে হয়৷ অর্থাৎ মনকে নির্দিষ্ট চক্রে বসিয়ে পরমপুরুষের ভাব নেওয়া৷
চক্রশোধন
‘শোধন’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে–‘‘শুদ্ধিকরণ’’৷ আধ্যাত্মিক সাধনার চক্রশোধনের তাৎপর্য–চক্রগুলিতে বা চক্রের কেন্দ্রে মনকে একাগ্র করা৷ এই চক্রশোধন আনন্দমার্গ সাধনা পদ্ধতির অঙ্গীভূত যা অষ্টাঙ্গ যোগে অন্তর্ভুক্ত হয়নি৷ চক্রশোধনে প্রতিটি গ্রন্থি, স্নায়ু, ধমনী ও মূল রক্তবহা নাড়ী এই প্রক্রিয়ায় শুদ্ধ ও তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে৷
ধ্যান
ধ্যান সম্পর্কে পতঞ্জলির ব্যাখ্যা–‘‘তত্রপ্রত্যত্যৈকতান ধ্যানম্’’ অর্থাৎ ধ্যানের অর্থ ‘‘পরম লক্ষ্যের প্রতি মনের একটানা গতি’’৷ তাই ধ্যানসাধনা জিনিসটা হচ্ছে শুধু পরমপুরুষেরই ধ্যান যাতে মনের ঊর্ধ্বমুখী গতি তাঁর পানেই বিরামহীন ভাবে বয়ে চলেছে৷
সহস্রার চক্রের ভেতরের (দেহাভ্যন্তরস্থিত) অংশটাই গুরুচক্র (macro-pineal plexus)৷ সাধনার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম কেননা এই গুরুচক্রেই ধ্যানাভ্যাস করতে হয়৷ আর সহস্রার চক্রের বাইরের অর্থাৎ উপরাংশ দেহের বাইরে৷ (এই উপরাংশ গুরুধ্যানের পক্ষে উপযুক্ত না হলেও অন্যান্য উচ্চতর ধ্যান সাধনা ও সাধনপ্রক্রিয়ায় সহস্রার চক্রেরও গুরুত্ব আছে )৷
সমাধি
সমাধি কথাটার অর্থ জীবাত্মার পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া৷ এটা নির্দিষ্ট কোনো যোগসাধনার প্রক্রিয়া নয়৷ আসলে সমস্ত সাধনাভ্যাসের সামবায়িক ফলশ্রুতিকেই সমাধি বলা হয়৷