জগতে যেসব বস্ তুকে আমরা নিত্য বলে মানি তাদের নিত্যতাপ্রদানকারীও পরমপুরুষ৷ বস্ তু হ’ল প্রতিফলিত সত্তা–রিফ্লেক্টেড এণ্ঢিটি৷ চেতন বস্ তুর মনঃশক্তিও তাঁর থেকেই এসেছে৷ তিনি সকলের প্রয়োজনের পূর্তি ঘটান–পিঁপড়ে থেকে হাতী পর্যন্ত, ছোট ছোট জীব থেকে সমুদ্রের বড় বড় জানোয়ার পর্যন্ত সকলের৷ এতই উদার তিনি৷ সেইজন্যেই তিনি জগতের কর্তা, অধিকর্তা, প্রভু৷ এই রকম উদারতা লাভ করতে পারলে তুমিও তিনি হয়ে যাবে৷
সাধনা হ’ল মানসিক ব্যাপকতা৷ নিজের উদারতার জন্যেই, নিজের শ্রেষ্ঠত্বের জন্যেই তিনি সকলের ধ্যেয়৷ তাঁকে জানতে পেরে, তাঁকে বুঝে, যখন তুমি তাঁকে পাবে, নিজের মানসিক সত্তাকে যখন তুমি তাঁতে সমর্পিত করবে তখন তোমার মধ্যেও সেই ব্যাপকতা আসবে৷ তখন ‘পাশ’ ছিন্ন হয়ে যাবে, তাঁকে জানলে জীবনে ‘পাশ’ থাকতে পারে না৷ পাশমুক্তির সাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতি হ’ল–ঈশ্বরপ্রণিধান৷ যম–নিয়মে প্রতিষ্ঠিত হলে ‘রিপু’ আপনা –আপনিই তোমার বশে এসে যাবে৷ অতএব ভিতরে–বাইরে সব জায়গায় যম–নিয়মের সাধনা করতে হবে৷ নিজের ভিতরের পাপ আর শিষ্টাচারের অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ, আর বাইরের অমানবিকতার ও পাপাচারের সঙ্গে যুদ্ধ–এটাই নিত্য কর্ম,
পূর্বপুরুষদের সব কাজকে উচিত বলে মানা যেতে পারে না৷ দেশ–কালের দৃষ্টিতে পূর্বপুরুষদের মধ্যে অশিক্ষা আর কু–সংস্কারও থাকতে পারে৷ সেইজন্যে ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা কী মূর্খ ছিলেন’, এই কথা বলে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিও না৷ পরিবর্তনকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে৷ এটাই ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷’ তোমাদের সংঘর্ষে তোমাদের অস্ত্র হবে যম–নিয়ম, তোমাদের নীতি হবে ‘প্রগতিশীল উপযোগ’ কিন্তু তার জন্যে সংঘটিত হতে হবে, সংঘটন গড়তে হবে৷
প্রতিদিনের কাজ৷ যদি এই যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাও, সাধনা ঠিক হবে না৷ যেখানে পাপাচার আছে, যেখানে আসুরী শক্তি আছে, যেখানে স্বধর্মভ্রষ্টতা (lapses) আছে সেখানে লড়াই হবেই, অন্য কোনো উপায় নেই৷
ধর্ম ব্যষ্টিগত জিনিস নয়, সামূহিক জিনিস৷ ধর্মসাধনা করার অর্থ হ’ল–সর্বাত্মক উন্নতি৷ সর্বাত্মক সাধনা থেকেই ব্যাপকতা আসবে৷ তার জন্যে নিজের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ–সংস্কারের জন্যেও চেষ্টা করতে হবে৷ বাড়ির ভেতরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে আর বাইরে রোগ–জীবাণু থাকলে রোগ, বাড়ির ভিতরেও তা আসতে পারে৷ সেইজন্যে সমাজ–সংস্কার আবশ্যক৷
এই সমাজ–সংস্কারের কাজে আর পাপাচার, হীনাচার ও অন্য আসুরী শক্তির বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে যদি মৃত্যুও হয়, তাহলেও মোক্ষপ্রাপ্তি হবে কারণ এখানে মৃত্যুর উদ্দেশ্য সবচেয়ে বড়৷ সেইজন্যে তুমি সব থেকে বড় জিনিস পাবে৷ জীবিত থাকলে সবল সমাজ তৈরী হবে, সাধুতার রক্ষা হবে৷ সেইজন্যে ধর্মযুদ্ধ করলে দু’–হাতেই নাড়ু থাকবে, দু’দিক থেকেই লাভ হবে৷ মরতে তো হবেই৷ খুব বেশী হলে একশ’, দুশ’ বছর পর্যন্ত বা তার থেকে বেশী চলে কিন্তু মরবে তো একদিন অবশ্যই–এটা তিক্ত সত্য, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে মরার মহত্ব পৃথক৷
যতদিন জীব পাশবদ্ধ ততদিন তার কর্মক্ষেত্র ছোট৷ পাশবদ্ধ জীবের ক্ষেত্রাধিকার ছোট৷ অর্থাৎ তার ক্ষেত্র, গোত্র, বংশ, কুটুম্ব, জাতি, জেলা, ও প্রদেশ ইত্যাদি থাকে৷ সেইজন্যে তোমরা জাত–পাত ইত্যাদি সংকীর্ণতাকে কখনও প্রশ্রয় দিও না৷ তোমাদের নিজেদের কর্তব্যক্ষেত্র বাড়াতে হবে৷ তোমাদের কর্তব্যক্ষেত্র হ’ল বিশ্ববন্ধুত্ববাদ–এটাই হ’ল ক্ষ্রাহ্মীভাব৷ তোমার ওপর কেউ জোর–জুলুম করলে তুমি আততায়ীর সঙ্গে তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ধর্ম–রাষ্ট্রীয়তার দৃষ্টিতে নয় যথার্থ ন্যায়–ন্যায়ের বিচারে৷ বিচারালয়ে যেমন রাষ্ট্রীয় আইনের ভিত্তিতে বিচার হয়, জাত–পাত দেখা হয় না৷ একইভাবে তোমার পিতা পরমপিতা জাতীয়তা দেখবেন না৷ তোমাদের মাতা–পিতা পরমাপ্রকৃতি আর পরমপুরুষ, আর এই ত্রিভুবন তোমার স্বদেশ৷ এই ভাবই বিশ্ববন্ধুত্ব–ইউনিবার্সালিজম্ বা ক্ষ্রাহ্মীভাবে প্রতিষ্ঠা৷
জীবনের অর্থ সংগ্রাম৷ যেখানে সংগ্রাম নেই সেখানে জীবন নেই৷ (Vital energy is co-operative creation of the different energies). প্রাণশক্তি বিভিন্ন শক্তির সহায়তাকারী সৃষ্টি৷ এই ভাইটাল এনার্জী বিশেষ গতিতে চলে৷ ক্ষিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অসংখ্য তরঙ্গ আছে৷ যতক্ষণ সংঘর্ষ চলতে থাকে ততক্ষণ তারা জীবিত থাকে, যখন সংঘর্ষ ঘটে না তখন তাদের গতি সমাপ্ত হয়ে যায়৷ সংঘর্ষের পরিণামপ্রাপ্ত যে শক্তি সেটাই জীবন আর যতদিন প্রাণকেন্দ্রে এই প্রাণশক্তি না পাওয়া যায়, ততদিন জীবনের পর জীবন চলতে থাকে৷ এই সংঘর্ষই জীবনের প্রতীক৷ ‘আমি কারোর সঙ্গে লড়াই করব না’– এমনটা যারা ভাবে বা করে, তারা আত্মহত্যা করে৷ যারা লড়াই করে না, তারা মৃত৷ যারা লড়াই করে না তারা ভীরু, তাদের শারীরিক ও আধ্যাত্মিক মৃত্যু ঘটেছে৷ সংগ্রামই জীবনের আত্মাস্বরূপ৷
কিন্তু যেখানে সর্জনশীল দিশাপ্রাপ্ত না হয় সেখানে এই লড়াই এই শক্তি ধ্বংসাত্মক দিকে পরিচালিত হয়৷ বর্তমানে যে অনুশাসনহীনতা, তা মুখ্যতঃ রাজনীতিক দুর্বিচারের কারণে–
Indiscipline is the creation of political ideas– আজ প্রাণশক্তির জাগরণের প্রয়োজন আছে৷ Indiscipline is the expression of misguided vitality— অনুশাসনহীনতা প্রাণশক্তির দিগ্ভ্রষ্ট অভিব্যক্তি৷ কিন্তু এটা অশুভ লক্ষণ নয়, শুভ লক্ষণ৷ এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যেখানে প্রাণশক্তি আছে, সেটা মৃত বা স্থবির নয়, বন্ধনে আবদ্ধ রুদ্ধ জলকে অন্য পথে ঘুরিয়ে দিতে হবে৷
পূর্বপুরুষদের সব কাজকে উচিত বলে মানা যেতে পারে না৷ দেশ–কালের দৃষ্টিতে পূর্বপুরুষদের মধ্যে অশিক্ষা আর কু–সংস্কারও থাকতে পারে৷ সেইজন্যে ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা কী মূর্খ ছিলেন’, এই কথা বলে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিও না৷ পরিবর্তনকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে৷ এটাই ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷’ তোমাদের সংঘর্ষে তোমাদের অস্ত্র হবে যম–নিয়ম, তোমাদের নীতি হবে ‘প্রগতিশীল উপযোগ’ কিন্তু তার জন্যে সংঘটিত হতে হবে, সংঘটন গড়তে হবে৷