এই সৌরজগৎ সম্পদ-প্রাচূর্যে ভরপুর৷ শুধুমাত্র মানুষই নয়, জীব জগতের খাওয়া-পরা তথা সর্বাত্মক বিকাশের জন্যে পর্যাপ্ত সম্পদ এখানে রয়েছে! কিন্তু আমাদের ক্রুটিপূণ চিন্তা বা দুর্বুদ্ধির জন্যেই আমরা বহু সমস্যার যথার্থ সমাধান খুঁজে পাইনি৷ আমাদের এ পৃথিবী যেন গুপ্তধন-ভাণ্ডার৷ বিশ্বের সমস্ত প্রাণীর রক্ষণাবেক্ষণ তথা তাদের পরিবর্ধনের জন্যে আমাদের এই লুকোনো সম্পদকে ভালভাবে কাজে লাগাতে হবে৷
আমাদের এই পৃথিবী একট জটিল যুগসন্বিক্ষণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে৷ এই সমস্ত সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন৷ এক মুহূর্ত বিলম্ব করা উচিত হবে না৷ তাই সারা বিশ্বে, বিশেষ করে আমাদের এই পৃথিবী গ্রহটায় ‘প্রাউট’-তত্ত্বটা ছড়িয়ে দিতে হবে৷ অত্যল্প সময়ের মধ্যে এর বাস্তবায়ন ও কার্যে রূপায়ণের জন্যে তোমাদের বাস্তবোচিত পরিকল্পনা তৈরী করতে হবে৷
তোমরা জান মানুষের জীবনে শুধু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলিই সৰকিছু নয়, তার মানসিক ও আধ্যাত্মিক দিকও রয়েছে৷ এই মানসাধ্যাত্মিক উন্নতি ও প্রগতির জন্যে নব্যমানবতাবাদের আদর্শকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে৷ কারণ একমাত্র আধ্যাত্মিকতাই জীবনের অন্যান্য দিকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷
মানবদেহ পাঞ্চভৌতিক উপাদানে তৈরী৷ তাই এই দেহকে বিশেষ কতকগুলি ব্যাধির কবল থেকে মুক্ত করতে প্রপঞ্চ-বিজ্ঞানকেও প্রয়োগ করতে হবে৷ শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি দূরীকরণে মাইক্রোবাইটামের (অণুজীবৎ) নূতন তত্ত্বের সাহায্যে জীববিজ্ঞানকে আরো উন্নত করতে হবে৷ এই মাইক্রোবাইটাম ধনাত্মক positive) ও ঋণাত্মক negative) দুই ভাবেই কাজ করে থাকে৷ আধ্যাত্মিক প্রগতির উদ্দেশ্যেও মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বের শুভপ্রয়োগ হওয়া উচিত৷
মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনও রয়েছে৷ সকল মানুষের জীবনেই রয়েছে কতকগুলি সাধারণ ও সহজাত বৃত্তি৷ স্বভাবগত ভাবে তাদের কেউ কেউ হয়তো মানুষকে বিকাশের পথে নিয়ে যায়, কেউ বা নিয়ে যায় অবনতির দিকে৷ যে বৃত্তি মানুষকে বিকাশের পথে নিয়ে যায় তাকে আমাদের উৎসাহ প্রদান করা উচিত৷ আর যে বৃত্তি মানুষকে অবনতির পথে নিয়ে যায় তাকে নিরুৎসাহিত করা উচিত৷ এই পৃথিবীর কোথাও কোথাও মানুষকে ব্যাপক নগ্ণচিত্র ও অশ্লীল সাহিত্যের মাধ্যমে নৈতিক অধোগতির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ সাধারণ প্রতিবাদের মাধ্যমে একে প্রতিহত করা যাবে না যদি না পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের জন্যে আমরা সক্রিয়ভাবে কিছু করি৷ যদি বাস্তবোচিত আমরা কিছু করি তবে তা মানুষের মনে এক নূতন আলোড়ন সৃষ্টি করবে৷ একমাত্র তখনই একে সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত তথা প্রতিহত করা সম্ভব হবে৷ সেটাই হবে আমাদের বাস্তবোচিত কর্মধারা৷ আমাদের নূতন সাহিত্য- অর্থাৎ সমাজে এক নূতন সাংস্কৃতিক আলোড়ন তুলতে হৰে৷ এ সবই আমাদের আশু কর্তব্য৷ এর জন্যে আমাদের যথার্থ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে ও তদনুযায়ী কাজও শুরু করতে হৰে৷
দুঃখের বিষয়, আজকের নিরীহ মানুষেরা সমাজের সর্বগ্রাসী দানবের কৃপার ওপর নির্ভরশীল হয়ে রয়েছে৷ নিরীহ পশুরাও তেমনি নরপিশাচদের ওপর নির্ভরশীল তেমনি উদ্ভিদ ও জীবজগৎও আজ এই মানবরাপী দানবের কৃপার ওপর নির্ভর করে আছে৷ এই মানুষরূপী দানবেরা নূতন নূতন অরণ্য রচনা না করেই নির্বিচারে অরণ্যোচ্ছেদ করে চলেছে....যা সৃষ্টি করছে নূতন নূতন মরুভূমি৷
মানুষের চিন্তারাজ্যে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও আজ এক প্রচণ্ড বুদ্ধি-বিপর্যয় দেখা দিয়েছে৷ আজ থেকে মাত্র তিনশ’ বছর আগেও দক্ষিণ আমেরিকায় কোন মরুভূমি ছিল না৷ পনেরশ’ বছর আগেও ভারতে কোন মরুভূমি ছিল না৷ এমনকি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকেও সব সময়ে মানুষরূপী দানবের কৃপার পাত্র হয়ে থাকতে হচ্ছে৷ প্রাউট, নব্যমানবতাবাদ,‘মাইক্রোবাইটাম’,শিল্প-কলা,সাহিত্য, সঙ্গীত, বাদ্য, সর্র্বেপরি আধ্যাত্মিক সাধনার সাহায্যে মানুষের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে৷ বর্তমান বিশ্বের যাবতীয় সমস্যা-ব্যাধির এগুলিই হ’ল সর্বরোগের একমাত্র মকরধবজ৷
পৃথিবীতে পেট্রোলিয়ামের অভাব ঘটতে পারে কিন্তু পেট্রোলিয়াম তৈরীর উপাদানগুলির অভাব নেই৷ তাই কৃত্রিম উপায়ে পেট্রোলিয়াম উৎপাদন করা যেতে পারে৷ আমরা তা’ করতে সক্ষম হবও৷
আমরা চাই এ বিশ্বে যুক্তির রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক৷ মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য তবে আপাতদৃষ্টিতে সেখানে বৈচিত্র থাকতে পারে কিন্তু বস্তুতঃ সেখানে রয়েছে ফল্গুধারার মত এক সামরস্য৷ যেমন মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমান, ইহুদী, খ্রীষ্টান, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ সবই রয়েছে কিন্তু তারা মূলতঃ একই মহান মানবজাতির গৌরবান্বিত সদস্য--একই মহিমান্বিত বিশ্বপিতার সন্তান৷ আনন্দমার্গের আধ্যাত্মিক দর্শন এই তত্ত্বে বিশ্বাসী৷ একমাত্র ভাবজড়তার প্রভাবেই মানুষ বৈষম্যমূলক চিন্তাকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে৷ পৃথিবীতে একটিমাত্র আদর্শ রয়েছে যা সর্বাত্মক ও সর্বানুস্যুত আর তা হচ্ছে এই আনন্দমার্গ৷
সমস্যা ও সমাধান উভয়ই আমাদের কাছে স্পষ্ট৷ এখন বিশ্বের কোণে কোণে আনন্দমাগের এই বাণীকে পৌছে দেওয়া আমাদের অবশ্য কর্তব্য৷ আজকে সর্বত্রই আমাদের অনুকূল হাওয়া ৰইছে৷ জীব-জগতের অস্থি-মজ্জা, অণু-পরমাণুর কাছে এই আনন্দমার্গের মহান বাণীকে যথা সত্বর পৌছে দিতে হবে৷ কলিকাতা, ৩১ আগষ্ট ১৯৮৭
(শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার রচিত অভিমত অষ্টম খণ্ড থেকে সংগৃহীত)