আর্যরা ভারতে বসবাস করার পরে অনার্য সমাজে জন্মেছিলেন এক বিরাট পুরুষ৷ মঙ্গোলীয়–আর্য মিশ্র কুলে জাত এই বিরাট পুরুষ ছিলেন উন্নতনাসা ও শুভ্রকান্তি৷ ইনি ছিলেন মহাতান্ত্রিক, মহাযোগী৷ অনার্য সমাজের এই মহাপুরুষ শিব নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন৷ একাধারে এত গুণ মানুষের মধ্যে যে থাকতে পারে এ কথা লোকে ভাবতে পারে না, তাই তাঁকে বলা হ’ত গুণাতীত বা নির্গুণ পুরুষ৷ তন্ত্রসাধনার ফলে এই শিব অর্জন করেছিলেন অলোকসামান্য শক্তি৷ এই শক্তিকে তিনি লাগিয়ে গেছলেন জনকল্যাণের কাজে৷ তন্ত্রশাস্ত্রকে সুসংবদ্ধরূপ ইনিই দিয়েছিলেন৷ তাই তান্ত্রিকের বা যোগীর ইনি ছিলেন গুরু–ইনি ছিলেন পিতা৷ এই ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের দৃষ্টিতে উচ্চ–নীচ ভেদ ছিল না৷ আপামর জনসাধারণ সবাই ছিল এঁর প্রিয়৷ আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, অষ্ট্রিক, মঙ্গোলীয় নির্বিশেষে সবাই এঁর কাছে ছুটে আসত৷ সবাকার ওপরে এঁর কৃপা সমানভাবে বর্ষিত হ’ত৷...
আর্যরা যখন ভারতে এল অর্থাৎ মোটামুটি অথর্ব বেদের যুগে, তারা ভারতের তান্ত্রিকদের সংস্পর্শে এসে তন্ত্রসাধনা কিছু কিছু শিখল৷ তাই তাদের অথর্ব বেদ হয়ে পড়ল ব্যাপকভাবে তন্ত্র–প্রভাবিত৷ গোঁড়া বৈদিকেরা বেদের অনেক তন্ত্র–প্রভাবিত অংশকে আজ অর্বাচীন বা প্রক্ষিপ্ত বলে অস্বীকার করার চেষ্টা করলেও তাঁরা তা পারবেন না, কারণ তন্ত্র এখন তথাকথিত আর্যদের মজ্জায় মজ্জায় অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গেছে৷ বেদোত্তর যুগে, বৌদ্ধ যুগে ও বৌদ্ধোত্তর ব্রাহ্মণ্য যুগে জনসাধারণের আপাতঃদৃষ্টিতে ধর্মগত পরিবর্ত্তন দেখা দিলেও সাধনা ধারাটি তান্ত্রিকই থেকে গেছল ও আজও রয়েছে, কারণ তন্ত্র ছাড়া অধ্যাত্ম সাধনা হয় না৷ যে ‘যোগ’ অধ্যাত্ম সাধনার সবচেয়ে বড় কথা, সেই যোগ তন্ত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত৷ তাই দেখি যে মহাতান্ত্রিক বশিষ্ঠ চীন দেশ থেকে সাধনার চীনাচার শিখে এসে, তন্ত্রের উৎকর্ষ সাধন করেছেন, তিনিই আবার অন্য দিকে মহাযোগীরূপে প্রশংসার পাত্র হয়েছেন৷ তাঁর লেখা ‘যোগবাশিষ্ঠ’ গ্রন্থটি তন্ত্রসাধনার সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিকতার একটি দার্শনিক বিকাশ৷...
তন্ত্রের মূলতঃ দু’টি শাখা রয়েছে–একটি স্থূল, অপরটি সূক্ষ্ম৷ এই সূক্ষ্ম সাধনাকে যোগমার্গও বলা হয়৷ স্থূল–সূক্ষ্মের মধ্যবর্তী যে স্তর তা মধ্যম মার্গ (মঝ্ঝিমা মাগ্গ) রূপে স্বীকৃত৷ তন্ত্রের উভয় শাখারই প্রবক্তা ছিলেন সদাশিব, তাই এতদুভয়ের মধ্যে কোন বিরোধই থাকতে পারে না৷...
সদাশিব–অনুমানিক সাত হাজার বৎসর আগে পৃথিবীতে এসে পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণাকে পবিত্র করে গেছেন, তাঁর সম্পূর্ণ সত্তাকে জীবের কল্যাণে লাগিয়ে দিয়ে গেছেন৷ মনে রেখো, আমি মানবের কল্যাণ বলিনি কারণ সৃষ্ট জগতে মানব ছাড়া পশুপক্ষীও আছে, সৃষ্ট জগতে বৃক্ষ–লতাও আছে৷ শিব সবাইকার জন্যে৷ তাই জীবের কল্যাণে তিনি তাঁর সবটাকেই বিলিয়ে দিয়ে গেছেন৷ তাই তাঁকে বলা হত সবাশিব৷ ‘শিব’ মানে কল্যাণ, মঙ্গল যিনি সর্বদাই মঙ্গল রূপ নিয়ে রয়েছেন, সবাইকার মঙ্গল করাই যাঁর আস্তিত্বিক ব্রত তিনিই সদাশিব৷...
কোমলতা আর কঠোরতার প্রতিভূ শিব মানুষকে যে সবচেয়ে বড় জিনিসটা দিয়ে গেছেন তা হ’ল ধর্মবোধ৷... শিব মানুষের অন্তরে পরমপুরুষকে প্রাপ্তির পথ দেখালেন৷ সেই পথকে প্রাপ্তির পথ না বলে বলা উচিত সম্প্রাপ্তির পথ–পরমা প্রশান্তির পথ৷ এতে অনুভূতিটা অপরোক্ষ অর্থাৎ প্রত্যক্ষানুভূতি৷ এই শিবের পথটাকেই বলা হয় শৈব মত বা শৈব ধর্ম৷
শিবের আগে তন্ত্র ছিল নানান ভাবে বিক্ষিপ্ত, কোন ছন্দোবদ্ধ রূপ ছিল না৷ শিব সব কিছুকেই নিয়মবদ্ধ, সব কিছুকেই ছন্দোবদ্ধ করেছিলেন৷ সেই বিক্ষিপ্ত, বহুধাবিক্ষিপ্ত তন্ত্র আর তার সঙ্গে আধ্যাত্মিক এষণার পরম পরিপূর্ত্তির শুভ সংযোগ ঘটিয়ে তাঁর শৈব মত প্রবর্ত্তন করলেন যা সর্বপ্রকার জিও–সেন্টিমেন্টের, সোসিও সেন্টিমেন্টের একেবারে ঊর্ধ্বে৷ এই যে তন্ত্র ও শৈব মতের সংমিশ্রণে শিবের পথ, সেই পথ বিষয় জগতের (objective world) সঙ্গে বিষয়ী ভাবের (subjective world) শুভ সমন্বয় ঘটিয়েছিল৷...
এই যে শৈবতন্ত্র, এর পথ মানুষকে চরম সত্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, অন্য দিকে ‘‘বৈবহারিক জগৎকে উপেক্ষা করো না, বৈবহারিক জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলো’’–এই শিক্ষা দিয়ে চলেছিল৷ শিব বলে গেছেন ‘‘বর্ত্তমানেষু বর্ত্তেত’’৷ তুমি মনের ভেতর–আত্মার ভেতর যত পারো এগিয়ে চলো...এগিয়ে চলো–‘চরৈবেতি’, ‘চরৈবেতি’৷ কিন্তু বাইরের জগতে যা হচ্ছে তাকে উপেক্ষা কোরো না৷ কারণ বাইরের জগৎকে উপেক্ষা করলে তোমার অন্তর্জগতের শান্তিও বিঘ্ণিত হতে পারে৷ তা এই যে শৈব মত বা শৈব ধর্ম এটাই হয়ে উঠল ভারতের প্রাণের ধর্ম–প্রাণীন ধর্ম৷...
শিবই নির্দ্ধারণ করলেন যে কখন বামা বা কখন দক্ষিণা, কখন ইড়া, কখন পিঙ্গলা বা কখন সুষুম্না ভেদে (তিনটি প্রধান সূক্ষ্মতর নাড়ীর মধ্যে যেটি যখন বেশী ক্রিয়াশীল) কোন্ সময় কোন্ কাজটা করতে হয়, কখন জাগতিক কাজ অর্থাৎ আধিভৌতিক কাজ করতে হয়, কখন মানসিক কাজ বা আধিদৈবিক কাজ করতে হয়, কখন আধ্যাত্মিক কাজ করতে হয়–এ সমস্ত শিবেরই বিধান৷ কী অবস্থায় ধ্যান করতে হয়, কী অবস্থায় আসন, কী অবস্থায় প্রাণায়াম করতে হয় ইত্যাদি৷... (ক্রমশঃ)