আচার্য রামানন্দ দাসের প্রয়াণে

লেখক
খগেনচন্দ্র দাস

ছান্দোগ্য উপনিষদের ঋ ষি বলছেন, ‘জীব কর্ত্তৃক  পরিত্যক্ত হইলে এই দেহ মরিয়া যায়, কিন্তু জীব মরে না৷’ আমরা এই ঋষি উক্তির ব্যবহারিক সত্যতা খুঁজে পাই ঋষি অরবিন্দর একটি বাক্যে, ‘প্রবহমান কালের মধ্যে যদি পরিণামের একটি পর্ব দেখতে পাই, তাহলে তার অতীত আরও পর্ব ছিল– একথা অনস্বীকার্য৷ অতএব এ–জীবনে জীব যদি একটা পরিণত ব্যক্তিভাব নিয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকে, তাহলে এখানে হোক আর যেখানেই হোক, পূর্ব জন্মে এর জন্য একটা প্রস্তুতির পর্ব অবশ্যই ছিল৷’’ (দিব্য–জীবন, শ্রী অরবিন্দ, পৃঃ৬৬৭) শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ঠিক এই কথাটিই পুস্তকে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কার্যসূচীতে বলেছেন–(‘‘হে পরমেশ্বর, তাঁর অমর আত্মা উত্তরোত্তর প্রসার লাভ করুক৷’’) (আর রবীন্দ্রনাথ বলেছেন গানে–‘‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে যাই আমি ধাই–/ কোাথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই৷’’) প্রত্যেকের কথাতেই ফুটে উঠেছে আত্মা ও মৃত্যু সম্পর্কে সেই বৈদিক ঋষি উক্তির নির্যাস৷

উপনিষদের এই যৌক্তিকতার ধারা মেনেই ২২শে ফেব্রুয়ারি,২০২৩ বিকেল চারটে ত্রিশ মিনিটে নগাঁও শহরের  খ্রীষ্টান পট্টিস্থিত নিজ বাসভবনে বার্ধক্যজনিত কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন স্বনামধন্য কৃতী শিক্ষক শ্রদ্ধেয় রামানন্দ দাস৷ (জন্ম ১৯৩৬ সনের ১আগষ্ট, মৃত্যু ২২শে ফেব্রুয়ারি ২০২৩) মৃত্যুর সময় তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী, দুই পুত্র, কন্যা, নাতি–নাতনীও অসংখ্য গুণমুগ্ধদের৷ তিনি নগাঁও জেলা বিশেষ করে জেলার পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলে একজন প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, নিষ্ঠাবান, সরল, পরোপকারী ও পরায়ন ও কর্তব্যপরায়ন শিক্ষক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন৷

কর্মজীবন শুরু করেছিলেন উত্তরপুূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য কার্যালয়ের একাউণ্টস বিভাগের করণিক হিসেবে৷ কিন্তু মানবতার পুজারি এই মানুষটি মানুষের কাছাকাছি থেকে তাদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে ও বহুমুখী সেবামূলক কাজ করার প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে স্বেচ্ছায় বেছে নেন গ্রামের বেসরকারি স্কুলে প্রায় বিনাবেতনের শিক্ষকতার এক অনিশ্চিত জীবন৷ একটি সুরক্ষিত নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে তিনি যে ঝাঁপ দিতে পেরেছিলেন তার নেপথ্যে ছিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু, তাঁর জীবনদেবতা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি৷ রামানন্দ দাস, যাঁর আদর্শের পতাকা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সাফল্যের সঙ্গে  আজীবন  করেছেন৷ কোন সুখের হাতছানি অথবা দুঃখের ভ্রুকুটি কোনটাই তাঁকে একমুহূর্তের জন্যও তাঁকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি৷ এক নোতুন জীবন শুরু করেন গড়াজান, লাইলরি, লামডি ও আমবাগান ইত্যাদি অপ্রাদেশীকৃত স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে৷ অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে, কঠোর দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করে দীর্ঘদিন অতিবাহিত করার পর অবশেষে অনেকটা দেরিতে কর্মসংস্থান হয় তাঁরই প্রাক্তন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নগাঁও শহরের ঐতিহ্যমণ্ডিত নগাঁও বেঙ্গলী বয়েজ হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুলে বাংলার শিক্ষক হিসেবে৷ বাংলায় স্নাতকোত্তর সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত এই মহান শিক্ষকের আদর্শ ও অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে বহু ছাত্রছাত্রী আজ সন্মানের সঙ্গে দেশে বিদেশে সমাজের নানা স্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত৷ তাঁর মার্জিত পোষাক, আচরণ, সহূদয় ব্যবহার, নিয়মানুবর্তিতা, সততা, বাগ্মীতা, বিলাসহীন জীবনযাপন, শিক্ষাপ্রদানের দক্ষতা সবকিছুই গভীর ছাপ রেখেছিল ছাত্র সমাজ, সহকর্মী তথা পরিচিতজনেদের কাছে৷ ‘‘আপনি আচরি ধর্ম এই আপ্তবাক্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন রামানন্দ দাস৷ তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক ও সম্পাদক৷ বাংলা ও অসমীয়া ভাষায় রচনা করেছেন একাধিক কাব্যগ্রন্থ, বহু প্রবন্ধ৷ অগ্রন্থিত আকারে রয়ে গেছে একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিও৷ বিদ্যালয়ের স্মরণিকা ছাড়াও সত্তরের দশকের শেষের দিকে সম্পাদনা করেছেন ‘প্রভাত’ নামের একটি অসমীয়া মাসিক পত্রিকাও৷ যদিও নানা কারণে পত্রিকাটি দীর্ঘায়ু হয়নি৷ বাংলা ও অসমীয়া ভাষার সাহিত্য ছাড়াও আনন্দমার্গ দর্শন, ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শন ও  ধর্মতত্ত্বে তাঁর অসামান্য দখল ছিল৷ সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংঘটক৷ এই সমস্ত গুণাবলীর জন্য আনন্দমার্গ দর্শনের প্রবক্তা তাঁকে আনন্দমার্গ দর্শন, আধ্যাত্মিক যোগসাধনা ও আদর্শের প্রচারের জন্য ‘আচার্য’ হিসেবে মনোনীত করেন৷ তিনি আজীবন গুরুপ্রদত্ত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন৷ তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, অধ্যাত্ম বিষয় অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করার অসাধারণ দক্ষতার জন্য নগাঁও জেলার বহু তরুণ তরুণী নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করে দেশ বিদেশে আনন্দমার্গ আদর্শের প্রচারে, মানবতার  সেবায় কাজ করে চলেছেন৷ তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্রও জীবন উৎসর্গ করে সন্ন্যাস গ্রহণপূর্বক ইয়ূরোপের বিভিন্ন দেশে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আনন্দমার্গ আদর্শের প্রচারে ব্যাপ্ত৷ একটি প্রদীপের শিখা থেকে হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা যায়, একথার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রামানন্দ দাস ও তাঁর জীবন৷ এই মহান শিক্ষকের প্রয়াণে একটি যুগের অবসান হল৷ বৈদিক ঋষির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমরাও প্রার্থনা করি– থেমে থাকা জীবনের  লক্ষ্য নয়, মৃত্যুর মধ্য দিয়েই চরৈবেতি করে চরম লক্ষ্যের পানে এগিয়ে চলাই জীবনের মূল লক্ষ্য৷ তাঁর বিদেহী আত্মা সেই চরম ও পরম লক্ষ্যে পৌঁছাক৷ ‘‘অমৃতত্ত্বায় গাতুম’’ (ঋগ্বেদ,১/৭২/৯)