অগস্ত্যপত্নী–কৌশিতকী

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কৌশিতকী ছিলেন মহর্ষি অগসেত্যর পত্নী৷ মহর্ষি অগস্ত্য তাঁর জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন আদর্শের প্রচারে, মানবিকতার সম্প্রসারণে৷ তাঁকে এই কাজে প্রতি পলে বিপলে সাহায্য করে থাকতেন তাঁর স্ত্রী কৌশিতকী৷ কৌশিতকী ছিলেন অত্যন্ত বিদুষী মহিলা ও ব্যাপক মানব হূদয়ের অধিকারিণী৷ কখনও অগস্ত্য তাঁকে নির্দেশনা দিয়ে কাজ করাতেন, কখনও বা তিনিও নব নব ভাব–তত্ত্ব উদ্ভাবনের দ্বারা মহর্ষি অগস্ত্যকে নির্দেশনা দিতেন৷ এই ভাবে উভয়ে মিলেমিশে কাজ করে গেছলেন মানব জীবনে দেবত্ব ভাবের উত্তরণের জন্যে৷

তোমরা জান, প্রাকৃতিক বিচারে ভারতের দক্ষিণাংশ দক্ষিণাপথ বা দাক্ষিণাত্য নামে পরিচিত ও উত্তরাংশ উত্তরাপথ বা আর্যাবর্ত নামে পরিচিত৷ দক্ষিণাপথের মধ্যমাংশ সুপ্রাচীন গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ আর্যাবর্তের দক্ষিণ দিকের কিছুটা অংশও প্রাচীন গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ বাকী অংশ হিমালয় বা তার পাললিক উপাদানে গঠিত ছিল৷ দক্ষিণাপথের মূল স্রোত এসেছিল দ্রাবিড়ী সাংস্কৃতিক অভিস্রোত থেকে যা’ রাঢ়ীয় সভ্যতার দ্বারা হয়েছিল ব্যাপক ভাবে সম্পৃক্ত৷ উত্তর ভারতীয় সভ্যতা এসেছিল ককেশীয় অভিস্রোত থেকে যা’ রাঢ়ীয় সভ্যতার দ্বারা ছিল প্রতি অনুপলে অভিস্পন্দিত৷ উত্তরাপথের নিম্নাংশ ছিল সম্পূর্ণভাবে রাঢ়ীয় সভ্যতার উৎসারণ৷ আমরা আজকাল যাকে বাঙালী সভ্যতা বলি তা–ই রাঢ়ীয় সভ্যতার সঙ্গে গাঙ্গেয় তথা ব্রহ্মপুত্র সভ্যতার ত্রিবেণীসঙ্গম৷ বাঙালীর সভ্যতা অনেক দিনের পল্লবিনী রূপ, তা এতটা মাধুর্যময় হয়ে উঠেছিল এই কারণে যে তাতে ঘটেছিল নানান ধরণের বৈপরীত্যের মাধ্বী সংস্থিতি৷

হ্যাঁ, আসল কথায় ফিরে আসা যাক৷ মহর্ষি অগস্ত্য ঠিক করলেন তিনি বিন্ধ্য পর্বত পার হয়ে দক্ষিণাপথে গিয়ে সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটাবেন, দক্ষিণাপথকে উত্তরের কাছে টেনে আনবেন৷ তিনি নাকি কৌশিতকীকে বলেছিলেন–‘‘চলো, আমরা দুজনেই যাই’’৷ কৌশিতকী নাকি বলেছিলেন–‘‘না, সেটা ঠিক হবে না৷ দু’জনে এক প্রত্যন্তে গেলে অন্য প্রত্যন্ত খালি থেকে যাবে৷ দক্ষিণাপথে যাবার প্রয়োজন রয়েছে৷ তাই তুমি দক্ষিণাপথে নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকার সঙ্গে ভাব বিনিময় করো৷ আর আমি উত্তরাপথে থেকে সকলের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে যাই’’৷ তাই কৌশিতকী অগস্ত্যের সঙ্গে দক্ষিণাপথে গেলেন না৷ তিনি আর্যাবর্তেই থেকে গেলেন৷

তোমরা জান যে সঙ্গীতের (নৃত্য, বাদ্য ও গীত তিনে মিলে সঙ্গীত) স্রষ্টা শিব আর এ ব্যাপারে তাঁর প্রথম শিষ্য ছিলেন মহর্ষি ভরত৷ এই ভারতীয় সঙ্গীত বা শিবদত্ত সঙ্গীত উত্তর ভারতে একটি ধারায় ও দক্ষিণ ভারতে আরেকটি ধারায় প্রবাহিত৷ তোমরা নিশ্চয়ই জান, গাছ–ফুল–ফল–বীজ সবই দীর্ঘকাল ধরে এক পরিবেশে থাকলে তার মধ্যে একটি পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য জেগে যায়৷ একই ল্যাংড়া আম কাশীতে, বারুইপুরে ও মালদায় দেখবে, ১০০০ বছর পরে তাদের পাতায় বর্ণে স্বাদে গন্ধে অনেক পরিবর্তন এসে যাবে৷ এই পরিবর্তনকে বলি পরিবেশগত পরিবর্তন (environmental change) শিবদত্ত সঙ্গীতও তাই উত্তর ভারতে এক খাতে ও দক্ষিণ ভারতে আরেক খাতে বইছিল৷ উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতকে আর্যাবর্ত সঙ্গীত বা হিন্দুস্তানী সঙ্গীত ও দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতকে দাক্ষিণাত্য সঙ্গীত বা কর্ণাটক সঙ্গীত বলা হয়৷ তেমনি চাল–চলনে, আচার–ব্যবহারে দুয়েতেই কিছুটা environmental change বা পরিবেশগত পরিবর্তন এসেছিল...যা আসা খুবই স্বাভাবিক৷

উত্তর ভারতেও পশ্চিমে ও পূর্বে এই পরিবেশগত পার্থক্য খুবই প্রকট৷ আর এই প্রকটতা বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছিল বাঙলায় যেখানে সভ্যতায় ঘটেছিল ত্রিবেণীসঙ্গম৷ জাত হিসেবে বাঙালী মুখ্যতঃ অষ্ট্রিকো–মংগলো–নিগ্র্৷ যত দূর জানা যায় মহর্ষি অগস্ত্য বাঙলায় আসেননি৷ এলে উত্তর ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বাঙলার ভাব–বিনিময় অনেকটা বেশী হয়ে যেত৷

যাই হোক, এবার একটু গল্পকথায় আসা যাক৷ গল্পে আছে যে এই বিন্ধ্য পর্বতের শির ছিল উত্তুঙ্গ৷ এ কথা ঠিকই যে প্রাচীন গণ্ডোয়ানাভূমির পাহাড়গুলি ছিল খুবই উঁচু–চির তুহিনাবৃত৷ জলে ঝড়ে উপলসংঘাতে তারা ক্ষয়প্রাপ্ত eroded হতে থাকে৷ তাই আজকের যে বিন্ধ্য তা’ এককালে যে খুবই উঁচু ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই৷ যাই হোক, গল্পকথা অনুযায়ী বিন্ধ্য পর্বত খুবই উঁচু ছিল৷ তাই উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়া সহজসাধ্য ছিল না৷ মহর্ষি অগস্ত্য যখন বিন্ধ্যের কাছে এলেন, বিন্ধ্য তাঁকে সম্মান জানাবার জন্যে আভূমি প্রণত হ’ল৷ অগস্ত্য চেয়েছিলেন উত্তর–দক্ষিণের ভাব বিনিময়৷ তিনি বিন্ধ্যকে বললেন–জীতে রহো বেটা৷ কিন্তু যতদিন না আমি ফিরছি ততদিন তুমি মাথা নীচু করে থাক৷ আমি দক্ষিণ ভারত থেকে ফিরে এলে এই প্রণামটিতেই তোমার সেই সময়কার প্রণাম সেরে নেওয়া হবে৷

অগস্ত্য দক্ষিণে গেলেন, আর ফিরলেন না৷ বিন্ধ্য মাথা নীচু করে রয়ে গেল, আর উঁচিয়ে উঠল না৷ উত্তরে–দক্ষিণে ভাব বিনিময় অব্যাহত গতিতে চলতে লাগল৷ অগস্ত্য ফিরে এলেন না৷ তাই সেই থেকে কেউ যদি কোথাও গিয়ে আর না ফেরে আমরা তাকে বলি অগস্ত্য–যাত্রা৷