আমরা কোথায় চলেছি তা ভাবতে হবে

লেখক
সঞ্জীব বিশ্বাস

আজকের স্বাধীন ভারতের নিত্যদিনের ঘটনা দুটি৷ (এক) মহিলা, কিশোরী ও শিশু কন্যাদের ওপর পাশবিক হেনস্তা৷ (দুই) ডোমেষ্টিক ভায়োলেন্স৷ এই উপদ্রবদুটি গোটা দেশব্যাপী এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিরূপে অবস্থান করছে৷ শুধু তাই নয়–বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্টে দেখা যায় জ্যামিতিক হারে ওই শক্তিমানরা তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছে৷ তাই পত্র পত্রিকা ও বৈদ্যুতিন মিডিয়ার স্যুইচ ওপেন করলেই উক্ত খবর দুটি থাকবেই৷ তাই ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই যে ভারতের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ যেন পাগলা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছে৷ এর শেষ কোথায় তা কারও জানা নেই৷

এই পরিবেশে আলোচনার দাবী রাখে এই যে, ভারতবাসী পরম্পরায় পাওয়া মনুষ্যত্ববোধকে হারিয়ে আদিম প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ছে কেন এমতাবস্থায় প্রশ্ণ আসছে, শিক্ষার আলো পেয়েও সমাজ জীবনে যদি বন্য প্রবৃত্তির পরিবর্তন না ঘটে, উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেতে থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে গলদটা আধুনিক শিক্ষা দানের মধ্যেই রয়ে গেছে৷ উক্ত মূল্যায়নের জন্যে বিতর্কের অবতারণা যে হবে তা নিশ্চিত৷ এই অবস্থায় দেশের প্রাচীন ও আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষা দান সম্পর্কে দুই একটি কথা বলে নেওয়া দরকার৷ আধুনিক ভারতে শিক্ষা দান পদ্ধতির মালিক তথা পরিচালক হচ্ছে, রাজনীতির চোরকারবারী, পুলিশ ও কোর্ট৷ আর প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিচালক থাকতেন আচার্যরা৷ ফলে তাঁরা বিদ্যার্থীদের সংস্কারগত অভ্যাসকে পরিবর্তন বা সংযত করে তাদের মানুষ গড়ার দোর গোড়ায় পৌঁছে দিতে পারতেন৷ কিন্তু আধুনিক ব্যবস্থায় শিক্ষকদের সেই যোগ্যতা নেই৷ শিক্ষকরা নিজ দায়িত্বে কিছু করার তাগিদও অনুভব করেন না৷ ফলে বিদ্যার্থীদের মানবিক উত্তরণ ঘটার সুযোগ বিশেষ একটা থাকে না৷ সুতরাং আদিম প্রবৃত্তিকে সংযত রাখার ক্ষমতা ভারতীয় সমাজে দিন দিন তলানীতে এসে ঠেকেছে৷

এক্ষণে সমাজ সম্পর্কে আলোচনার দাবী রাখে৷ আনুমানিক কয়েক হাজার বছর (সাড়ে তিন থেকে চার হাজার) পূর্বে মুনীঋষিরা অনুভব করেছিলেন, মানব জাতিকে বাঁচাতে গেলে একটা ন্যায়–নীতি ও অনুশাসন নির্ভর সমাজ ব্যবস্থা গড়তে হবে৷ তারা তা করেও ছিলেন৷ সেই প্রথা দীর্ঘদিন ধরে পরম্পরাগত ভাবে এদেশে চলেও আসছিল৷ তবে দীর্ঘদিনের শ্রুতি নির্ভর সামাজিক নীতিবোধের অভ্যন্তরে বিচ্যুতি যে ঘটেছিল তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই৷ কিন্তু ওই বিচ্যুতির সংস্কারের নামে আধুনিক প্রবক্তারা পুরাতন সমস্ত নিয়ম–নীতিকে জঞ্জাল বলে মনে করতেন৷ তাই আধুনিক সংস্কারপন্থীরা সমাজের সর্বত্রই যার যার ইচ্ছাপুরণের সুবিধার্থে সমাজকে ভাঙা গড়ার খেলায় মেতে উঠলেন৷ যে কারণে প্রাক্ স্বাধীনতা যুগেই প্রাচীন পরম্পরাকে অমান্য করার প্রবণতা তৎকালীন সময়ের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে দেখা দিল৷ পরবর্ত্তী কালে সাহিত্যিক, নাট্যকার, পালা লেখকরা সমাজের মূল্যবোধকে উচ্ছেদ করে তার জায়গায় যে আধুনিক ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠা দিলেন, তা–ই আজ সমাজ জীবনে ব্যুমেরাং হয়ে উঠেছে৷ কারণ নীতিবোধ কোথাও নেই৷

বস্তুত আগামী প্রজন্ম বুঝতেই পারবে না মূল্যবোধ ও নীতিবোধ কাকে বলে৷ কেননা এই ভারতেরই প্রথা ছিল আস্থা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে সমাজ পরিচালনা৷ সমাজের এই মৌলিক দায়বদ্ধতা পালনে যাঁরা অবহেলা করতেন বা ব্যর্থ হতেন, সমাজের চোখে তাঁদের সম্মান ক্ষুন্ন হত৷ ফলে ধনী ও গরীব নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই চেষ্টা থাকত সামাজিক নীতিবোধকে মেনে চলার৷

আধুনিক সমাজে যা নেই তা হচ্ছে বিশ্বাস, আস্থা নির্ভরশীলতা ও দায়বদ্ধতা৷ তাই আজ আমাদের অবস্থা হচ্ছে আমরা সবাই রাজার রাজা এই রাজার রাজত্বে৷ বলতে গেলে আজকের আধুনিক মানুষরা বড্ড একা হয়ে পড়েছে৷ ফলে দিনের বেলায় হাজার লোকের চোখের সামনে অকুতোভয়ে নারীর সম্মান লুঠ করে দুষ্কৃতীরা বুক চিতিয়ে চলে যেতে পারছে৷ বাধা দেওয়ার বা দুষ্কৃতীকে জাপটে ধরার ক্ষমতা পর্যন্ত কেউই রাখে না৷ প্রশ্ণ হচ্ছে কেন কারণ হচ্ছে সামাজিক দায়বদ্ধতা এদেশে আর নেই৷ অথচ অতীতে এই ধরণের অপরাধকে সংযত করার জন্যে একটা সামাজিক নীতিবোধ ছিল৷ কিন্তু আধুনিক সমাজে সেই চাপ আজ আর নেই৷ পরিবর্তে সবাই স্বাধীন, তাই সামাজিক কোড বলতে আজ আর কিছু নেই৷ আছে জোর যার মুলুক তার৷ ফলে গ্রাম থেকে শহর, কোথাও প্রাচীন নীতিবোধের ওপর আস্থা–বিশ্বাস–নির্ভর নামক সামাজিক দায়বদ্ধতার ছিটেফোঁটাও নজরে অসে না৷ তাই পরিবারগুলির ৯০ শতাংশই অন্তর থেকে দেউলিয়া৷ ফলে সন্তানের কাছে বাবা–মা’র নিরাপত্তা বলতে যা বোঝায় তা নেই৷ এখানে শিক্ষিত আর অশিক্ষিতের মধ্যে কোনরূপ ফারাক নেই৷ দাদা ও বোন, কিম্বা দিদি–ভাই কেউ কারও উপর বিশ্বাস বা আস্থা রাখতে পারছে না৷ স্বামীর কাছে স্ত্রী আবার স্ত্রীর কাছে স্বামীর বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভরতা আজ আর পাওয়া যায় না৷ পরিবর্তে ভাললাগা নামে আধুনিক সংস্কৃতির মৌলিক শর্ত যতদিন জীবিত থাকে ততদিনই স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক বজায় থাকে৷ যেমন প্রাচীন সংস্কৃতিতে শিক্ষকের কাছে বিদ্যার্থীদের মূল্যায়ন হত সন্তান হিসেবে৷ সেই প্রথাকে উচ্ছেদ করে যে আধুনিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাতে সম্মান সূচক দায়বদ্ধতার পরিবর্ত বেলেল্লাপনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে৷ বলতে গেলে প্রাচীন সংস্কৃতির যে মানবিক বোধগুলি পরম্পরা রূপে সমাজে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছিল আধুনিক কালে তা প্রায় শেষের পথে৷ এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করার রসদ আমার ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করা আছে৷ দীর্ঘদিন ধরে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘুরতে গিয়ে যে সকল হূদয় বিদারক ঘটনা চোখে পড়েছে তার দুই চারটি তুলে ধরলে পরিষ্কার হত ধোপদুরস্ত মানুষের সমাজের আজকের অবস্থান কোথায় তারপরও বলছি ভারতের ‘‘আত্মাস্বরূপ’’ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি শ্বাশত ভারতের অনুশাসন ও শুচিতা হারিয়ে অষ্টাদশ শতকের খ্রীষ্টান মিশনগুলির অনুরূপ অর্থকরী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে উঠেছে৷ সুতরাং ন্যায়–নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধহীন সমাজে যা ঘটার তাই ঘটছে৷ এই অবস্থায় মহিলা, কিশোরী, শিশুকন্যাদের উপর যৌন হেনস্তা বা ডোমেষ্টিক ভায়োলেন্স যা দেখা দিয়েছে তার জন্যে দোষারোপ করার কোনও অর্থ হয় না৷ অথবা এই অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পর যেসকল সমালোচকরা পুরুষ শ্রেণীকে দায়ী করে সামাজিক কর্তব্য সম্পন্ন করছেন সেটাও আধুনিক সমাজের একটা প্রতারণা বললে অত্যুক্তি হবে না৷ কারণ কর্তব্যটা শুধু সমালোচনার মধ্যেই শেষ হয় না৷ অথচ মূল জায়গায় আঘাত হানবে কে, সেই আদর্শবান মানব গোষ্ঠী দেশে বর্তমানে প্রায় নেই বলেই প্রকৃত অপরাধীদের বারবাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে৷

বস্তুত আজ ভাবতে হবে কি ধরণের সমাজ ব্যবস্থা ভারতবাসীর জন্যে উপযুক্ত হবে৷ কারণ প্রাচীন সমাজের ন্যায়, নীতি, মূল্যায়ন, মূল্যবোধকে পরিত্যাগ করে দায়বদ্ধহীন আধুনিক সমাজ আমরাই চালু করেছি ও তাকে বহনও করে যাচ্ছি৷ সুতরাং সমাজবিরোধীদের বাড়বাড়ন্ত ও দৌরাত্ম্যের হাত থেকে যদি বাঁচতে হয় তাহলে আমাদেরই ভাবতে হবে৷ কারণ এক শ্রেণীর শিক্ষিতদের প্ররোচনাতেই আমরা ন্যায়–নীতি, মূল্যবোধ ও দায়বদ্ধতার মতো চিরন্তন সত্যকে বিতাড়ন করে সামাজিক উচ্ছৃঙ্খলতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছি৷ আজ সেই অপরাধেরই প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ নিজের হাতে মার খেয়েও যদি সন্তানের তথা নবীন প্রজন্মের সম্বিৎ না ফেরে তাহলে মানুষ নামধারী প্রাণীদের বেঁচে থাকার কোনও অর্থ হয় না৷ আর এই আত্মসম্বিতের জাগরণের মধ্যেই আগামী প্রজন্ম গড়ে উঠবে৷