অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই প্রকৃত উন্নয়নের মাপকাঠি

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট) করে উন্নয়নের ঢাক পেটাচ্ছেন নেতামন্ত্রীরা৷ কিন্তু জিডিপির সঙ্গে আমজনতার সম্পর্ক কতটুকু৷ জিডিপি কমা, বাড়ার সঙ্গে দেশের সার্বিক বিকাশ নির্ভর করে কি? পুঁজিবাদী দুনিয়ায় যেখানে সম্পদের সিংহভাগ দখল করে বসে থাকে  মুষ্টিমেয় কয়েকজন সেখানে জিডিপি দেখিয়ে উন্নয়নের দাবী চরম মিথ্যাচারিতা৷

সাধারণ দেশবাসী জিডিপি বৃদ্ধির ঠিক মানেও বোঝেন না, শুধু এইটুকু বোঝানো হচ্ছে, দেশের অত্যন্ত  দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে৷ জিডিপি বৃদ্ধি মানেই তো দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি৷ দেশের কলকারখানা বাড়ছে, কৃষিজ  সম্পদ বাড়ছে, খনিজ সম্পদ বাড়ছে, পরিষেবা বাড়ছে, দেশে আয় বাড়ছে৷ কিন্তু এতে কি সত্যি বোঝা যাচ্ছে, কাদের আয় বাড়ছে৷ জিডিপির উন্নতির  সঙ্গে  তাল রেখে  দেশের দরিদ্র শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে কি? তাদের স্বাচ্ছন্দ বাড়ছে কি? তাদের ও তাদের ছেলেমেয়েদের  স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে কি?

২০১৯ সালের অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলেছিল, দেশের  সবচেয়ে বিত্তবান ১শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ৷ আর ১ বছর আগে এই ১ শতাংশ বিত্তবান মানুষের হাতে ছিল ৫৮ শতাংশ সম্পদ৷ তার মানে ধনিক শ্রেণীর  সম্পদ  বিপুল হারে বেড়ে চলেছে৷ অন্যদিকে নীচু তলার ৫০ শতাংশ মানুষের আয় এই এক বছরে  বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ৷ তারপর যদি মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তুলনা করা  যায় তাহলে তো ক্রয়ক্ষমতা বরং কমেছে৷

অর্থাৎ দেশের  উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ধনীদের উন্নতি হচ্ছে, তাদের সম্পদ হু-হু করে বাড়ছে৷ তাতে  গরীবের দুঃখমোচন হচ্ছে কি?

আসলে  বর্তমান দেশের অর্থনীতি পুঁজিবাদী অর্থনীতি৷ বছরের পর বছর পুঁজিপতিদের সম্পদ ফুলে ফেঁপে ঢাক হচ্ছে৷  সাধারণ গরীবদের দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা বেড়েই চলেছে৷ শুধু ভারতের কেন আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড-এর মত অর্থোন্নত দেশগুলিতেও প্রচণ্ড বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ যৎসামান্য করে বেকারভাতা দিয়ে রাখছে৷ মাঝে মাঝে বিক্ষোভ দেখা দেয়, কিন্তু জোর করে সেই বিক্ষোভকে  দমন করা হয়৷

প্রাউট-প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, যতদিন না অর্থনীতির  বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়, ততদিন দেশের  প্রকৃত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়৷ জিডিপি বা মাথা পিছু  গড় আয় বৃদ্ধি এগুলো অর্থনীতির  উন্নতির লক্ষণ নয়, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এতে ধনীদেরই সম্পদ বৃদ্ধি হয়, ধনীদের হাতে দেশের সম্পদের কেন্দ্রীকরণ হচ্ছে৷ তাতে ধনীদের হাতে শুধু দেশের  অর্থনৈতিক চাবিকাঠিই নয়, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক --- সমস্ত  চাবিকাঠিই কুক্ষিগত হচ্ছে৷ তারা তো  প্রধানতঃ মুনাফাটাই বোঝে৷ মুনাফার জোরেই তারা ধনী৷ তাই অর্থশক্তি দিয়ে তারা সারা দেশকে নিজেদের কুক্ষিগত করে৷ দেশের বৈশ্যশোষণ চরম হতে থাকে৷

আজ আমরা কথায় কথায় ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে  শ্লোগান তুলছি৷ গণতন্ত্রের জয়গান গাইছি৷ কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, এই গণতন্ত্র বর্তমানে পুঁজিপতিদের হাতের পুতুল৷ ধনীরা টাকার জোরে গণতন্ত্রকে হাটে বাজারে বিক্রি করতে পারে৷  যেমন বস্তা বস্তা টাকা সহজে  গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মোড়  ঘুরিয়ে দেয়৷ কালোকে শাদা আর শাদাকে কালো করে দেয়৷

নগদ টাকা  দিয়ে, চাল, কাপড়, মদ দিয়ে বোট vote) কেনা যায়৷ ধনীরা  টাকার জোরে তাদের মনোমত প্রার্থীদের সহজে জিতিয়ে আনতে পারে৷ এটা তো বাস্তব অভিজ্ঞতা৷

তাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক  গণতন্ত্র অর্থহীন৷ অর্থনৈতিক  গণতন্ত্র মানে দেশের প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের গ্যারান্টি৷ না, দান দক্ষিণার দ্বারা নয়, তাদের যুগোপযোগী ক্রয় ক্ষমতা দিতে হবে৷ আর স্থানীয় অর্থনৈতিক শক্তির নিয়মক হবে স্থানীয় মানুষেরা৷

জগতের সম্পদ সীমিত৷  প্রকৃতিদত্ত সম্পদে সমাজের  সমস্ত  মানুষেরই  অধিকার আছে৷ তাই, কারুর জিম্বায় বিপ ল সম্পত্তি থাকবে , আর  অঢেল  বিলাসিতায় জীবন অতিবাহিত  করবে,  সম্পদের অপচয়  করবে, আর  অন্যদিকে না খেয়ে অভাবের  তাড়নায় মানুষ শুকিয়ে মরবে, এ ব্যবস্থা কখনই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না৷

তাই এই সামাজিক  অর্থনৈতিক ব্যবস্থার  আমূল পরিবর্তন  চাই৷ আর সেই কারণেই প্রাউট প্রবক্তা দিয়েছেন, অর্থনৈতিক  গণতন্ত্রের আদর্শ৷ এই অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শ ছাড়া সমাজের  সর্বস্তরের মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়৷