(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ধানের জমির আগাছা তুলে ফেলে তবেই তরল সার দিতে হবে, তা না হলে আগাছাই সার টেনে নেবে৷ ঠিক তেমনি পায়রা ফসলের বীজ ছড়ানোর আগেই তরল সার ব্যবহার করতে হবে, তা না হলে ধানের জন্যে দেওয়া সার পায়রা ফসল টেনে নেবে৷ ধানে ফুল আসার পরই পায়রা ফসলের চাষ করতে হবে, তা না হলে মাছের চলাফেরা ব্যাহত হবে, আর মাছের আকার ছোট হবে, ধানের উৎপাদনও কম হবে৷
রাঢ়ের যে সমস্ত অঞ্চলের মাটি দোঁয়াশ সেখানে গম ভালো ফলবে৷ বাঙলায় গম উৎপাদনের সর্বোত্তম জায়গা হচ্ছে মালদা জেলা, মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা ও বহরমপুর মহকুমা, নদীয়া জেলা, উত্তর ২৪ পরগণা, আর যশোর ও খুলনা জেলার উত্তরাংশ৷ কুষ্ঠিয়া জেলাতেও গমের ফলন হতে পারে৷ সাধারণতঃ উর্বর সমতল জমি, অল্প জল ও ঠাণ্ডা বাতাসে গমের ফলন ভালো হয়৷ ভালো ফলন পেতে হলে গমের ক্ষেতে তিনবার সেচ দিতে হবে– প্রথম সেচ হবে গম চারা রোপণের আগে, তারপরের সেচ হবে চারা যখন বেড়ে উঠবে, সবশেষের সেচ হবে যখন ফুল আসছে তখন৷ বর্দ্ধমান জেলার মেমারী (১) ব্লকে গম, গলসী (২) ব্লকে হলদে সরষে ও জামালপুর ব্লকে আলু চাষ হতে পারে৷ বাঁকুড়া জেলা সব থেকে ভালো গমের বীজ সরবরাহ করে৷
বাঙলার সমতট অঞ্চলের মাটি গমের জন্যে উৎকৃষ্ট, কিন্তু এখানে পর্যাপ্ত নদী সেচের ব্যবস্থা নেই৷ তবে ঈশ্বরের কৃপায় মাটির নীচে অল্প গভীরতায় প্রচুর জল আছে৷ স্বল্প গভীরতায় নলকূপের সাহায্যে সেই জল তুলে এখানে গম চাষ করা যেতে পারে৷
গমের সাথী ফসল হিসেবে পোস্তোর চাষও চলতে পারে৷ পোস্ত রাঢ়ের মানুষের প্রিয় খাদ্য৷ পোস্ত ফলের আঠা অহিফেন একটি সাংঘাতিক ধরণের মাদক দ্রব্য৷ অথচ এর বীজ কোষের মধ্যস্থিত পোস্ত বীজ বা পোস্ত দানা একটি সাত্ত্বিক খাদ্য–রাঢ়বাসীর অতি প্রিয় ভোজ্য৷ দরিদ্র রাঢ় প্রতিবৎসর লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বাইরে থেকে এই পোস্ত আমদানী করে৷ রাঢ়ের কৃষ্ণমৃত্তিকা যদিও পোস্ত চাষের পক্ষে অত্যুত্তম নয় তবুও রাঢ়ের গমের ক্ষেতের চারিপাশে সীমান্ত রেখা হিসেবে আল বরাবর পোস্ত লাগানো যেতে পারে৷ গমের সঙ্গে বিমিশ্র ফসল হিসেবেও চাষ করা যেতে পারে৷ পোস্ত একটি আবগারি বিভাগীয় পন্য তাই এর চাষের জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্ত্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে৷ কেন্দ্রীয় আবগারি বিভাগের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখে রাঢ়ে প্রয়োজনমত পোস্ত পাওয়ার জন্যে যে পরিমাণ আফিন চাষের প্রয়োজন সে পরিমাণ আফিন চাষের অনুমতি দেওয়া উচিত৷ অন্যথায় এই পোস্ত কিনতে গরীব রাঢ়ের অর্থের বহিঃস্রোত বন্ধ করা যাবে না৷ অবশ্য গরীব রাঢ়বাসী যাতে আফিংয়ে আসক্ত না হয় সেই জন্যে এই চাষের ওপর কড়া সরকারী তদারকি থাকা দরকার৷
নাইট্রোজেন মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ায়, আর সব ধরণের ডাল গাছের গোড়ায় নাইট্রোজেন তৈরী হয়৷ তাই গমের চাষের সঙ্গে সঙ্গে ওই ক্ষেতে ডাল চাষও করতে হবে৷ যদি একই জমির ৯০ শতাংশে গম লাগানো হয় আর ১০ শতাংশে ডাল লাগানো হয়, তাহলে ডাল গাছের গোড়ায় সৃষ্ট নাইট্রোজেনের প্রভাবে ১০০ক্ম গম ও ১০ক্ম ডাল পাওয়া যাবে৷ অর্থাৎ ডালটা ফাউ হিসেবে পাওয়া গেল৷
বাঙালীস্তানে ডালের মধ্যে সব থেকে বেশী হয় ছোলা, তারপর অড়হর, তারপর মুগ, তারপর মুসুর, তারপর মটর, তারপর কুর্ত্তি৷ ডালের মধ্যে ভালো খাদ্যগুণ আছে বিরিকলাই, ছোলা, অড়হর আর মুগ ডালে৷
বাঙালীস্তানে বর্তমানে ডাল উৎপাদনের পরিমাণ যা তাতে বছরের পাঁচ মাস চলে৷ বাকীটা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আনতে হয়৷ একমাত্র নদীয়া জেলাই ডাল উৎপাদনে স্বয়ম্ভর৷ মালদা আর মুর্শিদাবাদ জেলাও সব রকম ডাল মিলিয়ে কোনমতে কাজ চালিয়ে নিতে পারে৷ শুধু বিরিকলাই উৎপাদনে বীরভূম, বর্দ্ধমান, (অবিভক্ত) পশ্চিম দীনাজপুর ও কোচবিহার জেলা স্বয়ংসম্পূর্ণ৷ পশ্চিমবঙ্গের সামান্য পরিমাণ বিরিকলাই পঞ্জাব ও তামিলনাড়ুতেও যায়৷
আউস বা আমন ধান কাটার পর ভালো করে জমিতে চাষ দিয়ে বড় জাতের লালচে ছোলা, বড় জাতের মটর, আর বড় জাতের মুগের চাষ করা যেতে পারে৷ আমন ধান কাটার পর তিন থেকে চার মাস সাধারণতঃ জমিতে জল থাকে না, কিন্তু আশ্বিনের প্রথম দিকে জমিতে যখন একটু কাদা কাদা ভাব থাকে সেই সময় ছোলা, মটর, মুসুর, খেসারীর বীজ রাতভোর ভিজিয়ে রেখে তারপর অঙ্কুরিত করে পায়রা ফসল হিসেবে চাষ করতে হবে৷
ধানের ক্ষেতে ডালের চাষ করলে ধান কাটার সময় ডাল গাছেরও মাথা কাটা পড়বে, তাতে ডাল গাছের নোতুন শাখা গজাবে, আর উৎপাদনও ভালো হবে৷ ডালের গাছ গোরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যাবে৷ ওই সময়ে নোতুন করে’ সার দিতে হবে না, কারণ ধান গাছ যে সার টানতে পারেনি সেই অবশিষ্ট সারটুকু ডাল গাছ টেনে নেবে৷ ফাল্গুন মাসে দ্বিতীয় ফসল কাটার পর সেই জমিতেই সরষে আর গ্রীষ্মের সয়াবীনের চাষ করা যাবে৷
রাজনগর, দুবরাজপুর, মামুদবাজার, মুরারই আর রামপুরহাট ব্লকে ধান চাষের পর ডালের চাষ হতে পারে৷
একটু উর্বর ও উঁচু জমিতে বিরিকলাই চাষ ভালো হবে৷ সাথী ফসল হিসেবে সয়াবীন, বাদাম ও সূর্যমুখীর চাষ চলবে৷ যে জমিতে বিরিকলাই হতে পারে সেখানে মুগের চাষ না করাই ভালো৷ কারণ মুগ ডালের চাষ সারা বছর ধরেই চলতে পারে কিন্তু বিরিকলাই হবে বছরে একবার৷ তাছাড়া যে কোন ফসলেরই সাথী ফসল হিসেবে মুগের চাষ চলতে পারে৷
বর্ষা আসার আগে অড়হরের বীজ জমিতে ছড়িয়ে দিতে হয়৷ মূলতঃ দু’ধরণের অড়হর হয়–মাঘী আর চৈতী৷ নদীয়া, মুর্শিদাবাদ আর হুগলী জেলার বলাগড় মহকুমায় খুব ভালোভাবেই এই অড়হরের চাষ হতে পারে৷ জমির সবটাই যাতে কাজে লাগানো যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে অড়হরের সঙ্গে সাথী ফসল হিসেবে রেিির চাষ হতে পারে৷ আউশের চাষও হতে পারে৷ কার্ত্তিক মাসে ওই জমিতেই শাঁখ আলু ও রাঙা আলুর চাষ একসঙ্গেই হতে পারে৷ নদীয়া জেলায় সাধারণতঃ আউস আর অড়হর একসঙ্গে চাষ হয়৷ পশ্চিম রাঢ়ের সমস্ত টাঁড় জমিতেই আউস আর অড়হরের চাষ একসঙ্গে করা যেতে পারে৷ (ক্রমশঃ)