বিশ্বনারী দিবস---নারী অভ্যুত্থানের জয়যাত্রা

লেখক
অদিতি দত্ত বাগ

‘নইকো অবলা’ বিভাগে আমরা শুরু করেছি, ভারতীয়  সমাজে নারীর অবদান নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা কিন্তু এখন মার্চ মাস,আর মার্চ মাস মানেই আমাদের মনে আসে ৮ই মার্চ বিশ্বনারী দিবসের কথা৷ কি এমন মাহাত্ম্য আছে এই বিশ্বনারী দিবসের? যা নিয়ে গোটা বিশ্ব মাতামাতি করে৷ আমরা জানি আদিম মানব সমাজে মাতৃতান্ত্রিক প্রথা ছিল৷ তারপর যত সভ্যতার ধারা এগিয়ে চলার সাথে সাথে মাতৃতান্ত্রিক থেকে পিতৃতান্ত্রিক প্রথা শুরু হল৷ ভারতবর্ষে বৈদিক যুগের প্রথম দিকে নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমধিকার বা সমমর্যাদার অধিকারিনী ছিলেন৷ কিন্তু সমাজের যত অগ্রগতি শুরু হল নারীদের ধীরে  ধীরে মর্যাদা হানী ঘটতে শুরু হল,যজুর্বেদের সময়ে বলা হচ্ছে ‘নারী মিথ্যা, দুর্র্ভগ্য,সে মদ বা জুয়ার মতো ব্যসন মাত্র’’--- মৈত্রাময়নীসং ১/১০/১১ সর্বগুণসান্বিতা নারীও অপকৃষ্ট পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট---তৈ ঃ সংহিতা

‘নারীকে  শৈশবে পিতা রক্ষা করেন, যৌবনে স্বামী রক্ষা করে, বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করে স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যের অধিকার নেই’’৷ মান্যবর যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন---‘‘স্ত্রী যদি স্বামীর সম্ভোগ ‘কামনা চরিতার্থ করতে অস্বীকার করে তাহলে স্বামী প্রথমে কোমলভাবে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করবে, তারপরে উপহার দিয়ে তাকে কিনে নীতে চেষ্টা করবে (অবিক্রীনীয়ৎ) এবং পরেও স্ত্রী রাজি না হলে হাত দিয়ে  বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে বল প্রয়োগ করবে৷’’বৃঃ আঃ ১০০/২০/২৪    (৬/৪/৭)

এবং এই যাজ্ঞবল্ক, ঋষি জনকের সভায় যখন বাচকল্বী গার্গীর কাছে তর্কে হেরে গেলেন তখন বলেছিলেন---চুপ করো বেশি তর্ক করো না তোমার মূধর্র্ব খসে পড়বে৷ এই ভাবেই শুরু হয়েছিল নারী সমাজের ওপর ও হিংসাত্মক ব্যবহার যার ঘড়া পরিপূর্ণ হয় মনুর হাত ধরে৷ নারীরা যুগ যুগ ধরে ধর্মের ভয়ে ভীত হয়ে সমস্ত অত্যাচার নিষ্ঠুর মিথ্যা, অপবাদ,শাস্তি মুখ বুঝে মেনে চললেন আর  নিজেদের মর্যাদা, নিজেদের অধিকার সব কিছু থেকে দূরে দূরে অনেক দূরে চলে গেলেন৷ মধ্যযুগের সামন্ত তান্ত্রিক মানসিকতা নারীসমাজকে অতল গহ্বরে তলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল৷ সেই ধারা মধ্যযুগ হয়ে  আধুনিক যুগেও অব্যাহত ছিল৷ কিন্তু বহু অপমান বহু মারের পরও মেয়েরা মাথা তুলতে চেষ্টা করে৷ তারা সমধিকার সমমর্যাদার কথা জগৎবাসীকে জানায়

১৯১১ সালে উত্তর ইয়ূরোপের স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ ডেনমার্কের রাজধানী কোপেন হেগেনে নারীদের পুরুষ কর্মীর সমান বেতন ও কাজের সমান সময়ের দাবীতে দশহাজার মহিলা  দর্জ্জি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছিলেন৷ তাদের এই আন্দোলন গোটা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিল৷

১৯১৩ সালের ৮ই মার্চ দিনটিকে বিশ্বনারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হল সেই দিন আক্ষরিক অর্থে নারী মুক্তির জয়যাত্রা ঘোষণা করার দিন৷ সেই থেকে এই দিনটিকে বিশ্বব্যাপী সাড়ম্বরে নারী দিবস হিসাবে পালন করা হয়৷

মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সবলা’ কবিতায় বলেছেন

‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার

কেন নাহি-দিবে অধিকার হে বিধাতা,

মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর নারীর মর্যাদা গ্রন্থে লিখেছেন---‘‘আমার কাছে ছেলে মেয়েরা হচ্ছে যেন আমারই দুই হাত, দুটো ডানা না থাকলে তো কোন পাখী আর উড়তে পারে না৷ (নারীর মর্যাদা পৃঃ-৯৭)

আসুন আমরা সকলে মিলে বিশ্বনারী দিবসের প্রাক্কালে ভাবতে শিখি নারী পুরুষ সমান আর এটাও ভাবব  স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারীতা নয়৷ এখনও মেয়েরা পিছিয়ে আছে তাই তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে অবৈতনিক শিক্ষা দিতে হবে৷

শিক্ষাক্ষেত্রে কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে৷ নারীদের  সামাজিক নিরাপত্তা দিতে হবে৷ ধর্মের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হবে৷ এখনও গ্রামেগঞ্জে মেয়েরা পণপ্রথার বলি হচ্ছেন অসহায় মহিলারা লাঞ্ছিতা, ধর্ষিতা, অত্যাচারিতা হচ্ছেন, একজন মহিলা হয়ে সকলের কাছে আবেদন জানাই আসুন আমরা সবাই মিলে হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলি---এক সোনালী ভোরের আশায় বুক বাঁধি, সগৌরবে উচ্চারণ করি আমি নারী৷