বিস্মৃত বিপ্লবী সন্তোষ মিত্র

লেখক
স্নেহময় দত্ত

বাঙলা মায়ের যে সব বীর সন্তান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে অমর হয়েছেন তাঁদেরই একজন বিপ্লবী সন্তোষ কুমার মিত্র তথা সন্তোষ মিত্র, হিজলী বন্দীশালায় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের গুলিতে নিহত হয়ে যিনি শহীদ হয়েছেন৷

জন্ম ১৯০০ সালের ১৫ আগষ্ট মধ্য কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে৷ ছাত্র হিসাবে ছিলেন যথেষ্ট মেধাবী৷ ১৯১৫ সালে হিন্দু স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন৷ ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হন দর্শন শাস্ত্রে অনার্স নিয়ে৷ তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র৷ কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ ১৯২১-২২সালে এম.এ.ও এল.এল.বি পাস করেন৷

ছাত্রাবস্থাতেই আকৃষ্ট হন রাজনীতির প্রতি৷ যুক্ত হন কংগ্রেসের সঙ্গে৷ মধ্য কলকাতা কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন৷ যোগ দেন অসহযোগ আন্দোলনে৷ গ্রেফতার হন ১৯২১ সালে৷ চৌরি চৌরার ঘটনায় অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত হলে অন্যান্য অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর ন্যায় সন্তোষ মিত্রও অনুরক্ত হয়ে ওঠেন সশস্ত্র পন্থার প্রতি৷ অনুগামীদের নিয়ে গড়ে তোলেন স্বরাজ সেবক সংঘ নামে বিপ্লবী সংঘটন৷ বিপ্লবপন্থায় তিনি ছিলেন মাষ্টার মহাশয় অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের অনুগামী৷ নিয়মিত যোগাযোগ ছিল মাষ্টার মহাশয়ের সঙ্গে৷ হরিনারায়ণ চন্দ্র, গঙ্গা নারায়ণ চন্দ্র, ভূপতী মজুমদার প্রমুখ বিপ্লবীদের ঘনিষ্ট ছিলেন৷ যুগান্তর গোষ্ঠীর বিপ্লবী বারীন ঘোষের সঙ্গেও যথেষ্ট ঘনিষ্টতা ছিল৷ মাষ্টার মহাশয় অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ ১৯২২ সালে যখন হুগলী বিদ্যামন্দিরে ছিলেন সে সময় সন্তোষ মিত্র তাঁর অনুগামীদের নিয়ে হুগলী বিদ্যামন্দিরে আসতেন৷

(সূত্রঃ হুগলী বিদ্যামন্দির ও আশে পাশে---৬ঃবসন্ত কুমার সামন্ত, ভ্রমণবার্র্ত, ৩০ আগষ্ট,১৯৯৭ সংখ্যা)৷

যোগসূত্র ছিল বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলীর সঙ্গে৷ তাঁরই প্রেরণায় অর্থ সংগ্রহ ও অস্ত্র সংগ্রহের মতো গুরু দায়িত্ব পালন করেন নিঃশব্দে৷ চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীদের কাছে গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করতেন৷ শাঁখারিটোলা পোস্ট অফিস ডাকাতি ও পোস্ট মাষ্টার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯২৩ সালে সন্তোষ মিত্র গ্রেফতার হন৷ কিন্তু প্রমাণাভাবে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়৷ আরও অনেক মামলায় তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেও সফল হয়নি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার৷

সে সময়ে বিপ্লবীরা নানা দলে-উপদলে বিভক্ত ছিলেন৷ পরস্পরের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না৷ যে যার মত করে বিপ্লবপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন৷ যদিও সকলেরই লক্ষ্য সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বিতাড়ন ও দেশের মুক্তি তথা স্বাধীনতা৷ সন্তোষ মিত্র অনেক পরিশ্রম করেছিলেন বিপ্লবী দলগুলোকে একত্রিত করার৷ এ ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন ছিল মাষ্টার মহাশয় অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের৷ সন্তোষ মিত্র অক্রর দত্ত লেনে তাঁর বাসভবনে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিপ্লবীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সকলকে নিয়ে আলোচনাও করেছিলেন৷ বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল---বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, ডাঃ যদুগোপাল মুখার্জী পুলিন দাস প্রমুখ৷ (সূত্রঃ বিপ্লবীর সাধনা---হরিনারায়ণ চন্দ্র অবিস্মরণীয় ভারতঃ গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র)৷

শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গেও সন্তোষ মিত্রর গভীর যোগ ছিল৷ আকৃষ্ট হন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতি৷ এ থেকে বোঝা যায় যে নিছক ব্রিটিশ শাসন মুক্তি তথা রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয় অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও তাঁর চিন্তা ভাবনায় ছিল৷ তাঁরই চেষ্টায় কলকাতায় জওহরলাল নেহেরুর সভাপতিত্বে সোশ্যালিষ্ট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ সোশ্যালিষ্ট পার্টি ঘটনের পরিকল্পনা নিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়া কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন হাওড়ার শিবপুরে কয়েকটি বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন৷ সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন সন্তোষ মিত্র৷ আরও ছিলেন ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ডঃ কানাইলাল গাঙ্গুলি, ডঃ প্রভাবতী দাশগুপ্ত ও বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়৷ পরে পরে যোগ দেন অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, অনুকূল মুখোপাধ্যায় ও বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ৷ এই পার্টির প্রধান কর্মকেন্দ্রই স্থাপিত হয় কলকাতার অক্রর দত্ত লেনে৷ (সূত্রঃ মিহির আচার্য সম্পাদিত শতবর্ষের আলোকে শরৎচন্দ্র৷ তৃতীয় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগদানের জন্য সন্তোষ কুমার মিত্রকেই উপযুক্ত বিবেচনা করে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ কিন্তু শেষ কোনো কারণবশতঃ তাঁর যাওয়া হয়ে ওঠেনি৷ (সূত্রঃ অবিস্মরণীয় ভারত, গঙ্গানারায়ণচন্দ্র)৷

সন্তোষ মিত্র ছিলেন কর্মী নেতা৷ কাজ করতেন নিঃশব্দে প্রচারের আলোকের বাইরে৷ শাঁখারিটোলা পোষ্ট অফিস কাণ্ডে প্রমাণাভাবে ছাড়া পেলেও তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়-দ্বিতীয় আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায়৷ এই মামলায় তাঁর পক্ষে সওয়াল করেন আইনজীবী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত৷ অভিযোগের কোনো প্রমাণ ইংরেজ সরকার করতে পারে নি৷ মুক্ত হন সন্তোষ মিত্র৷ কিন্তু তাঁর কার্যকলাপ ক্রমশঃ ইংরেজ সরকারের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠতে থাকে৷ নিরাপত্তার জন্য তাঁকে বিপজ্জনক বলে ঘোষনা করা হয়৷ তাঁর ওপর প্রয়োগ করা হয় বেঙ্গল ক্রিমিন্যাল অ্যামেণ্ডমেন্ট অ্যাক্ট ইংরেজের এই আইনানুযায়ী যে কোন মানুষকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা যায়৷ ‘সিকিউরিটি প্রিজনার’ রূপে এই আইনে ১৯৩১ সালে সন্তোষ মিত্রকে গ্রেফতার করা হয়--- বন্দি করে রাখা হয় মেদিনীপুরের হিজলী বন্দিশালায়৷ এই বন্দিশালা তৈরী করা হয়েছিল মূলতঃ ইংরেজের কাছে বিপজ্জনক বন্দিদের জন্যই৷ যেখানে বাইরের জগতের সঙ্গে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ৷ বাইরের খবর আটক বন্দিরা যা পেতেন তা নূতন কোন বন্দি সেখানে এলে৷

২৮ জুলাই, ১৯৩১ হিজলীতে খবর এসে পৌঁছায় যে অলিন্দ যুদ্ধের অন্যতম নায়ক দীনেশগুপ্তকে যে বিচারক মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল সেই বিচারক গার্লিককে জনৈক বিপ্লবী হত্যা করেন৷ স্বাভাবিক ভাবেই এই খবরে উল্লসিত হয়ে ওঠেন বন্দিরা৷ এরপর ১৫ই সেপ্ঢেম্বর ওই বন্দিশালা থেকে তিন জন বিপ্লবী বন্দি নলিনী দাস, ফনি দাস ও চিন্তামনি দাস পালিয়ে যান৷ এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ইংরেজ সরকার ও হিজলি বন্দিশালার কর্তৃপক্ষ৷ পরদিন ১৬ সেপ্ঢেম্বর ১৯৩১ তাদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটান হিজলি কর্তৃপক্ষ৷ বিনা প্ররোচনায় নিরস্ত্র বন্দিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়৷ সেই বর্বরোচিত গুলি চালনায় নিহত হন বিপ্লবী সন্তোষ কুমার মিত্র ও বরিশালের বিপ্লবী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত৷ আহত হন অনেকেই৷ মোট ২৯ রাউণ্ড গুলি চালানো হয়, হিজলি ফায়ারিং নামে যা পরিচিতি পায়৷

এই হত্যাকাণ্ড অনেকটাই পূর্ব পরিকল্পিত৷ বন্দিশালায় কিছু না কিছু অশান্তি লেগেই থাকত, আর তার জন্য কর্তৃপক্ষ ওই দুই বিপ্লবীকেই মূলত দায়ী করেছিলেন৷ সুযোগমত তাঁদের হত্যা করার উদ্দেশ্য নিয়েই গুলি চালানো হয় বলে অন্যান্য বিপ্লবী রাজনীতিকদের অনুমান৷ (সূত্রঃ গড়ে ওঠার পথে, না, ভাঙ্গনের পথেঃ আত্ম পরিচয়ের যৎ কিঞ্চিৎ---অধ্যাপক জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ)৷

এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের খবর বাইরে এলে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সারা বাংলা তো বটেই এমন কী সমগ্র দেশও৷ ঘটনাস্থলে পরদিনই ছুটে যান তৎকালীন প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির চেয়্যারম্যান সুভাষচন্দ্র বসু, সঙ্গী হন যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও নৃপেন্দ্র ব্যানার্জী৷ বিপ্লবীরা সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে শহীদদের মৃতদেহ তুলে দেন৷ ১৯ সেপ্ঢেম্বর ধর্মঘটে স্তব্ধ হয় কলকাতা৷ মর্মান্তিক এই ঘটনায় সুভাষচন্দ্র দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন---‘‘আমি খড়্গপুর হইতে অবর্ণনীয় বেদনা লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছি৷ আমাদের বন্ধুদের জেলের মধ্যে কুকুর বেড়ালের মতো গুলি করিয়া মারিবে আর আমরা কি এখন বিবাদ বিসম্বাদে রত থাকিব?---আজকের দিনে অন্তরের অন্তস্থল থেকে যে কান্না উঠে আসছে সে একথাই বলছে--- শহীদের এই রক্তের উপরেই প্রতিষ্ঠিত হোক স্বাধীনতার সোপান৷’’ যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বলেন---‘‘হিজলীর রাজবন্দী শিবিরে অন্তরীণে আটক বন্দীগণের উপর গুলি নিক্ষেপের কথা শুনিয়া আমি মর্মাহত হইয়াছি৷ রাজবন্দীগণ নিরস্ত্র কাপুরুষের মত তাহাদিগের উপর গুলি চালাইবার ফলে মধ্য কলকাতা কংগ্রেসের অক্লান্ত কর্মী শ্রীযুত সন্তোষ কুমার মিত্রের ও অন্য একজনের জীবন নাশ হইয়াছে৷ এই দুর্ঘটনার সংবাদে আমি শোকাভিভূত হইয়াছি৷’’ প্রতিবাদী হন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ ২৬শে সেপ্ঢেম্বর, ১৯৩১ কলকাতার মনুমেন্ট ময়দানে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় হাজির হন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘এই যে হিজলীর গুলি চালানো ব্যাপারটি আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় তার শোচনীয় কাপুরষতা ও পশুত্ব নিয়ে যা কিছু আমার বলবার সে কেবল অবমানিত মনুষ্যত্বের দিকে তাকিয়ে৷ এত বড়ো জনসভায় যোগ দেওয়া আমার শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর মনের পক্ষে উদ্‌ ভ্রান্তিজনক, কিন্তু যখন ডাক পড়ল থাকতে পারলুম না৷ ডাক এল সেই পীড়িতদের কাছ থেকে, রক্ষক নামধারীরা যাদের কন্ঠস্বরকে নরঘাতক নিষ্ঠুরতা দ্বারা চিরদিনের মতো নীরব করে দিয়েছে৷’’

(কালান্তর হিজলী ও চট্টগ্রাম)৷ হিজলী হত্যাকাণ্ডের অভিঘাতেই কবিগুরু রচনা করেছেন ‘প্রশ্ণ’ কবিতাটি---যেখানে তিনি বলেছেন ‘কন্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে,বাঁশি সংগীত হারা’৷

স্বাধীনতা সংগ্রামে তথা রাজনীতির আঙিনায় বিপ্লবী সন্তোষ মিত্রের জীবন খুবই স্বল্প পরিসর৷ স্বল্প পরিসর এই সংগ্রামী জীবনের প্রায় সবটাই ঘটনাবহুল৷ কিন্তু অজানা--- অনালোচিত থেকে গেছে দেশমাতৃকার বেদীমূলে নিবেদিত প্রাণ বাংলা মায়ের এই বীর সন্তানের ---বীর বিপ্লবীর৷ অন্যান্য অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের মতই বিপ্লবী সন্তোষ মিত্রও বিস্মৃতির অতলে৷