ইতোপূর্বেই আমি তোমাদের ৰলেছি যে এ জগতে কোন কিছুই অর্থহীন নয়৷ প্রতিটি ধবনি-স্পন্দনের অর্থ রয়েছে৷ আমরা তার অর্থ জানি বা না জানি, প্রতিটি ধবনির অর্থ ঠিকই রয়েছে৷ তাই প্রতি শব্দই অর্থময়৷ আর বাক্য কাকে ৰলে? শব্দের সমষ্টিকে ৰলে বাক্য৷ প্রতিটি বাক্যের নিজস্ব তাৎপর্য রয়েছে৷
যদি বলি, ‘ঈশ্বর এক সত্তা’ অথবা ‘পরমপুরুষ হলেন এক ও অদ্বিতীয় সত্তা’ তাহলে ওই ‘এক’ শব্দটা বিশেষ ধরণের এককত্বকে ৰোঝাচ্ছে৷ যদি ৰলি ‘দুই’, তাহলে দু’টো ভিন্ন ভিন্ন বিন্দুকে ৰোঝাচ্ছে, কিন্তু এ ধরণের ৰলার পেছনে মনস্তত্ত্বটা কিন্তু একই থেকে যাচ্ছে৷ যদি ৰলি, ‘তিনি সসীম’ এটাও এক ধরণের মানসিক চিন্তা৷ দর্শনে সসীম ও অসীমের মধ্যে সামান্য পার্থক্যই রয়েছে, কারণ উভয়ই হ’ল একই মনের ভিন্ন ধরণের দু’টি কল্পনা মাত্র৷ তবু আমরা ৰলে থাকি, পরমপুরুষ হলেন এক ও অসীম সত্তা৷ আমরা ৰলি, তিনি এক৷ কেন তা ৰলি,---কারণ আমরা তাঁর সান্নিধ্যে আসতে পারি৷ আমরা আমাদের সত্তাকে তার মধ্যে তখনই নিরাপদে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি যখন আমরা আমাদের সত্তাকে তার মধ্যে মিশিয়ে দিতে পারি৷ তাই আমাদের ভাবপ্রবণতাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে আমরা ৰলে থাকি যে পরমপুরুষ হলেন এক ও অদ্বিতীয় সত্তা৷ আমরা ৰলি, তিনি অসীম কারণ তার মন অতলান্ত সত্তা৷ তিনি আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে- আমাদের হিসাব-নিকাশের বাইরে---তাঁর গুণ-ক্ষমতা যা আমরা গুণে কখনও শেষ করতে পারি না৷ অজস্র, অতুলনীয়, তাই আমরা তাঁকে অসীম ৰলে অভিহিত করি৷
তিনি উৎসহীন, তিনি কারণাতীত সত্তা৷ এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর সব কিছুই কারণাত্মক৷ অন্য সব সত্তাই কার্যকারণ তত্ত্বের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলেছে৷ বহুকাল পূর্বে মহর্ষি কণাদই প্রথম কার্য-কারণ তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন৷ এই তত্ত্ব অনুসারে, প্রতি কারণের যে কার্য সেটা পরের স্তরে হয়ে যায় কারণ৷ তাই আগের স্তরের কার্যটাই পরবর্ত্তী স্তরের কারণ হয়ে যায়৷ এ জগতের সবকিছুই কারণাত্মক৷ যদি আমরা মুলের দিকে এগিয়ে যাই, যদি আমরা মৌল তত্ত্বকে ধরতে পারি, তাহলে চরম কারণকে খুঁজে পাব, ও সূক্ষ্মতম সমতাটিকেও পেয়ে যাব৷ সাধারণতঃ কারণ সব সময়েই কার্য থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে থাকে৷ চরম কারণের স্তরে আমরা এমন এক বিন্দুতে উপনীত হই, যার পরে আর আমরা এগোতে পারি না, উধের্বও উঠতে পারি না৷ তার চেয়ে আর কোন সূক্ষ্মতর কারণ সত্তা খুঁজে পাই না৷ চরম কারণ সত্তার কোন কারণ খুঁজে পাই না৷ সেটা একটা এমন স্তর যেখানে আমাদের মনের অস্তিত্ব বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে৷ সূক্ষ্মতর দৈহিক স্তর থেকে মানস সত্তা অবধি যদি আমরা অন্তর্মুখিনতার পথ ধরে এগিয়ে যাই আমরা সুক্ষ্মতর মন প্রাপ্ত হই৷ যদি আমরা মনের চরম প্রারম্ভিক স্তরে পৌঁছোই তারপরে আর গভীরে আমরা এগিয়ে যেতে পারি না আমরা কারণ-সত্তাকে তখন আর ধরতে পারি না৷ তাই যদি আমরা মনের অধিষ্ঠান-ভূমি থেকে বাইরে যাবার চেষ্টা করি, তা হ’লে ব্যর্থ হব, কারণ এসব মাপ-পরিমাপ ভেদ মনই করছে৷ কাল কী---না কর্মের গতিধারার মানসিক পরিমাপই হ’ল কাল৷ তাই সব কিছুতেই মনকে অবশ্যই থাকতে হৰে৷
পরমপুরুষের ক্ষেত্রে বলতে হয়, মন মৌল সপ্তাকে কখনই পরিমাপ করতে পারে না আমাদের মন সৃষ্টির প্রারম্ভিক স্তরে পরমপুরুষকে স্পর্শ করতে পারে না৷ তাই পরমপুরুষকে আমরা ৰলি অ-কারণ সত্তা৷ তিনি কারণহীন৷ যখন কেউ তাঁর সান্নিধ্যে আসে বা তাঁকে কেউ মনপ্রাণ ঢেলে ভালবাসে তখনই সে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘‘হে পরমপুরুষ, তোমার কারণ সত্তাটি তবে কী?’’ তার পূর্বে কেউ সে কারণ সত্তাকে জানতে পারে না৷ তার কারণ যে কী সেটা কেবল তাঁর ভক্তরাই জানতে পারেন, অন্য কেউ নন৷ সেই পরম সত্তা হলেন অণু-সত্তার আওতার বাইরে৷ তিনিই অণুকে সৃষ্টি করেছেন৷ তাই অণু যখন তাঁকে জানতে চেষ্টা করবে, অণুকে তখন ভূমার সাথে মিলেমিশে এক হয়ে যেতে হবে৷
এই ভূমা সত্তা অগণিত বস্তু সৃষ্টি করে চলেছেন, অজস্র রকমের জিনিস তারই অনন্ত আধারে গড়ে চলেছেন৷ এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা তাই সংবেদন ছাড়া আর কিছুই নয় এ হ’ল ভূমার পরমাবস্থার চৈত্তিক স্থূলীভবন৷৷ অণু-সত্তারা তাঁর মধ্যেই রয়েছে আর তিনিও প্রতিটি অণুসত্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজ করছেন৷ তাই তাঁকে ৰলা হয় সর্বনুস্যুত সত্তা৷ তিনি কেবল তোমার ভেতরেই অবস্থান করছেন না, তিনি তোমার বাইরেও বিরাজ করছেন৷ তিনি সর্বত্র বিরাজমান, ও তিনি সর্বজ্ঞ৷ যখন কেউ নিজের অণুমানসের পরিধিকে বাড়িয়ে তার নিয়ন্ত্রক-বিন্দুকে ভূমার নিয়ন্ত্রক-বিন্দুতে মিলিয়ে দেয় তখন সে-ও ভূমার সাথে একাত্ম, হয়ে যায়৷ আর তা করতে হলে কী করা উচিত, তাকে তার নিজের অণুমানসের পরিধিকে ৰাড়িয়ে তুলতে হৰে৷
এখন প্রশ্ণ হ’ল, মানুষ কী ভাবে তার মানস পরিধিকে বাড়িয়ে তুলবে? বিরামবিহীনভাবে মানসিক ভাবজড়তার বিরুদ্ধে ও ভৌতিক সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সে তা পারে৷ তোমরা জান, এই যে ভৌতিক জগৎ এটা বিশাল হলেও কিন্তু অনন্ত নয়, কারণ এ হ’ল ভূমা মনের সীমিত কল্পনামাত্র, সীমারেখারা কখনই অসীম হতে পারে না৷ তাই গ্রহ-উপগ্রহ-ছায়াপথযুক্ত আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অত্যন্ত বিশাল হলেও অসীম নয়৷
অনুরূপভাবে, মানসিক স্তরে যদি কোন চিন্তা খুব ৰড়ও হয় কিন্তু তা সীমারেখার দ্বারা বেষ্টিত হয় তবে সেই চিন্তাটাকে ৰলৰ ভাবজড়তা৷ মানব মনীষার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে ভাবজড়তা অবরুদ্ধ করে দেয়৷ তাই যে মানুষ অথবা যে আধ্যাত্মিক সাধক নিজেকে পরমাবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাকে ভাবজড়তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই হবে৷ দর্শন, অর্থনীতি, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের অন্যান্য সকল শাখার ক্ষেত্রেই এই ভাবজড়তা হল অত্যন্ত ক্ষতিকর জিনিস৷তোমরা ছেলেরা ও মেয়েরা, তোমরা যারা আধ্যাত্মিক সাধক কোন ভাবেই ভাবজড়তার বেদীমূলে নিজেকে আত্মসমর্পণ করৰে না৷ অতীতে ভাবজড়তা বা ডগমা মানব সমাজের অনেক ক্ষতি করেছে অনেক বিচ্ছিন্নবাদী প্রবণতার জন্ম দিয়েছে৷ তাই আজ তোমাদের ধবনি হওয়া উচিত-‘ভাবজড়তার অন্ত হোক, ভাবজড়তার অন্ত হোক’৷ তোমরা নিজেদের ভাবজড়তার ঊধের্র্ব ও মনুষ্যত্বের পূর্ণ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত হও৷ (কিংষ্টন, ২১-৯-৭৯)