রসোন (রসুন)–Allium sativum
তোমরা রসুনের নাম শুনেছ নিশ্চয়৷ শব্দটি রসুন নয়–রসোন৷ রস উন ঞ্চ রসোন৷ তিক্ত, কটু, কষায়, লবণ, অম্ল, মধুর–এই ছয় রকমের খাদ্য রস আছে৷ রসোন তামসিক খাদ্য হলেও তাতে ছ’টি রসের মধ্যে পাঁচটি রস রয়েছে–নেই কেবল অম্ল রস৷ তাই অম্লরসের সঙ্গে রসোন মিশ্রিত হলে তাতে একাধারে ছ’টা রসই এসে যায় উন মানে কম, যাতে একটা রস কম তা রসোন৷ উত্তর ভারতে রসোনকে ‘লহসূন’ বলা হয়৷
রসোন একটি দুর্গন্ধ যুক্ত তামসিক বস্তু৷ মানুষের শরীর তাকে গ্রহণ করতে চায় না কারণ এই তামসিক বস্তুটি মানুষের ভোজ্য নয়৷ এই তামসিক বস্তুটি শরীরের মধ্যে থাকে না৷ ভোজনের পরে শরীরে কিছুক্ষণ থেকে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে দিয়ে মল, মূত্র ও ঘর্মের মাধ্যমে রসোন শরীর থেকে নির্গত হয়৷ রসোন খাবার পর শরীর তাকে বাইরে ঠেলে ফেলে দেবার জন্যে আঁকুপাঁকু করতে থাকে৷ রস, রক্ত, শুক্র, ঘর্ম, মল, মূত্রের মাধ্যমে শরীর তাই তাকে তাড়াতাড়ি বের করে দেয়৷ শরীরের রস ধাতু শ্বাস–প্রশ্বাসের মাধ্যমে রসোনের জলীয় অংশকে ও দুর্গন্ধকে শরীর থেকে বের করে দেয়, যার ফলে রসোনভোজীর শ্বাসপ্রশ্বাস দুর্গন্ধ যুক্ত হয়৷ রক্তের মাধ্যমেও রসোনের রস–গন্ধ বিস্তৃতি লাভ করে ও মাংস–মজ্জা–মেদে পরিণত হয়৷ অবশেষে রোগের মাধ্যমে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়৷
রসোনের রস ও দুর্গন্ধ বহিষ্ক্রণের অন্যতম পথ হ’ল লোমকূপের মাধ্যমে নির্গমনকারী ঘর্ম৷ রসোনভোজীর প্রচুর পরিমাণে ঘাম বেরোয়৷ ঘাম ৪৫ মিনিটের বেশী কোন একটি স্থানে জমা থাকলে তা পচতে থাকে৷ তাই রসোনভোজীর শরীর থেকে নির্গত হয় অতি মাত্রায় দুর্গন্ধ, যা যে কোন দুর্গন্ধ যুক্ত প্রাণীর থেকেও অসহনীয়৷ তাই রসোনভোজীর নিকট কেউ বসতে চায় না৷ হ্যাঁ, মন্দের সঙ্গে ভালো মিশে থাকে বৈকি৷ পৃথিবীর কোন কিছুই অবিমিশ্র নয়৷ অনেক দোষ থাকলেও রসোন পরোক্ষভাবে একটি উপকার করে দেয়৷ কিছু কিছু রোগ শরীরে জমা থাকে, ফুটে বেরোতে চায় না৷ সে অবস্থায় রসোন খেলে ঘর্মের মাধ্যমে সেই রসোন কিছুটা বেরিয়ে আসে৷ তাতে জমে থাকা ব্যাধির, এমন কি কিছুটা দুরারোগ্য ব্যাধির কিয়দংশও বেরিয়ে যায়৷ একে মন্দের ভালো বলা যেতে পারে৷ তবে অপকারের মাত্রা উপকারের মাত্রাকে ব্যাপকভাবে ও বিপুলভাবে ছাপিয়ে যায়৷ রসোন একসঙ্গে বেশী পরিমাণে বের হয় মূত্রের মাধ্যমে৷ রসোন ভোজীর মূত্র অত্যধিক দুর্গন্ধযুক্ত৷ তাই অনেক ইতর শ্রেণীর জীবজন্তুও রসোনভোজীর মূত্রের ধারে কাছে ঘেঁসে না৷ মূত্রে অতি মাত্রায় দুর্গন্ধ থাকায় রসোনভোজীর শারীরিক সংযমও কম থাকে৷
অতি রসোনভোজীর চর্ম রোগ হবেই৷ শুক্র প্তম্ভপ্পহ্মড়গ্গ রসোনের প্রভাবে জীর্ণবিজীর্ণ হয়ে যায়৷ অতি রসোনভোজীর সন্তানেরা অল্প ক্ষুদ্ধি সম্পন্ন ও কদাকার হয়ে থাকে৷
মনের ওপর রসোনের প্রভাব বেশ ক্ষতিকর৷ যাঁরা সাত্ত্বিক ভোজনের পক্ষপাতী তাঁরা রসোনকে ও একই কারণে পেঁয়াজকেও বর্জন করে চলে৷ দুর্গন্ধযুক্ত তামসিক বস্তু হলেও যারা রন্ধনে রসোন ব্যবহারের পক্ষপাতী, তাঁদের কাছে এই গন্ধটি সম্ভবত স্বর্গসুখ এনে দেয়
পেঁয়াজ তথা শূকরকন্দ
পেঁয়াজের আরেকটি নাম শূকরকন্দ কারণ পেঁয়াজভোজীর অবস্থা হয় জেনেশুণে আয়ুক্ষয় করে’ শূকরের দশা প্রাপ্ত হওয়া৷ তাই যাঁরা পেঁয়াজের ভক্ত তাঁরা পেঁয়াজকে বলেন সুকন্দক আর যাঁরা অভক্ত তাঁরা বলেন শূকরকন্দ৷ কারও কারও মতে পেঁয়াজকে শূকরকন্দ বলা হত এই কারণে যে, শূকর সব গাছেরই শেকড় বা মূল খেতে ভালবাসে৷ পেঁয়াজের মূল বলতে পেঁয়াজ গাছকেই ক্ষোঝায়৷ কোন সাজানো ফুলের বাগানে যেমন কোন শূকরকে ছেড়ে দিলে সে আগে মূলকে খাবে ও পরে বাগানকে তছনছ করে দেবে তেমনি অযোগ্যের হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছেড়ে দিলে দলীয় স্বার্থের জন্যে রাষ্ট্রের সংরচনাকেই তছনছ করে দেবে৷
রসুনের মত পেঁয়াজেও কিছু ঔষধীয় গুণ আছে৷ পেঁয়াজ দেহের লুকোনো অসুখকে বের করে আনে৷ কিন্তু এর কিছু অবগুণও আছে৷ সেই অবগুণগুলোকে দূর করে তার ঔষধীয় গুণগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে৷ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার না করে* এর তেল রোগের ঔষধ (মালিশ) হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে৷
পোয়াল ছাতু
তোমরা অনেকেই নিশ্চয় পোয়াল ছাতু দেখেছ–অনেকেই হয়তো বা খেয়েছ৷ রােের এটি একটি জনপ্রিয় সুখাদ্য৷ পোয়াল ছাতুকে কোথাও কোথাও ভুঁইফোঁড়ও বলা হয়৷ ইংরেজীতে বলা হয় প্পব্ভব্দড়ব্জপ্সপ্স. শীতপ্রধান–গ্রীষ্মপ্র্ নির্বিশেষে বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই এই ছত্রাক বর্গীয় বস্তুটি কোথাও সোজাসুজি খাদ্য হিসেবে, কোথাও বা মাংসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ সংসৃক্তে এর নাম ‘কবক’৷ জিনিসটি নিরামিষ হলেও মাংসের গুণসম্পন্ন৷ তাই সাত্ত্বিক আহার যাঁরা করেন, তাঁদের পক্ষে এটি খাওয়া নিষিদ্ধ৷ রাঁধলে স্বাদও হয় মাংসের মত৷ পৃথিবীর কোথাও কোথাও জিনিসটিকে না জানিয়ে মাংসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷
কাঠ, খড়, কিছুটা পচে যাওয়া উদ্ভিদের ওপর এটা আপনা–আপনি জন্মায়৷ সব ছত্রাকের স্বভাব এই৷ বর্ষার শেষের দিকে ও শরতের প্রাক্কালে পোয়াল অর্থাৎ খড়ে এরা আপনা থেকেই জন্মায়৷ পোয়ালে এরা জন্মায় বলে এদের বলে পোয়াল ছাতু৷ বিচালি ক্ষড় হয়ে পেকে শুকিয়ে যায়, তখন তাকে অল্প ফাঁক ফাঁক করে বিছিয়ে দিয়ে পচবার সুযোগ করে দেওয়া হয়৷ তখন তার ওপরে এই ছাতু বা কবক জন্মায়৷ তাকে বলে বিচালি ছাতু৷ গোবর পচে গেলে তার ওপরেও এই ছাতু জন্মায়৷ তাকে বলে গোবর ছাতু৷ গোবর ছাতু অভক্ষ্য৷ কিছু কিছু বিষ–দোষ যুক্ত বস্তুতে এই ছাতু জন্মায়৷ সেই ছাতুও অভক্ষ্য৷ মানব শরীরে তাদের বিষক্রিয়া হয়৷ যে ছাতুগুলি দুর্বল ও ছোট, আঙ্গুলে ধরলেই গলে যায়, সেগুলিও অভক্ষ্য৷ কথ্য ক্ষাংলায় বলি ব্যাঙের ছাতা৷ এগুলি হাতে–পায়ে বেশী লাগলে গরল–ঘা ন্দ্বন্তুম্ভ্রন্দ্বপ্প্ত্র হবার সম্ভাবনা থাকে৷ আশ্বিনে দুর্গাপূজার প্রাক্কালে অর্ধেক পচে যাওয়া উদ্ভিজ্জের ওপর যে বিশেষ ধরনের ছাতু দেখা যায়, বর্দ্ধমানের গ্রামে তাকে দুর্গাছাতু বলে৷ দুর্গাছাতু কেউ খায়, কেউ খায় না৷ যাঁরা খান তাঁরা অল্প তেঁতুল জলে সেদ্ধ করে, তারপর জলটা ফেলে দিয়ে সেটা রান্না করেন ও রান্নায় ঝাল একটু বেশী দেন৷ বর্ষায় শেষে উই–ঢিবির ওপরে যে ছাতু জন্মায়, হুগলী–বর্দ্ধমান তাকে রুই ছাতু বলা হয়৷
হ্যাঁ, শেষের দিকে আবার বলে রাখি, ছত্রাক জাতীয় সমস্ত খাদ্য (কবক, পোয়াল ছাতু) খাদ্য হিসেবে পুষ্টিকর হলেও, সবদিক দিয়ে মাংসের গুণসম্পন্ন ও মাংসের দোষসম্পন্ন৷ তাই যাঁরা সাত্ত্বিক আহার করতে চান, বা সত্ত্বগুণের অনুধাবন করতে চান, তাঁদের পক্ষে কবক বা পোয়াল ছাতু না খাওয়াই ভাল৷ যদি কোন গৃহস্থের কবকের প্রতি অত্যধিক আকর্ষণ থাকে, তবে দিনের বেলায় (আকাশে যখন সূর্য আছে সেই সময়) কবক খেতে পারেন৷ সূর্য ডোবার পর কিছুতেই খাবেন না৷ সূর্য ডোবার পরে কবক খেলে গলিত কুষ্ঠ হয়–প্রাচীনকালে আয়ুর্বেদের ঋষিদের এই ধরনের ধারণা ছিল৷
(দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য)