দর্শনের বাস্তবতা ও বিভ্রম

লেখক
খগেন্দ্রচন্দ্র দাস

আইন আদালতে একটি শব্দবন্ধ প্রায়শই ব্যবহার হয়---‘‘দৃষ্টত’’Prima facie)৷ অর্থাৎ যে কোন ঘটনা  চুরি, ডাকাতি, দুর্ঘটনা ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করে প্রাথমিকভাবে যে ধারণা গড়ে ওঠে তাকেই বলা হয় প্রাইমাফেসি৷ এই ‘প্রাইমাফেসি’ প্রায়শই পরবর্তী সময়ে ধোপে টেকে না৷ যেমন ধরুন বাজার থেকে ফল বা শব্জি কেনার সময় কোন কোন ফল বা শব্জির গায়ে পচনের দাগ দেখতে পাওয়া যায়৷  আমরা ও নিয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তা করি না, পচা অংশটুকু কেটে বাদ দিয়ে খেয়ে নিই৷ আসলে কিন্তু পচন সবটুকুতেই ধরেছে অধিকতর পচা অংশটুকু দেখা যাচ্ছে মাত্র বাস্তবে কিন্তু পচনের বৃহৎ অংশ রয়ে গেছে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে৷ অথবা ধরা যাক, দুটো রেলগাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ যা দেখে  পথচারী বা কোন সাধারণ মানুষের প্রাথমিক ধারণা হয় নিশ্চয় চালকের কোথাও ভুল হয়েছে৷ কিন্তু তদন্তের পর দেখা গেল যে না এই দুর্ঘটনার জন্য সরাসরি চালকদ্বয় দায়ি নন, প্রকৃত দোষী দুই দিকের দুই ষ্টেশন মাস্টার অথবা অন্য কোন যান্ত্রিক গোলযোগ থেকে এই দুর্ঘটনার সূত্রপাত৷ যে  কোন বিষয়েই প্রকৃত তথ্য বা সত্য সামনে আসতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়৷

১৯১২ সনের ১২ এপ্রিলের রাতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জলযান টাইটানিক জাহাজ একটি বরফের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়৷ যে জাহাজ কখনোই ডোবার কথা নয় সেটিই এভাবে ডুবে গেল প্রাথমিকভাবে সবাই ধরে নিলেন যে ওই একখণ্ড বরফই সেই ভয়াবহ দুঘর্টনার কারণ৷ কিন্তু না, পেছনে আরও অনেকগুলো কারণ ছিল৷  যেমন ওটা কোন সাধারণ বরফের খণ্ড নয়, ওটা ছিল জলের তলায় লুকনো এক বিশালাকৃতির বরফের পাহাড়৷ অন্য কারণগুলি যথাক্রমে--- সে রাতে আবহাওয়া ছিল দুর্র্যেগপূর্ণ, দূর পর্যন্ত দেখার জন্য  নাবিকদের কাছে যথেষ্ট বাইনোকুলার ছিল না,  বরফের পাহাড় চোখে পড়া মাত্রেই নাবিক দ্রুত দিক পরিবর্তনের চেষ্টা করেন৷ এত বড় একটা দুর্ঘটনার পেছনে এতগুলো কারণ জড়িয়ে ছিল৷

আসুন আরও কিছুটা বৃহত্তর ক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি ফেরাই৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ৷ ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য সমালোচকগণ পাঁচটি কারণকে দায়ি করেন৷ (এক) ভার্র্সই চুক্তি এই চুক্তি ১৯১৯ সনে সম্পাদিত হয় ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে৷ আর এই চুক্তিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমস্ত দায় চাপানো হয় জার্মানির কাঁধে৷ (দুই) ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা৷ ১৯২৯ সন থেকে ১৯৩৯ সনের মধ্যে পৃথিবী জুড়ে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল৷ (তিন) উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতি৷ (চার) হিটলারের অভিলাষ৷ (পাঁচ) লীগ অব নেশনসের ব্যর্থতা৷ এখানে আমাদের প্রয়োজনীয় বিষয়---হিটলার ও তার উগ্র জাতিয়তাবদী অভিলাষ, যা নিয়ে আমরা আলোচনা করব৷

হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদ বুঝতে আমাদের একটু পিছিয়ে উনবিংশ শতাব্দীতে যেতে হবে ১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে জন্ম হয় বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ উইলহেল্ম নিৎসের৷ এই নিৎসেকেই বলা হয় হিটলারের আধ্যাত্মিক গুরু৷ নিৎসে মনে করতেন, পরিবর্তনশীল জগতে কোন কিছুই স্থায়ী নয়৷ নৈতিকতার চিরন্তন মাপকাঠি বলে কিছু হয় না৷ আজ যা সত্য কাল তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হতে পারে৷ এসব কথা আপাতত সঠিক বলেই মনে হয়৷ কিন্তু  এরপর তিনি যা বললেন তা আমাদের বুকে কাপুনি ধরিয়ে দেয়, তাঁকে বলতে শুনি ‘‘বিবেক, অপরাধ ইত্যাদি শব্দের কোন তাৎপর্য নেই৷’’ শুধু তাই নয় ‘‘এইসব শব্দ মানবীয় প্রবৃত্তিকে দমন করে রাখে৷’’ আমরা ভারতবর্ষের মানুষ বিবেকহীন মানুসের কথা ভাবতেই পারি না৷ অবশ্য বিবেককে অস্বীকার করলেও তিনি কিন্তু মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্য দিয়ে চলবে এমনটা প্রত্যাশা করেছিলেন৷ তাঁর লেখা একটি বই Thus Spoke Zarathustra’৷ সেখানে তিনি এক অভিনব সুপারম্যান বা অতিমানব তত্ত্বের কথা উল্লেখ করেছেন৷ তিনি আশা করেছেন যে, এই সুপারম্যান বা  অতিমানবেরা লৌহহস্তে দেশ শাসন করবেন৷ তিনি ‘সারভাইবাল অব্‌ দ্য ফিটেষ্ট অর্থাৎ, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা নীতিতে বিশ্বাস করেই এমন উক্তি করেছেন৷ হিটলার ছিলেন নীৎসের দর্শন চিন্তার ফসল৷ এক কথায় নিৎসে ছিলেন হিটলারের স্পিরিচুয়াল গড ফাদার বা আধ্যাত্মিক গুরু৷ কঠোর হাতে দেশ শাসন করা অর্থে নিৎসে কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষকে মেরে ফেলার  কথা বলেন নি৷ নিৎসে আসলে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন এর কথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন৷ হিটলার জার্র্মন জাতির মধ্যে এমন এক ধারণার জন্ম দিলেন যে তারাই শ্রেষ্ঠ আর্য জাতি৷ নিৎসের দর্শনের অপব্যাখ্যা হিটলারের মনে জন্ম দিয়েছিল এই আত্মনিম্ভরিতার, শেষ পর্যন্ত যা কোটি কোটি  মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল৷ কোন একটি দর্শন রচনার দিক থেকে নিখুঁত হওয়ার প্রয়োজন, সেই দর্শনের অনুগামীদের সেটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করাটাও ততটাই বাঞ্ছনীয়৷ একটি দর্শন কতটা মানবকল্যাণ করতে পারবে তা নির্ভর করছে উপযুক্ত দুটি বিষয়ের ওপর৷ নিৎসের দর্শনে কিছু অপূর্ণতা থাকলেও সেটা অতটা বিধবংসী হত না যদি না তার অপপ্রয়োগ হত৷

ভারতীয় আস্তিক্য দর্শনসমূহের বৈশিষ্ট্য ও সাযূজ্য, এই যে এখানে যুক্তি সহকারে ঈশ্বরের উপস্থিতি স্বীকার করা হয়েছে৷ যা নেতাকে হিটলার হওয়া থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করবেই৷ যদি না কেউ অপব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগের চেষ্টা করেন৷ আসুন দেখে নিই প্রাচ্য দর্শন সম্পর্কে আমাদের এই আত্মপ্রত্যয়ের উৎস কী? এ বিষয়ে আমরা দুটি উদাহরণ উদ্ধৃত করেছি৷ ধাতুখণ্ড বা উদ্ভিদের মধ্যে প্রাণের অতিসূক্ষ্ম সাড়ায় সূচিত হয় মনের যে আভাস, সে যেমন পর্বে-পর্বে তরঙ্গায়িত হয়ে অবশেষে মানুষের মধ্যে ফুটে ওঠে পরিপূর্ণ মহিমায়, তেমনি মানুষের নিজের মধ্যেও আছে এক উত্তরায়ণের প্রবৃত্তি---দিব্যজীবনের দিকে, তার বর্তমান জীবন যার প্রবেশক মাত্র৷ পশুর প্রাণের বীক্ষণাগারে প্রকৃতি যদি মানুষ গড়ে থাকে যুগযুগান্তের সাধনায়, তাহলে মানুষের প্রাণ-মনের বীক্ষণাগারে তার সচেতন সহযোগিতায় সে যে অতিমানব বা দেবতা গড়বার সাধনা করছে না তাই-বা কে বলতে পারে? শুধু দেবতাই -বা কেন, এও কি বলা যায় না যে, মর্ত্য আধারে দিব্য-পুরুষকে মূর্ত করবার তপস্যাই তার চলছে এখানে৷’’ (দিব্য-জীবন শ্রীরবিন্দ পৃঃ-৪) শ্রী অরবিন্দ-র অতিমানব  ও নিৎসের অতিমানবে বাস্তবে কোন পার্থক্য নেই, পার্থক্য দেখা দিয়েছে প্রয়োগে বা  অপপ্রয়োগে৷ শ্রী অরবিন্দ-র এই বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৮ সনে তার ঠিক সাত বছর পর ১৯৫৫ সনে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আরও প্রাঞ্জল ভাষায় বললেন---‘‘মানুষ তুমি ওঁঙ্কারের পথ ধরে সূক্ষ্মত্বের দিকে এগিয়ে চল৷ ছুটো না তুমি আপাতমধুর তমোগুণী মরীচিকার দিকে৷ সত্ত্বগুণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর ব্রহ্মত্বে লীণ হও৷ ওঁঙ্কার যেখান থেকে এসেছে সেখানে গিয়ে পৌঁছাও৷ সাধনায়, নিষ্ঠায় জাগিয়ে তোল নিজের সুপ্ত মনুষ্যত্বকে--- উদ্বোধন করো দেবত্বের মনীষাকে, আর সেই সাধনালব্ধ শুচিশুভ্র দেবত্বকে বিলিয়ে দাও ব্রহ্মী মহিমার অখণ্ড স্রোতে৷ অর্জন কর সেই পরমাস্থিতি যার জন্যে অনাদিকাল থেকে তুমি অনেক কষ্টে এগিয়ে এসে আজ নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দেবার সুযোগ পেয়েছ৷’’ (সুভাষিত সংগ্রহ,১ম,২য়,৩য় খণ্ড একত্রে, পৃঃ১৯) এত দ্বার্থহীন ভাষায় বলার পরেও যদি প্রায়োগিক ত্রুটির জন্য ব্যর্থতাকে আলিঙ্গন করতে হয় তবে সে দায়ভার দর্শনের স্রষ্ঠার নয়, প্রয়োগকারীদের স্বীকার করতেই হবে৷